পাথরেও ফোটাব ফুল / অনিরুদ্ধ আলম

তিনতলার অই রেলিঙ থেকে লাল শার্টটা যেই
ঝাঁপিয়ে পড়ল তুমুল হাওয়ার বুকে নিমিষেই –
খেরো রৌদ্র  ছুটে এসে চেঁচিয়ে ওঠে খুব –
ওখানে নয়। ওখানে নয়। এইখানে দাও ডুব।

ডুবসাঁতারে চ’লে এসো ধলমেঘদের বাড়ি
বাড়ির ছাদে দেখতে পাবে পায়রা সারি-সারি।
বাকুমবাকুম পায়রাগুলো ঝোটন বেঁধেছে
নদীর জলে নীলাকাশটা নাইতে নেমেছে।

নাইতে নেমে কানা বগী হাঁটু ভেজায় না
গুনে-গুনে সেই-না বগীর দশটা মোটে ছা।
পাঁচটা গেল মাছ ধরতে। রইল বাকি পাঁচ
হাতের পাঁচের মতোই এ পাঁচ। যায় করা খুব আঁচ।

‘হাতের পাঁচ’টা হারালে কেউ –  কী যে সর্বনাশ
আহা কারো মাঘ মাস আর কারো পৌষ মাস।
পৌষ এলে ঘরে-ঘরে পিঠে খাওয়ার ধুম
আনন্দ-উৎসবে জাগে দীঘল গাঁ নির্ঘুম।

এ গাঁও, ও গাঁও ঘুরে বেড়ায় কোজাগরী দল
গল্প বেচে। শোলক বেচে। বেচে কোলাহল।
শোলকবেলার কাজলা দিদির কোথায় পাব খোঁজ
কোথায় গেলে পাব তাকে? খুঁজি তাকে রোজ।

খামারে রোজ গন্ধ ছড়ায় সোঁদাসোঁদা মাটি
জংলা সবুজ প্রান্তরটা কী যে পরিপাটি।
প্রান্তরে বিল  দিঘি নদী মাঠ ও বনের মেলা
চড়ুইটা ধান খুটছে।গাইছে এ বেলা, ও বেলা।

ও ঘর থেকে কেউ একজন বলল, তুমি যেন
মেলায় গেলে খুকুর জন্যে রুপোর নূপুর এনো।
পাতার নূপুর ভরদুপুরে খুব মাতিয়ে রাখে –
পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে-থাকা একলা বাড়িটাকে।

আগের বাড়ির দইওয়ালা এল। বলল, আরও
ভালো দধি এনেছি আজ। বলছি। নিতে পারো।
এই নিয়েছি মুঠি ভ’রে শিশির-ধোয়া ধুলো
ঘাস। মাটি। ধান। খড়কুটো। ঢেউ। কলমি পাতাগুলো।

খড়কুটোতে ছেয়ে গেছে মেঠো পথের মোড়
পায়ে-পায়ে পথ বেড়ে যায়। আসে নতুন ভোর।
ভোর হল তো। সাতটা শালিক খেলছে বাড়ির দ্বারে
পোড়ো বাড়ি ঘুমিয়ে আছে একগলা ঝোপঝাড়ে।

দোয়েলটা আড়মোড়া ভেঙে ছুটল ছাতিম তলে
ছাতিম তলে ছাতারে গায়। মাতে কোলাহলে।
কোলাহলে জেগে উঠছে নিথর নিঝুম পাড়া
উঠোন, দিঘির পাড়, খামারে ছড়িয়ে পড়ছে সারা।

দিঘির জলে মেঘ ভিজে যায়, আকাশ দেখে মুখ
মেঘের বুকে আঁচড় কেটে জলপোকার কী সুখ!
জলপোকা আলপনা আঁকে জলে টোকা দিয়ে
আলটপকা রোদ বলে, আজ ঢোলকলমির বিয়ে।

ঢোলক বাজে তাককুড়কুড় বদ্যিনাথের গাঁয়ে
তালসুপুরির কত্তো সারি গাঁয়ের ডানে বায়ে।
পানকৌড়ি খিদে পেলে পানসুপুরি খেয়ো
বাটা ভরে খেতে দেব। আমার বাড়ি যেও।

আমার বাড়ি উজিরপুর। জংলা-জংলা পাড়া
সে-পাড়ারই বৃষ্টিবাদল বড়ই হতচ্ছাড়া!
হতচ্ছাড়া পুষি বেড়াল – ইঁদুরে অরুচি
সুযোগ পেলেই চুরি করে খায় মাছ দুধ লুচি।

পুকুরচুরির গুজবখানা ছড়ালে প্রান্তরে
আঁতকে উঠে ডোবা বলে, আমরা মরি ডরে।
ডোবার জলে হাবুডুবু খায় ডুমুরের ছায়া
ডুমুরপাতার ঝুমুরঝুমুর ছন্দ ছড়ায় মায়া।

মাখিয়ে মায়া মাদল বাজে কোন মহুয়ার বনে?
ভোমরা বনে মল বাজিয়ে নাচে আপন মনে।
মাঠ যদি হয় ধানটুনি আর ঘাসের আপন বাড়ি
মাঠের বাড়ি জানতে তবে ইচ্ছেটা হয় ভারি।

মাঠ হেসে কয়, বাড়ি আমার দূরপাথারের পাড়ে
যে পাথারে সুজ্যি ওঠে জোড়-পাহাড়ের আড়ে।
যেখানে রোদ কদমঝোরা হয়ে পেখম মেলে
পেখম মেলে মেঘচমচম উদোম হাওয়া ঠেলে।

মেঘের বাড়ি রঙের হাঁড়ি। সাতরঙে ঝিলমিল
হলদে সাদা বেগুনি লাল কমলা কালো নীল।
হলদে পাখির কষ্ট অনেক – কন্ঠে যে সুর নাই
চাঁদের কাছে সুরের তালিম রাত জেগে নেয় তাই।

চাঁদচালতা হলদে আলতা ছড়ায় বিলের বাঁকে
আয়েস করে মেঘবালিশে এলিয়ে মাথা রাখে।
উলটপালট তুলোট বালিশ ঝলমলে ফুলদল
ছড়িয়ে আছে নীলাকাশে জমকালো অঞ্চল।

রাত ছড়িয়ে আঁধারখোপা কানে-কানে বলে –
ঘুমাও বকুল বোতাম পোকা শালিক ছাতিম তলে।
ঘুমাও ঘুঘু প্রজাপতি মাচান-ভরা ঝিঙে
ঘাস বিল বক চিল কাশফুল গঙ্গাফড়িঙ ফিঙে।

ঘুমায় না চাঁদ। পাহাড়া দেয় বর্ণালি গাঁও বন
বনপাহাড়ে জোনাক ছড়ায় স্বর্ণালি অঞ্জন।
অগাধ জোনাক চাঁদ ঘুমোলে আঁধার ফিকে হয়
আঁধার ছেটে সুজ্যি ছড়ায় আলো পাড়াময়।

আলোর ঝুড়ি আলোর ঝোরা আলোর কোনো ঘুড়ি
সুজ্যিটা রোজ খুব মজা পায় ছড়িয়ে চুমকুড়ি।
ছড়ায় আলোর আতশবাজি সারা দিন সে ধ’রে
সারাটা দিন আকাশ পাড়ের মেঠোপথে ঘোরে।

মেঠো পথের শেষপ্রান্তে কত্ত থোকা ফুল
ফুল নয়তো আহা শত রঙের হুলুস্থুল।
রঙ নেবে গো? মুঠি ভ’রে? পকেট ভ’রে? তাও
নিতে পারো। হাতটা পাতো। যেমনখুশি নাও।

রঙবাহারি পাহাড়ি নীল হলদে সবুজ ছায়া
সেই ছায়াতে জড়িয়ে আছে ঘাই হরিণীর মায়া।
হরিণ খেলে এলেবেলে এই-না নদীর বাঁকে
নদী, ডাকো। ডাকো-না অই ছোট্ট পাখিটাকে।

ছোট্ট পাখি ছটফটে খুব। গাছে-গাছে ছোটে
ছোটার কোনো শেষ কি আছে মাঠ ঘাট আর গোঠে?
মাঠের হাটে অষ্টপ্রহর দামাল হাওয়ার মেলা
হাওয়ার গাড়ি চেপে ধুলো কাটিয়ে দেয় বেলা।

হাওয়ার গাড়ি, হাওয়ার গাড়ি, কোথায় তুমি যাও?
আমার বাড়ি সাগরদাড়ি। সঙ্গে করে নাও।
আমার বাড়ি বরবটি শিম আঁখের খামার আর
দোপাটি জুঁই পুঁই মালঞ্চ যুগল দিঘির পাড়।

দিঘির পাড়ে আড়াআড়ি ধানকাউনের ক্ষেতে
শিস কেটে যায় বাউলা বাতাস উচ্ছ্বাসে খুব মেতে।
মেতে ওঠে স্যাঁতসেতে আল ছোটার আনন্দে
হাঁটিহাঁটি পায়েপায়ে ছুটছে সে ছুটছে।

ছুটছে সে। খালপাড়ের যে তালগাছটা আছে, তার
নিমন্তন্ন পেয়েছে আজ। বিলম্ব নয় আর।
বিলম্ব খুব হয়ে গেছে। দু’পা চালাও জোরে
ঝড়টা জোরে আসলে বাড়ি ফিরব কেমন ক’রে?

ঝড়ের কথা ভাবতে ঘরের কথা মনে পড়ে
একটু জোরে বইলে বাতাস ঘর নড়বড় করে।
নাইওরি রোদ বৃষ্টি বাদল এই-না ঘরে রোজ
উঁকি মারে। থেকেথেকে নেয় যে আমার খোঁজ।

কুঁড়েঘরটা খড়ে ছাওয়া। ভাঙা খড়ের ছাদ
ছাদের ফাঁকে উঁকি মারে পূর্ণিমারই চাঁদ।
উঁকি দিলে ফুটফুটে ফুল দুল হয়ে জঙ্গলে
দোদুল তালে বুলবুলিরা নাচে এ অঞ্চলে।

চুলবুলে বুলবুলিগুলো খেলে গোল্লাছুট
খেলেখেলে শরীরটাকে রেখেছে অটুট।
বড় হওয়ার অটুট স্বপ্নে বিভোর ছোটো নদী
রাতদিন তাই দূর-অজানায় ছোটে নিরবধি।  

নদীর বুকে ঝিলমিলে নীল জলতোয়ালে দোলে
ঢেউজলসায় আকাশ মাতে দিগন্তেরই কোলে।
দূরদিগন্তে চর যদ্দূর ছড়ায় ধুলোর ঝড়
তারপরেই তো ধান-অরণ্যে ধানটুনিদের ঘর।

ধানটুনিরা গুনগুনাগুন ছন্দে মেতে থাকে
ঘন ঘাসের মনমাতানো গন্ধে মেতে থাকে।
গন্ধ ছড়ায় বনবাদাড়ে গন্ধরাজের দল
মন-উচাটন লতাপাতা আনন্দে উচ্ছল।

পরিপাটি প্রজাপতি বনপাহাড়ে থাকে।
শুধুই ভাবে – গঙ্গাফড়িঙ কোন পাহাড়ে থাকে!
গঙ্গাফড়িঙ সারাটা দিন একবুক রোদ্দুরে
গঞ্জ থেকে গঞ্জে ছুটে বেড়ায় ঘুরে-ঘুরে।

ধুলোঘূর্ণি ঘুরে-ঘুরে কুড়িয়ে বেড়ায় ধুলো
উড়িয়ে বেড়ায় পাথারজুড়ে ঘাস পাতা খড় তুলো।
শিমুল তুলো উড়ুউড়ু – পঙ্খীনায়ের মতো
এদিক দোলে, ওদিক দোলে হাওয়ায় অবিরত।

হন্যে হয়ে হাজার হাওয়ার দোলনাগুলো চেপে
রোদচুমকি থিরথিরথির কেবল ওঠে কেঁপে।
বৃষ্টিছোঁয়ায় ঘাসের ডগা কাঁপে। নড়েচড়ে
ছেলেবেলার অনেক কথাই ভীষণ মনে পড়ে।

মনে পড়ে বৃষ্টিঝড়ে আমের বাগানটাতে
ছুটে এসে আম কুড়াতাম বন্ধুরা একসাথে।
মিষ্টি দিদির বানানো ঝাল আমের আচার খেয়ে
দু’চোখ ভীষণ কান্নাজলে উঠত ভীষণ নেয়ে।

আমচাটনি জামচাটনি ভাবলে হঠাৎ জল
জিভেজুড়ে কী অবিরাম করত যে টলমল।
উতল দুপুর। পুকুরে জল জ্বলে-জ্বলে ওঠে
মাঝখানে তার সুজ্যিটা এক ফুল হয়ে রোজ ফোটে।

সুজ্যি যেন সূর্যমুখী। পুকুরে মুখ গুঁজে
ডুবেডুবে জল খেয়ে কী জানি বেড়ায় খুঁজে।
খুঁজতে গিয়ে পাখির ছানা বনে সে কী ঘোরা
চেনা হত কত-না পথ অচেনা-আনকোরা।

অচেনা গাঁও গেরাম পাড়া দু’ পাশে তার রেখে
দেখো-না অই সড়কখানা চলছে এঁকেবেঁকে।
ছুটছে সড়ক। দিনভর লোক-গাড়িঘোড়ার ভিড়ে
ভুলেই গেছে কখন আবার ফিরবে সে তার নীড়ে।

নীড়ে ফেরার স্বপ্ন নিয়ে রেলগাড়িটা ছোটে
সঙ্গী হয়ে ঝরাপাতা দু’পাশে তার জোটে।
ঝরাপাতার ঘরপড়শি খড়কুটোদের দল
হড়কা হাওয়ায় উড়ে-উড়ে দিনমান উচ্ছল।

হড়কা হাওয়া উড়িয়ে বেড়ায় মেঘের ফানুসগুলো
উড়িয়ে বেড়ায় এলোমেলো কাশের তুলোট চুলও।
কাশের চুলে বিলি কেটে কোয়েল বলে, আজ –
তোমার কাছে শুনব শোলক। খোলো কথার ভাঁজ।

কাঁথার মতো পাতার ভাঁজে লুকিয়ে শামুক ভাবে –
একদিন ঠিক দূরদিগন্তে হারিয়ে সে যাবে।
পেরিয়ে বন পাড়ি দেবে উঁচু-নিচু পথ
সামনে আসুক যতই বড়ো মেঘছোঁয়া পর্বত।

আকাশছোঁয়া স্বপ্নগুলো গুমরে মরে মনে
তবু গড়া স্বপ্নপ্রাসাদ হাওয়ায় ক্ষণে-ক্ষণে
ক্ষণে-ক্ষণে খড় ও ছনের গাদায় ঘুরে-ফিরে
পিঁপড়েগুলো খুব পেরেশান ব্যস্ততারই ভিড়ে।

পেরেশানির শেষ কি আছে? ফিঙের ধাওয়া খেয়ে
টিঙটিঙে অই লাল বাছুরটা ছুটছে টিলা বেয়ে।  
টিলার পাড়ে টুনটুনিদের আট কুটুমের বাড়ি
ফড়িঙ দোয়েল প্রজাপতির ষাট কুটুমের বাড়ি।

কুটুম পাখি কাঠঠোকরা টিলার মাঠে এলে
দুইজনে খুব কানামাছি খেলে এলেবেলে।
কানামাছি, হাডুডু আর লুকোচুরি সেরে
রৌদ্রহাওয়া আকাশপাড়ের নীল বাড়িতে ফেরে।

নীল বাড়িটার চিলেকোঠায় তারারা বাস করে
রাতে হলুদ ঝিলমিলে তিল হয়ে ঝ’রে পড়ে।
শিউলিবোঁটায় ঝ’রে পড়ে শিশির ফোঁটা-ফোঁটা
পিউলি গাঁথত শিউলিমালা। দারুণ ছিল ওটা।

পিউলি আমার পুতুলখেলার ছেলেবেলার সাথী
কই হারালি বন্ধু আমার। খুঁজি আঁতিপাঁতি।
কই হারাল রাজন মোহন দেশান্তরি হয়ে
বন্ধু তোদের স্মৃতিগুলো বেড়াই আজো বয়ে।

স্মৃতির পাতায় জমছে ধুলো। স্মৃতির বয়স বাড়ে
স্মৃতিরা আর প্রীতি হয়ে মনটাকে না কাড়ে।
মনপবন কী পঙ্খীরাজে চেপে কল্পলোকে
ওড়াউড়ির স্বপ্নগুলো ভাসে না আজ চোখে।

উড়ির চড়ে ঝড় এল যেই জলোচ্ছ্বাসের ভিড়ে
হারিয়ে গেল হাজার মানুষ। এল না আর ফিরে।
আয়রে ফিরে খোকন সোনা। কোথায় গেলি তুই?
ঘরের দোরে শব্দ হলেই ভাবি – এলি তুই!

ঘরের দোরে থমকে থেকে দমকা হাওয়া এসে
আচমকা খুব কড়া নাড়ে আধেক রাতের শেষে।
কড়া নাড়ে বুকের মাঝে আলোআশার উঁকি
আলতো সুখের আলতারঙে আঁকে আঁকিবুকি।

সুখ হল খুব ভালো লাগার দারুণ অনুভব
হৃদয়জুড়ে জমকালো এক ফাল্গুনী উৎসব।
ফাগুন এলে দিগদিগন্তে রঙের আগুন জ্বলে
সারাটা ক্ষণ বর্ণিল বন চকচকে ঝলমলে।

শ্যাওলাতে ঝলমলে দ্বিতল ডোরাকাটা বাড়ি
পলেস্তরা খসেখসে হয়েছে বাহারি –
ঝোপের আড়ে ঘাপটি মেরে কত-না কাল ধ’রে
আগলে রেখে পেঁচা বেজি বাঘডাশা অন্দরে।

দ্বিতল বাড়ির শীতল ছাদে লতাপাতার মেলা
জাফরিকাটা আলোছায়া ক’রে বেড়ায় খেলা।
জাফরি কাটে ভয় ছমছম মনে থোকা-থোকা
ভুতুড়ে অই বাড়িতে তুই যাসনে ওরে খোকা।

খোকা গেছে মাছ ধরতে গড়াই নদীর বাঁকে
যেখানে ঢেউ ডাহুকডাকে নাচে ঝাঁকে-ঝাঁকে।
ঝাঁকে-ঝাঁকে বৃষ্টি নামে শিসটি দিয়ে কী যে
কাক-ভেজা হয় বক টিয়ে চিল বৃষ্টিতে খুব ভিজে!

একগাদা রোদ্দুরে ভিজে ঘেমে-নেয়ে সারা
ছুটছে লোকটা ছায়ার খোঁজে হয়ে আত্মহারা।
পুঁটলি কাঁধে ভরদুপুরে যাচ্ছে কোথায় সে?
দূর-পাড়াগাঁয়? তার বাড়িটায় অপেক্ষাতে কে?

অপেক্ষাতে পথ চেয়ে তার ছোট্ট মেয়ে নুরি
তার জন্যে কিনেছে টিপ খেলনা ফিতে চুড়ি।
শত রঙের কত ফিতে ওড়ে তেপান্তরে
আয়-না ওরে পাগারকোণে। থাকিস না আর ঘরে।

যখন বনের কোণে নাচে চ্যাংড়া রোদের হরিণ
মনে নাচে ভালো লাগার ব্যাকুল বোধের হরিণ।
হরিণ তোমার ঋণের বোঝা বইছি অনেক দিন
হচ্ছে বিলীন সুন্দর বন। বাজাই সুখের বীণ।

বাজাই বাঁশি চাঁদের হাটের চিলেকোঠায় ব’সে
বিল চুরি যায়। ঝিল চুরি যায় ভাগ্যলিপির দোষে।
দোষ কি সবই নন্দ ঘোষের? হোক তদন্ত তবে
ইডিপাসের সৌভাগ্য ফিরবে আবার কবে?

আবার কবে অঝোর ধারায় আসবে আষাঢ় ফিরে
বৃষ্টিধোয়া সাতোয়াঁ দিন কাশিকুড়ার তীরে?
কাশিকুড়ার তীর জুড়ে আজ রাজহাঁসের ভিড় নেই
চৌচির মাঠ। খাঁখাঁ ঘাটে কাশবাঁশের ভিড় নেই।

পানসি নায়ে বসে মাঝির আনচানি গান নেই
পানের বরজ শুকিয়ে গেছে। সেখানে পান নেই।
উচ্ছ্বাস নেই পাতায় ঘাসে ধানকাউনের শিসে
চিলের বুকে বিলের বুকে বিষ যাচ্ছে মিশে।

বুকসমতল যাচ্ছে হয়ে পাহাড়টিলাগুলো
নদীর বুকে উড়ছে ধুধু মরীচিকা ধুলো।
এমন করে যদি ধুলোয় হারায় পরিবেশ
কেমন করে বাঁচবে গেরাম গঞ্জ শহর দেশ!

হীরক রাজার দেশজুড়ে আজ শুধুই পুতুলখেলা
হাট পাড়া গাঁও যেখানেই যাও – কাঠপুতুলের মেলা।
কাঠের পুতুল, কাঠের পুতুল, কাঠবাদাম কি খাও?
কি বললে? পোলাও হালিম? দই খই ডিম তাও?

তোমার দুখি মুখে কবে ফুটবে কথার খই?
চারদিকে খুব পড়বে সাড়া। বাঁধবে যে হইচই।
হোক-না যতই হইচই আর শোরগোলটা ভারি
মনের দোরে লাগিয়ে তালা করছি খবরদারি।

খবরদারি করছে শকুন তেপান্তরে একা
একে-ওকে ডেকে-ডেকে দেখে হস্তরেখা।
মস্ত নদীর হস্তরেখায় পষ্ট অনেক কিছু –
খুব শিগগির কষ্টগুলো ছাড়বে যে তার পিছু।

কষ্ট তুমি হতভাগা। নষ্ট করো সুখ
তাই তোমাকে কেউ চায় না। ফিরিয়ে রাখে মুখ।
কেউ জানো কি অধীর নদীর মিষ্টি সে-ডাকনাম?
বৃষ্টি হেসে বলে জানি, নাম হল উদ্দাম।

খুব উদ্দাম ঈগলছানার দীঘল-দীঘল ডানা
ঝড়ঝঞ্ঝায় ডর নেই। তার ঘর যে আকাশখানা।
নীলাকাশের শহরজুড়ে তারাদের অন্দর
যেন কোনো চাতাল ছেয়ে জোনাকির বন্দর।

উথালপাথাল জোনাক-জ্বালা রাতের পাতাল খুঁড়ে
হীরের কুচি কে ছড়াল আঁধারচাদর জুড়ে?
কে পরাল পাথার জুড়ে জাফরি-কাটা জামা
আদরমাখা আলো-ছায়ার জোছনা-সাঁটা জামা।

জোছনাজামায় জংলা জমিন জমকালো ঝলমলে
জোনাক বলে, ‘দীপ জ্বেলে যাই আঁধার কাটার ছলে।’
ধাঁধার আঁধার কেটে গেলে আশার আলো হাসে
ফড়িঙ-প্রজাপতির ডানায়, লতাপাতায় ঘাসে।

ডাগর ঘাসের ডগায় ঘন রঙের আনাগোনা
কাঠবেড়ালি হয়ে লাফায় রোদের ছানাপোনা।
কাটুসকুটুস কাঠবেড়ালি কুটুম পাখির গাঁয়ে
চড়ুইভাতি করতে গেছে কড়ুই কাঠের নায়ে।  

চড়ুইগুলো মেতে আছে চড়ুইভাতি নিয়ে
সাধছে গলা। রাঁধছে পোলাও ধুলোবালি দিয়ে।
মটর-পোলাও ফিরনি পায়েস খেজুর গুড়ের ক্ষীর
ভাবলে জিভে  জল উছলে এসে করে ভিড়।

বিলের জলে আঁকা অঢেল ঝিলমিলে নীল ঢেউ
কই হারাল উধাও হল জানে না তো কেউ।
কই হারাল টেংরা পুঁটি খলসে কইয়ের ঝাঁক
তালের গাছে বাসায় বসে বাবুই পাখির ডাক?
  
বাবুই শালিক ময়না শ্যামা ফিঙে দোয়েল টিয়ে
কই হারালে একে-একে তোমরা ফাঁকি দিয়ে।
হারিয়ে গেছে ঢেঁকি শাকের থোকায় পোকার খেলা
ধোঁকা দিয়ে মিলিয়ে গেছে কুমড়ো ফুলের মেলা।

ধোঁকা তো নয় – অভিমানে লুকিয়ে ওরা আছে
কষ্ট শুধুই পেয়ে গেছে এই আমাদের কাছে।
আজ আমাদের ঢের আছে কাজ – হেঁয়ালি আর নয়
এসো আবার সবুজ জোয়ার ছড়াই পাড়াময়।

পাড়া গেরাম গঞ্জ শহর জাগবে সবুজ হয়ে
প্রাণ অফুরান সতেজতার বন্যা যাবে বয়ে।
সবুজ প্রাণের কাজ হল তো গুছিয়ে স্বপ্ন দেখা
সুখে-দুখে জীবনটাকে ভালবাসতে শেখা।

জীবন মানে দুঃখ-সুখের মুখর কলরব
প্রাণের টানে ছুটে চলার দারুণ অনুভব।
প্রাণের টানে পাহাড়চূড়ায় জয়ের নিশান ওড়ে
নাবিক ছোটে সাগরপানে আবিষ্কারের ঘোরে।

ঘোড়সওয়াররা মরুপথে হারায় পথের দিশে
ছোটার নেশা দমে না তাও ক্লান্তি-ভয়ের বিষে।
সিন্দাবাদের ভূতের ভয়ে থাকলে বসে ঘরে
হারকিউলিস যায় না হওয়া ঝঞ্ঝা এবং ঝড়ে।

ঝড়ঝঞ্ঝায় লড়তে-শেখা প্রাণে ছন্দ আনে
হাল না-ছাড়ার মন্ত্রে গাঁথা এই জীবনের মানে।
ঈগল বলে, ‘এসো তবে ধ’রে রেখে হাল
হতাশাকে হারিয়ে দিয়ে ওড়াই জয়ের পাল।‘  

আবার কবে দিগ্বিজয়ের হাওয়া লাগবে পালে
ময়ূরপঙ্খী নাও ছুটবে ঢেউয়ের তালে-তালে?
উতল তালে ঝলমলিয়ে প্রাণটা নেচে ওঠে
নদীর মতো অধীর হয়ে সাগর-খোঁজে ছোটে।

অতল জলের বহর বুকে সাগর আছে সুখে
সেই সুখ-সুখ গন্ধ শোঁকে নীলাকাশটা ঝুঁকে।
একবুক সুখ কিনতে লাগে একচিলতে আশা
আশার আলো পেখম মেলে পেলে ভালবাসা।  

আশা শেখায় – কীভাবে যায় লক্ষ্যে অটল থাকা
দুরন্ত পণ জিইয়ে রেখে জয়ের ছবি আঁকা।
এই এঁকেছি বৃষ্টিঝোরা শিসটি দিয়ে নামে
দুপুরি রোদ হারিয়ে গেছে হাজার মেঘের খামে।

আবেগি মেঘ টাপুরটুপুর ছন্দে ছড়া কাটে
ঘুমোয় ঘুঘু নাও সুপুরি সুদূরপুরের ঘাটে।
ঘাটের বাঁকে বিলি কাটে ঝরাপাতার দল
বিচুলি-খড় গড়িয়ে গিয়ে বাজায় ধুলোর মল।

শাদা ধুলোয় জড়িয়ে গেলে শিশির কয়েক ফোঁটা
গোধূলিরঙ ঝিকিয়ে ওঠে। ঝিকোয় গাঁদার বোঁটা।
দিঘির পাড়ে গাঁদার বোঁটা ছুঁইয়ে রাতের কালো
নেমে আসে। ঝিঁঝিঁ বলে, ‘জোনাক, জ্বালো আলো।’

আলুথালু আলো জ্বলে কালো জলের কোলে
গোলমেলে গোল! চাঁদ কি ওটা? ঢেউয়ের তালে দোলে।
ঢুলুঢুলু চোখে ঢেউরা চাঁদের শোলোক শোনে
ধল পহরের অপেক্ষাতে আর নামতা গোনে।

ধল পহরে শিমুল তুলো ঝলমলিয়ে হাসে
গহীন হাওয়ায় গাভীর মতো চড়ে দিঘির পাশে।
ছাড়িয়ে দিঘি দিগন্তে রোদ দাপিয়ে বেড়ায় রোজ  
ঘোর দুরন্তপনায় মাতে। করে সে কার খোঁজ?

ধুসর ধুলো কম দুরন্ত একটুও নয়
উছলে ওঠে হাওয়ায়। ছোটে পাথার পাড়াময়
পাড়ায়-পাড়ায় দুপুর আসে। বেনো বাতাস বেয়ে
খড়কুটোরা নেচে বেড়ায়। দিঘিতে নেয় নেয়ে।

যে-দুপুরে ফুপুর বাড়ি ঘুরতে টুপু এল
হঠাৎ বৃষ্টি ঝুমুরঝুমুর এল এলোমেলো।
এলোমেলো বৃষ্টি-ভেজা হয়ে জ্বরের ঘোরে
সে কী ভীষণ ভুগছে টুপু সাত-আট দিন ধ’রে।

বন্ধ টুপুর লেখাপড়া, ইশকুলে রোজ যাওয়া
ইচ্ছে হলেই তালপুকুরে যখন-তখন নাওয়া।
ঘরের ভেতর জানলা ঘেঁষে তাকিয়ে থাকে দূরে
মন শুধু চায় – গড়ের ঝোপে একটু আসি ঘুরে।

গড়ের ঝোপে আমের গাছে শালিক পাখির বাসা
পাঁচ-পাঁচটে ডিম পেরেছে। দেখতে ভীষণ খাসা।
ডিম ফুটে কি এত দিনে হল কোনো ছানা?
অনেকটা দিন পেরিয়ে গেল। হল না তো জানা।

লালি গাইয়ের লালু বাছুর টুপুকে না পেয়ে
সারাটা দিন তার জন্যে পথটা থাকে চেয়ে।
ফুপুর বাড়ি এসে টুপুর একি দশা হল!
সব মিলিয়ে একে-একে দিন পেরল ষোলো।

সেরে উঠে ফিরল টুপু এবার বাড়ি, তবে
ভুলেও সে আর বৃষ্টি-ভেজা কখনো না হবে।
বৃষ্টি তোমার সঙ্গে আমি দিলাম জনম-আড়ি
আর এসো না ঠাকুর দিঘির আমার খামার বাড়ি।

বটের জটায় বৃষ্টি-ছটা ফোঁটায়-ফোঁটায় জোটে
টলমলানো ঝলমলানো ফুলতোলা দুল ফোটে।
ঝলমলানো জামরুল জাম বেলি বকুল ফুল
রোদ-রুমালে কত্থক নাচ নাচে দোদুল দুল।

খুব নাচুনে নীল-নিকানো নীলাঞ্জনা পাখি
সাতসকালে গীতল সুরে করতে ডাকাডাকি।
ঘুম ভাঙত তোমার ডাকে তোমার গানে রোজ
ফুড়ুৎ-ফুড়ুৎ মেলতে ডানা এই এখানে রোজ।

ছুটোছুটি করতে ভীষণ উঠোনগুলো জুড়ে
সারাবেলা কাটিয়ে দিতে পাড়া ঘুরে-ঘুরে।
এখন তুমি কোথায় আছ – কেমন আছ তুমি?
তোমার কথা উঠলে ভীষণ কাঁদতে বসে রুমি।  

রুমি এখন ছোট্টটি নেই। বেশ হয়েছে বড়ো
ভূতের গল্প শুনলে ভয়ে হয় না জড়সড়।
আঁকতে পারে – গাছের ছবি উদাস নদীর তীর
নদীর তীরে ধান-কাউনের সবুজ মাঠের ভীড়।

সবজে মাঠে দাঁড়িয়ে আছে ঢ্যাঙা একটি গাছ
সেই গাছটা উজল ক’রে একটি পাখির নাচ।
অই পাখিটাই নীলাঞ্জনা হারিয়ে গেছে দূরে
আসবে কি আর ফিরে আবার রুমির গাঁয়ে উড়ে?

পাখি! পাখি! একলা পাখি! এসো আবার ফিরে
এসো ফিরে পাপড়ি পাড়ার কাশিকুড়ার তীরে।
তোমাকে রোজ সঙ্গে নিয়ে যাব মাঠের হাট
সারাবেলা ঘুরব শুধু মাঠ প্রান্তর ঘাট।

মাঠ-প্রান্তর জঙ্গল বন ঘুরে ক্লান্ত হলে
পরানপুরের হাটে আমরা ঠিক আসব চলে।
পরানপুরের হাটে কিনে খাব মুড়কি মুড়ি
ইচ্ছে হলে খেতে পারো সিঙ্গারা ও পুরি।  

খুব আমোদী ইচ্ছেনদী মনের মাঝে ছোটে
সেই নদীতে নিরবধি স্বপ্নশাপলা ফোটে।
ইচ্ছেশখের আল্পনাতে রাঙে ভাবনা ফুল
মনে ছড়ায় ভালোলাগার গন্ধশোভা অতুল।  

শোভনা মাছরাঙা স্বপ্ন দেখে থোকা-থোকা
ভাবনা গ’লে বেনো স্বপ্ন মনদোরে দেয় টোকা।
মনের দোরে নাচে আলোছায়ার পালকগুলো
ঝলমলানো শাদাকালো মায়ার পালকগুলো।

শাদা কালো নীল হলদে সবজে পাথরগুলো
ছড়িয়ে আছে পাথারজুড়ে জড়িয়ে ময়লাধুলো।
পাথরগুলো শিশির আদর মাখা হ্লুস্থুল
ভোমরা বলে, ‘অই পাথরেই ফোটাব তো ফুল।’