একটা ছোট অটোরিক্সা, সওয়ারি দুইজন আর একজন ড্রাইভার। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জার্নি। কিন্তু তারই মধ্যে শহরের ধুলো-বালি মেখে, খাল-বিল-নদী পেরিয়ে, জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে চলেছি আজ থেকে প্রায় তিন লক্ষ বছরের পুরানো এক প্রাচীন দুনিয়ায়। যেখানে দেবরাজ ইন্দ্রের পাপের ফলস্বরুপ, মা অহল্যাকে পাথর হয়ে কাটাতে হয়েছিল গোটা একটা যুগ। যেখানে ভগবান রামের আগমনে প্রকৃতি পেয়েছিল প্রান, দেবী অহল্যা পেয়েছিল শাঁপ থেকে মুক্তি। সপ্ত-ঋষির এক মহান ঋষি, মহর্ষি গৌতম মুনির আশ্রম। দেবাধিদেব মহাদেবের মন্দির, তার সাথে লাগোয়া দুটো ঘর, আর তার একটু দুরেই একটা গুহা। গুহাটি ছিল মহর্ষির ধ্যান, যোগ, তপষ্যার জায়গা। আমরা যখন পৌছালাম তখন ঘড়িতে রাত আটটা। কাবেরী নদী দিয়ে ঘেরা, ৭.২ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে, জনমানবশুন্য একটা পাহাড়ী হাইল্যান্ড। মানুষ বলতে একজন ব্রহ্মচারী, যিনি সংসারের সমস্ত মায়া কাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মহর্ষির চরণে। মন্দিরের চাতালে বসে, কাবেরীর বয়ে যাওয়া জলের অনবরত খলখল শব্দের সাথে, ব্রহ্মচারী মহারাজের মুখ থেকে আশ্রমের মাহাত্ম্য শুনতে শুনতে কখন-কিভাবে যে ভোর হয়ে গেল, তার বর্ণনা একটা আলাদা প্রসঙ্গ। ভোর পাঁচটায় শুরু হল প্রার্থনা-স্তব-গীত, চলল ছয়টা পর্যন্ত। তারপর কিছুক্ষন আশ্রমের চারিপাশটা ঘুরতে ঘুরতে পৌছালাম কাবেবীর কিনারায়। সূর্যের কোমল সোনালী আভা মেখে, কাবেরী যেনও কোনও নববধু রুপে সেজেছে। তার বয়ে চলার শব্দ এতটাই ছান্দিক, কেউ যেনও আপন মনে তবলা বাজিয়ে চলেছে। আর তার সাথে নানান পাখির কিচির-মিচির শব্দ, সবকিছু মিলেমিশে এককথায় সুন্দর। দুরে কতগুলো ময়ুরও দেখা যাচ্ছিলো। যতদুর চোখ চলে যায় সবুজ আর সবুজ, মানব সভ্যতার কোনও চিহ্ন আশেপাশে নাই। এই সবকিছুর মধ্যে একটা পাথরের মধ্যে একটু হেলান দিয়ে মাথাটা রাখতেই, চোখ দুটো যেনও ঢলে গেল। কিছুক্ষন পর পায়ের আঙুলে কিছু একটা অনুভব করলাম, চোখটা ফট্ করে খুলে গেল। দেখলাম বাদামী রঙের কতগুলো ছোটও পাখি পায়ে এসে ঠোকরাচ্ছে, আর মাথার সামনে দুটো ময়ুর। আর তার মধ্যে একটা আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। অচেনা এই আগন্তুকের হঠাৎ আগমন যেনও তাদেরকেও কিছুক্ষনের জন্য ভাবিয়ে তুলেছে, অবাক করে তুলেছে। তারপর ডানা মেলে আবার তারা হারিয়ে গেল তাদের সেই সুন্দরের খেলায়, সেই অপরুপ প্রানের খেলায়। আর তার সাক্ষী হিসেবে আমায় দিয়ে গেল একটা ছোট কবিতা "প্রানের খেলা"।
এ যেনও কোনও শব্দের খেলা, চলিছে অবিরাম,
পাতার মর্মরেতে, পাখিদের উড়ান।
বাতাশের হু-হু স্বরে, জলের খলখল,
সময়ের গাড়ি ছুটি, করি ঢং-ঢং।
এ যেনও কোনও সুরের খেলা, সপ্ত-সাগর পাড়,
দিনের মধ্যভাগে, অস্তরাগের তান।
মায়াজালে বন্দি হয়ে, বসি মহাকাল,
ভাবিছে কি লিখি, তারই শিরোনাম।
এ যেনও কোনও চোখের খেলা, করি টান-টান,
জাগিছে দিবা-নিশি, করিছে আহ্বান।
ফিরিছে পিছু-পিছু, সম্মুখ প্রান,
চারিপাশে তুলিছে গড়ি, প্রাচীর সমান।
এ যেনও কোনও প্রানের খেলা, চলিছে অবিরাম!!
এরপর কাবেবীর পুণ্যজলে স্নান, তারপর ব্রহ্মচারী মহারাজের সাথে আহারান্তে, সেই একই অটোরিক্সার ড্রাইভারকে ফোন্, আর তারপর ঘরে ফেরা।
জয় গুরু!!