আজ তোমার ইহকালের শেষ দিন
তোমায় অন্তিম বার দর্শনের দিন,
দিন তোমায় শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের।
তবে দিবসটি নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি একটু অন্যরকম
দিবসটি কেবলই তোমার দেহত্যাগের,
মনুষ্য শরীরের সীমাবদ্ধতা রক্ষার,
শুধুই তোমার কর্মচাঞ্চল্যের শারীরিক সমাপ্তির,
ইহলোকের বন্ধন মুক্তির,
অমরত্বের সূচনার।
তোমার আবির্ভাব ছিল শিল্পজগতে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ
তোমার জীবন যাপন ছিল শিল্পীসত্ত্বা অক্ষুন্ন রাখবার ব্রত পালন,
তোমার শিল্পচর্চা ছিল শিল্পকে আপনায় ধারণ করে,
তার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন,
তোমার পরিশ্রম ছিল শিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রেরণ,
তোমার শিল্পনিষ্ঠা ছিল মানব দক্ষতার নব্য সীমার নির্ধারণ,
তোমার শিল্পসম্পাদন ছিল শৈল্পিকতা প্রদর্শনে,
পারদর্শিতার অপরিহার্যতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ,
তোমার শৈল্পিক নিপুণতা ছিল শিল্পীপ্রতিভার নিমিত্ত,
শ্রদ্ধার প্রাপ্যতার প্রয়োজনীয়তার উদাহরণ,
তোমার শিল্পআনুগত্য ছিল শিল্প রক্ষায় শিল্পীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার,
অপরিহরণীয়তার মূল্যায়নের উপযুক্ততার নিদর্শন,
তোমার শিল্পপ্রেম ছিল শিল্পকে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রূপে,
অবলোকনের দৃষ্টিকোণের আগলায়ন।
তোমার ব্যক্তিত্ব ছিল মানবিক গুণাবলীর এক অভূতপূর্ব সমন্বয়
তুমি হয়ে উঠেছিলে কোমলতার প্রতীক,
সম্পর্ক বজায় রাখবার রক্ষাকবচ,
ছিলে বন্ধন দৃঢ় করবার প্রত্যয়ে আত্মত্যাগে বলীয়ান,
হয়ে উঠেছিলে প্রিয়জনদের নিকট বটবৃক্ষের ছায়া,
তোমার শিল্পানুরাগকে করেছিলে আপনজনদের,
সুন্দর জীবন প্রদানের এক গৌরবান্বিত মাধ্যম,
তুমি ছিলে আনুগত্যের প্রতিভূ,
তার প্রকাশ ছিল শিল্পের প্রতি তোমার অকুণ্ঠ ভালোবাসায়,
সেই ভালোবাসার মূর্তিমানতা ছিল কঠোর পরিশ্রম এবং অনুশীলনের,
যুগপৎ সঙ্গতিতে নিজ ক্ষমতা পরীক্ষণের প্রয়াসে,
তুমি হয়ে উঠেছিলে অহিংস প্রতিবাদী সত্ত্বার প্রতিনিধি,
তুমি বিজ্ঞ ছিলে আপত্তি প্রকাশের সময়োপযোগীতার বিষয়ে,
অসম্মতি প্রকাশের উচিত ভঙ্গিমা নির্ণয়ে,
বিদ্রোহ করবার সঠিক স্থান নির্ধারণে,
বিরোধিতা করবার নির্ভুলতার বিষয়ে,
অস্বীকৃতি প্রদানের ন্যায্যতার প্রশ্নে,
বর্জন করবার আবশ্যকতার বিষয়ে,
নারী জাগরণের পথিকৃৎ হবার উপযোগীতার প্রশ্নে।
তোমার শিল্পীগুণে তুমি হয়ে উঠেছিলে অনন্য
শিল্পগুণ বিচারে হয়ে উঠেছিলে মানদণ্ড,
শিল্পের প্রসারে হয়ে উঠেছিলে পথ নির্দেশক,
শিল্প জগতে হয়ে উঠেছিলে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার,
শিল্পের প্রতি সততায় হয়েছিলে বরেণ্য দেশমাতৃকার।
ব্যক্তিজীবনে তুমি ছিলে সাদাসিধে,
তোমার জীবনধারণ ছিল সাদামাটা,
সরলতা ছিল তোমার অলংকার,
শুভ্রতা ছিল তোমার বস্ত্রালংকার,
মুখাবয়ব ছিল দেবীত্বের আধার,
তোমার উপস্থিতিতে অনুভূত হত দেহনিঃসরিত জ্যোতির্ময়তার,
শিশুসুলভ আচরণে অনুভূত হত পরম আনন্দের।
তুমি কখনো মা হওনি
তথাপি তোমার মধ্যে ছিলনা স্নেহের কমতি,
মায়ার খামতি,
মমতার ঘাটতি,
জৈবিকভাবে হয়ত তুমি জননী হওনি,
কিন্তু মাতৃত্বের স্বাদ তুমি ঠিকই গ্রহণ করতে জানতে,
জানতে মাতৃত্ব প্রকাশ করতে,
সন্তানের মত ভালোবাসতে,
ভরসায় আগলে রাখতে,
পরম যত্নে লালন করতে।
দৈহিকভাবে মাতৃরূপে তোমার আবির্ভাব হয়নি বলে,
হয়ত অনেকেই বলবে তুমি অসম্পূর্ণ,
তোমার নারী দেহ অপূর্ণ,
তোমার মনুষ্য জীবন ব্যর্থ,
পরন্তু তোমার কর্মগুণে তুমি সম্পূর্ণ,
কর্মকৃতিত্বে তুমি পূর্ণ,
কর্মকৌশলে তুমি সার্থক,
তোমার অংশেরও নিঃশেষ হত,
তথাপি তোমার কর্মফল অনিঃশেষ,
তোমার অংশেরও মৃত্যু হত,
তথাপি কর্মগুণে তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী।
হয়ত তোমার তথাকথিত বংশ নেই
কিন্তু তোমার কর্মই তোমার বংশধর,
তোমার গুণই তোমার বংশপরম্পরার ধারক,
তোমার শিল্পীসত্ত্বার অর্জনই তোমার বংশমর্যাদার বাহক,
তোমার প্রতিষ্ঠাই তোমার মরণোত্তর স্মৃতিচারণার চালক।
আপাতদৃষ্টিতে তুমি সংসারী হওনি
কারো অর্ধাঙ্গিনী হওনি,
হওনি কারো ঘরের লক্ষ্মী,
কারো প্রিয়তমা,
কোন এক জনের জীবনের চালিকাশক্তি,
কিন্তু কৃতিত্ব দ্বারা তুমি হয়ে উঠেছিলে এক বৃহৎ সংসারের লক্ষ্মী,
জগত সংসারে সংসারী,
এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ভালোবাসার দাবীদার,
উন্মোচন করেছিলে একটি শিল্পের প্রচারের দ্বার,
চালিকাশক্তি হয়েছিলে সেই শিল্প সংশ্লিষ্ট সকলের নিষ্ঠার,
প্রিয়তমা হয়েছিলে সেই শিল্প সংযুক্ত কলা-কুশলীদের।
আজ তোমার বর্ণাঢ্য জীবনের শেষ দিন
তোমার মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সমাপ্তির দিন,
দিন তোমার অন্তিম যাত্রার প্রারম্ভের,
আজ সবাই শোকাহত তোমার বিদায়বেলায়,
শোকে বিহ্বল তোমার নিস্তব্ধতায়,
সবার নয়ন অস্রুশিক্ত তোমার নিশ্চুপতায়,
এ সবই তোমার প্রাপ্তি,
তোমার কাজের স্বীকৃতি,
তোমার অমরত্বের প্রাপ্যতার,
তুমি সমৃদ্ধ করেছিলে পৃথিবীকে,
গর্বিত করেছিলে মাতৃভূমিকে,
তোমার প্রবেশে এবার পরলোকও সমৃদ্ধ হবে,
বিশুদ্ধ হবে স্বর্গলোক তোমার পবিত্রতায়,
মুগ্ধ হবে স্বর্গবাসী তোমার প্রাণচঞ্চলতায়,
সুখের নিবাস হবে সুরলোক তোমার ভালোবাসায়।