আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দু পায়ে খুশির ঘুঙুর পরে ঘুরছে খুকু। কি তার ছোটাছুটি লাফালাফি। কাঁধ গড়িয়ে টেপের ফিতে বারবার পড়ে যাওয়া আর ব্যাস্ততার ফাঁকে হাত তুলে যথাস্থানে তা রাখার নমুনা দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে আজ কিছু একটা হতে চলছে। সেই পেয়ারা গাছের ছায়ায় খোলা জানলাটার যেখানে খুকুর খুশির সখের সংসার পাতা থাকে সেখানেই সব ব্যস্ততা উপছে পড়ছে আজ। পাতান সারি সারি সুখসারির পুতুলের সংসার। তাদের বাবা মা মাসি পিসি কাকু জেঠু ভাই বোন নিয়ে একান্নবর্তীর সংসারের একমাত্র চালিকা শক্তি ঐ খুকু। জানলায় পেরেক পুতে দড়ি টানিয়ে অত জনের জামা কাপড় শুকতে দেওয়া, পরিবারে অত জনের রান্নার হাঁড়িকুড়ি বাসনপত্র সব থরে থরে সাজান জানলার থাকে থাকে। এ জগতে খুকুর অনুমতি ছাড়া কারোর প্রবেশ নিষিদ্ধ। একটা চুলের কাঁটাও এদিক থেকে ওদিক করার জো নেই। খুকি আজ চুলে শ্যাম্পু করে ,গায়ে সাবান মেখে চান করে সুন্দর জামা পড়ে কানে ছোট্ট দুল পরে, নখপালিশ শুকিয়ে সবে একটু বসেছে মার কাছে আলতা পড়বে বলে। পড়েওছে। ডান পায়ের পাতায় আলতার টিপটা পড়ার পর ই খুশির আকাশে কোথা থেকে উড়ে এল কালো মেঘ। আজ রথের মেলায় খুকির যাওয়া হবে না। যে বড় মা’র হাত ধরে যাবার কথা, তার বাড়িতে কে যেন আসবে। ব্যাস। খুকুর সব দুঃখ উজাড় হয়ে চোখের প্রান্তে হাজির। ওমন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা দিনটা শুধু বিকেলের জন্য। কখন রথের মেলায় যাবে বড়মা’র হাত ধরে। টসটস চোখে খুকু সেই যে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়েছে তারপর থেকে শুধু কেঁদেই চলেছে অঝোরে। কোন কিছু দিয়েই বাগে আনতে পারছে না মা। মা বলছে আমি নিয়ে যাব তোকে। তাও হবে না। ঐ বড়মা’ই চাই। সঙ্গে বড়মার মেয়ে পারুল কে চাই। নামজাদা জেদের জন্য ঝুঁটি ধরে দিয়েছেও টান মা দু-এক বার। সে ত থামেই নি বরং মারের অজুহাতে ঐ কাজল কালো চোখ কাজলে জলে মাখামাখি করে ফেলেছে। সব শেষে বড়মা কে রাজি করান হয়েছে। ঘন্টা খানেকের জন্য যাবে। এ খবর পেতে খুকুর খুশি কে দেখে। আল্হাদে আটখানা খুকু। যাই হোক, যথাসময় বিকেল হল। বড়মাও এলেন। খুকু পারুল বড়মার দুহাতে আর খানিক বড় দাদা একটু পরে বা একটু আগে চলল রথের মেলায়।
--------- সেই সময়ের মেলা ত নয় যেন খুশির হাট। সবাই পসরা সাজিয়ে খুশি বেচছে। প্রত্যেকের বাঁশ তেরপল দিয়ে প্রায় শুয়ে পড়া দোকানে হরেকরকম মাল। পাপড়, জিলিপি, মাটির পুতুল, কাঁচের চুড়ি, কাঠের খেলনা, রান্নার বাসনপত্র আরো কত কত কি সব সেই মেলার চারধারে। পাপড়ের দোকানের সামনে ইয়াব্বড় একটা মডেল পাপড়, জিলিপির দোকান নের সামনে মস্ত প্যাঁচালো প্যাঁচানো একটা জিলিপি। কোথায় শুরু কোথায় শেষ খুঁজতে হচ্ছে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। খুকু দেখে আর অবাক হয়। ঘুরতে ঘুরতে আসে কৃষ্ঞনগরের মাটির দোকানের সামনে। এমন আম, আঙুর নারকোল সব যেন এক্ষুনি গাছ থেকে নামিয়ে এনে রাখা রয়েছে। শুধু কামড় বসানর অপেক্ষা। খুকু আঁচল ধরে টানাটানি। বড়মা দাম জিজ্ঞাসা কর না? দশ টাকা। খুকুর বুকে জমা হয় দশটাকার মত কষ্ট। ঘুরতে ঘুরতে অন্য মাটির পুতুলের দোকানে। মুখ ধ্যাবড়ান গোপাল সবে নীল রঙে চুবিয়ে বেচতে বসেছে। বুদ্ধদেবে ধ্যানরত অবস্থায় চোখ মুখ নাক সব এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। রাধা কৃষ্ণ বেঁকেচুড়ে একসা। কুলোর ওপর লক্ষ্মী ও তাঁর প্যাঁচা অর্থাভাবে বিমর্ষ। বাবা বলতেন ঐসব মাটির ঢিপি। ঘরে নিয়ে এসে ঘরভর্তি করিস না। কিন্তু খুকু ত ওতেই মজে। দশটাকার দুঃখ চেপে বড়মার আঁচল আঙুলে পেচিয়ে চার টাকায় নীলকান্ত গোপাল আর কুলকুলীন লক্ষ্মী জোড়া পছন্দ করে নিয়ে যাবেই। ওদিকে বড়মার রথের দড়ি টানার দেরী হয়ে যাচ্ছে । পারুল, খুকু, দাদা আর বড়মা সেই ভিড়ের মধ্যে দড়ি টেনে স্বর্গ লাভ করবে বড়মার ইচ্ছে। বড়মা সবথেকে বড় ও শক্তিশালী। বড়মা দড়ি ধরছে। আমরা বড়মাকে ধরেছি। বড়মা আমাদের ও ধরেছে ভিড়ে যাতে না হারিয়ে যাই। একহাতে দড়ি একহাতে আমরা। খুকুর এক হাত দাদার হাতে এক হাত পারুলের হাতে। দড়ি অবধি যাচ্ছে না কারোর দুটো হাত। কারো পুরো স্বর্গ লাভ হচ্ছে না। শেষে বড়মা রণে ভঙ্গ দিয়ে অর্দ্ধেক স্বর্গলাভ নিশ্চিত করে ভিড়ে চিড়ে চ্যাপটা হয়ে ওখান থেকে বের হয়। তখনও ভোলে নি ভ’বি। সেই সদ্যোজাত গোপাল ও লক্ষ্মী দুকোলে নিয়ে কৃষ্ঞনগরের পুতুলের দিকে চাইতে চাইতে পাপড়ের দোকানের দিকে এগিয়ে চলে। হাতে একটা বড় পাপড় কিনে খুকু চলল খুশি মনে বাড়ির পথে। কিন্তু বিধি বাম। ওত ভিড়ে ওমনি পাপড় তেমনি থাকে? মেলা থেকে বেড়বার পর দুটো আঙুলের ফাঁকে একটুকরো পাপড় ধরা বাকিটা ঝুরঝুর হয়ে গুড়োগুড়ো হয়ে মেলার মাটিতে মিশে যায়। বাড়ি এসে খুকুর চোখ টলমল। অত্ত খুশির মুখ কি করে ওমন টলমলে হলরে খুকু? মা বোঝে। আচ্ছা বাবা আমি ভেজে দিচ্ছি। ওমন ছিচকাঁদুনের মত কাঁদিস না ত। মা ভেজে নিয়ে এল গরম পাপড়। না ----এটা দোকানের মত নয়। আবার কান্না। ভাল তেলে ঘরে ভাজার স্বাদ যে ওমন কিছুতেই হবে না রে খুকু। খুকু ও বুঝবে না। তেলেভাজা দোকান শুরুর সময় যে তেল ঢালা হয়েছিল সেই তেলে তেল ঢেলে তেলেভাজার বংশপরস্পরা ব্যবসার পাক্কা পাপড় কোনদিন কোনোমতে ঘরের মত হবে না। মা বোঝে। খুকু কে বোঝায়। কিন্তু খুকু জানলার দিকে মুখ ফিরে অন্ধকারে খুশি খুঁজতেই থাকে।
-------------আজ খুকু মা হয়েছে। সেই জানলাটা আজ নেই। শুধু আছে সেই ছোট্টবেলার রথের মেলার স্মৃতি আর জানলার বাইরে কালো রঙের অন্ধকার। সেই অন্ধকারে নির্মল আনন্দের খোঁজ টা আজও একই রকম আছে। শুধু মাঝখান থেকে বয়ে গেছে বেশ কটা বছর। খুকু বড় হতে পারে নি। খুকু বড় হতে চায় না।