কবিতা লিখি কেমন ক’রে / অনিরুদ্ধ আলম
কবিতা লিখি কেমন ক’রে? – জানি না তা
আকাশি আলো সাজানো বেলা মেঘছাতা
বাতাসে ভেজা তোফা গন্ধ ছড়াল কে?
মনমগজে এসে ঢোকে।
রোদেলা শাড়িজুড়ে জড়ানো রঙের শতশত মেলা
ধান খুঁটতে ধানটুনির হেলাফেলা
তেপান্তরে রোদ-হাওয়ার লুটোপুটি
প্রজাপতির খুনসুটি
হেঁয়ালি চালে কাঠবেড়ালি ঘাসের দোরে অগোচরে
কী যেন খোঁজে। খয়েরি পাতা দীঘিশিয়রে ঝ’রে পড়ে।
এসব দেখে মনটা নাওয়া-খাওয়া ভোলে
ইচ্ছে মনে এসে দোলে –
কবিতা লিখি। কেমন ক’রে লিখব আমি? জানি না তা।
খুলতে থাকি মনখাতা
মনখাতাতে কাটতে থাকি আঁকিবুকি
জাফরিকাটা ভাবনাগুলো দেয় উঁকি।
মনখাতার ফরমা বাড়ে ধীরে-ধীরে
কল্পনারই আল্পনাতে নদীর কোনো রাঙা তীরে
একলা বসে ভাবি শুধু –
পাথারে বেনো জমি ধুধু
এই যে কাদা স্যাঁতসেতে
ধানের সোঁদা-সোঁদা ক্ষেতে
বাতাসি পাতা হেলেদুলে
নায়ের মতো পাল তুলে
কোথায় ছোটে দলেবলে
মাতিয়ে পাড়া কোলাহলে।
আমি যে ছেলে খুব ভুলো
শব্দ দিয়ে আঁকতে গিয়ে ছবিগুলো
হারিয়ে ফেলি কলমখাতা। কোথায় গেল পেনসিল?
এখানেই তো রেখেছিলাম। ছোঁ মেরে বুঝি নিল চিল!
পাই না খুঁজে সময়মতো এটা-ওটা
নিজেকে নিজে দেই খোটা –
আমাকে দিয়ে কবিতা লেখা হবে না বুঝি কোনো দিন!
মনের মাঝে লুকিয়ে-রাখা ইচ্ছেখানা উড্ডীন
হঠাৎ ক’রে চুপসে যেন যেতে থাকে।
তবুও মনে একটা কোণে এক ফাঁকে
কবিতা লিখি – ইচ্ছেখানা সলতে হয়ে আলো আঁকে
মনের ভাঁজে বাঁকে-বাঁকে।
কিন্তু আমি কবিতা লিখি কেমন করে? জানি না তা
ভাবি শুধুই – ভাবনাগুলো কী যে যাতা!
আবার খাতাকলম তুলে নেই হাতে
অঙ্ক কষে পর্বগুলো সাজিয়ে নিয়ে স্বরবৃত্ত মাত্রাতে
ইচ্ছেমতো লিখতে থাকি হিজিবিজি
বৃষ্টি নেই। একলা ঘরে ঘেমে-ঘেমেই খুব ভিজি।
কল্পলোকে আস্তে ক’রে দেই ডুব
ভাবতে থাকি খুবখুব –
পেরিয়ে গেছি তেপান্তর। মাঠের হাটে বসে আছি
দু’টো ভ্রমরা কাছাকাছি
গান শুনিয়ে নাচছে ঢের হেলেদুলে
গোছানো থোকাথোকা ফুলে।
নায়ের পালে লেগেছে হাওয়া। কোথায় যাবে? কোন দূরে?
জলের তোড়ে রোদচুমকি যায় ভেসে।
নদীর ঘাটে এসে-এসে
মাছরাঙাটা বেড়ায় শুধু ঘুরে-ঘুরে।
নদীর ঘাট পেরিয়ে গেলে গঙ্গাফড়িঙের বাড়ি
বাড়ির পাশে মেঠো পথটা আড়াআড়ি
মেঠো পথের ধুলোরা কী যে বাউন্ডুলে! জেনে রাখো।
সুরভি নদী ডাহুক ডিঙি শেফালি ঝোরা সাঁকো –
শব্দগুলো গূঢ় গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে এই মনে
চোখে ভাসছে ক্ষণে-ক্ষণে
শব্দগুলো ভুলের ফাঁদে না যেন আর পা বাড়ায়
আবার যেন না হারায়
খেরো খাতাতে চটজলদি টুকে রাখি
এবার তবে শব্দ দিয়ে মিল খোঁজাটা শুধু বাকি।
কিন্তু আমি খুঁজতে গিয়ে সব মিল
বুঝতে পারি এখানেও তো মুশকিল
মিল খোঁজাটা সহজ নয় বুঝে গেছি
শব্দ আর ধ্বনিতে মিল না বুঝেই তো খুঁজে গেছি।
কোথায় গেল ইরেজার?
মিল সাজাতে শব্দ কাটি বারবার।
ক্লান্তি মনে এসে জোটে –
কবিতা লিখি কেমন ক’রে? জানি না তা
এই আমি তো একলা বসে মেলে মনের শাদা খাতা।
কোথায় জানি মনের কোণে ছোট একটি ফুল ফোটে
সারাটা বেলা অন্তরে
কবিতা লিখি – ইচ্ছেখানা সে-ফুল হয়ে নড়েচড়ে।
হাত বাড়িয়ে সেল্ফটা থেকে মেলে ধরি –
জীবনানন্দ নজরুল। আবার খুঁটে-খুঁটে পড়ি
অন্ত্যমিলে কবিতাগুলো কী সুন্দর ঝিলমিল
কবিতাগুলো কী সুন্দর! আহা যেমন শাপলা-ফোটা কালো বিল!
কবিতাগুলো জমকালো
পড়তে গিয়ে মনটা খুব আলটপকা চমকাল।
কবিতাগুলো মিঠে ভারি
যেমন মিঠে জিলেপি পিঠে মায়ের হাতে রান্না-করা মাছের ঝোল তরকারি।
নিলাম পড়ে না-পড়া আল মাহমুদ
জাগল মনে ভালোলাগার অজানা কোনো বুদ্বুদ।
এবার আমি বুঝেছি খুব মিলের যত কারুকাজ –
কেমন ক’রে কবিতাজুড়ে মেলতে হয় মিলের অপূর্ব ভাঁজ।
খাতাটা টেনে নিয়ে আবার লেখাতে আমি দেই ডুব
বুঝেছি এক্ষণ খুব –
কবিতা লেখা আমার কাছে খুব কঠিন নয় আর
একটা ভালো কবিতা লিখে ফেলব ঠিক এইবার।
বুঝেছি আমি কবিতা হল – জোনাকিজামা ঝলমলে
কাঁঠালি চাঁপা। ছাতারে। টিয়ে। জংলা জলি। ছোপানো পোকা। দখিনা দিঘি টলমলে
কবিতা হল আদুরে পাড়া। শহুরে বাড়ি। রঙিয়া ঘুড়ি। চিলেকোঠা
আকাশে চাঁদ। চাঁদটা এক শাদা ফোঁটা।
কবিতা লিখে ভরাই খাতা নোটবুক
মনে ভীষণ তৃপ্তিমাখা এক সুখ
টেরটা পাই। কবিতা লেখা কঠিন বলে কিছু নয়
কবিতা নিয়ে যত-না ছিল সংশয়
সবটা কেটে গেছে তার
এখন আমি লিখতে গিয়ে খেই হারাব না তো আর।
সকাল শেষে বিকেল এল। সন্ধে করে আসি-আসি
কবিতা লিখি। মনটা ছুটে চলেছে দূরে অই বনের পাশাপাশি।
রাত্রি এল। ক্লান্তি এল। লেখার পালা হল শেষ
খোশ আবেশে মনটা নাচে। লাগছে আজ কী যে বেশ!
হঠাৎ মনে খটকা এল। লিখেছি যা যা একটুখানি পড়ে দেখি
পড়তে গিয়ে চমকে উঠি। ভাবি – সে কী!
সত্যি এ কি কোনো কবিতা হয়েছে নাকি? ভেবে মরি
আমার লেখা কবিতা ঘুরেফিরে পড়ি।
কোথায় যেন একটুখানি আমি যে খেই হারিয়েছি
বুঝে পাই না – কেমন ক’রে ভুল পথটা মাড়িয়েছি।
কবিতাজুড়ে বারেবারে
উপমাগুলো ব্যবহারে
হয়েছে কোনো ভুল বুঝি?
ভুলটা যে কী – বুঝি না কিছু। অভিধানটা হাতে নেই
কিন্তু আমি সে-ভুলগুলো পাই না খুঁজে কিছুতেই।
কেবলই সেগুলোকে খুঁজি।
ভাবতে থাকি – কবিতা লিখি কেমন ক’রে? বুঝি না তা
লিখব বলে যা ভাবি তার সবই যাতা?
আপন মনে কী যেন ভেবে কলম রেখে উঠে গিয়ে
নানান বই ঘাটতে থাকি সেল্ফটা থেকে হাতে নিয়ে।
পড়তে থাকি। শক্তি, জয় গোস্বামী
টেবিলটাতে আলত মেলে ধরি আমি।
পড়তে থাকি। পড়তে থাকি। পেরিয়ে যায় সারা রাত
মুগ্ধ আমি। কী সুন্দর লিখেছ ওরা। সহজ কথাশব্দে আহা বাজিমাত।
সহজ কথা খুব সহজে বলা কঠিন। সে-কাজটাই ঠিক আজ
করতে হবে। লিখতে গিয়ে বুঝতে হবে – সহজে-বলা কথার নানা কারুকাজ।
নতুন ক’রে আবার আমি কবিতা লেখা শুরু করি।
কবিতা লিখি। কবিতা লিখি। তার চে’ বেশি-বেশি পড়ি।
কবিতা লিখি পত্রিকাতে। ছাপা হয়েছে দু’টো বই
অনেকে বলে – ভালোই লেখো। যুগোপযোগী। জুতসই।
এখনো ভাবি, ‘কবিতা লিখি কেমন ক’রে?’ দিনে-রাতে
ভাবতে গিয়ে পড়তে থাকি। পড়তে থাকি। পড়া হয় এ অজুহাতে।