পৃথিবীর সমস্ত ক্লেদাক্ত দুঃখ ভুলে
একবুক উচ্ছ্বসিত হৃদয় দিয়ে সমুদ্র দেখতে গিয়ে
আমি বিতাড়িত হই গোধূলিলগ্ন নরম সূর্যাস্তের কাছে!
সমুদ্র আমাকে খুব টানে; আপন নদীর মতো নিঃশব্দে
আগলে রাখে!

নীল সমুদ্রের তর্জন দেখে আমি দ্রোহের কবিতা
আবৃত্তি করি। সূর্যঘড়ির চক্রে সমুদ্রের সফেদ
মায়াভরা রৌদ্রস্নাত উন্মাতাল উচ্ছলতাকে আমি
হৃদয় দিয়ে আনন্দমেখে উদযাপন করি!
সামুদ্রিক মাছের বৃষ্টিস্নাত জলকেলি আর
জোৎস্নাভরা রাতের নীল ঢেউয়ের গর্জন
আমাকে আহ্বান করে নিবিড়ভাবে!
চিত্তাকর্ষশক্তির ন্যায় মন্ত্রমুগ্ধের ঘন্টাধ্বনি
বাজিয়ে ফের কাছে টানে; যতোটা কাছে
আমাকে সুশোভিত সুপরাক্রমশালী পাহাড়ও টানে না।

পাহাড় জানে আমি তাকে রোজ বহন করে
হাঁটি একটু একটু! পাহাড় ভাবে আমি তার
সমসাময়িক সকল দুঃখের একটার পর একটা
সুবিশাল স্তূপ;
আর আমিও ভঙ্গুর, ভস্ম, ভগ্নহৃদয় দিয়ে
পাহাড়কে ভালোবাসার অধিকার রাখি না!
কারণ আমি জানি পাহাড় কখনো ভগ্নদশাকে
তার শক্ত, সুকঠিন হৃদয়ে স্থানবন্দি করে না।
পাহাড় মানুষকে গাম্ভীর্যের সঙ্গে অনুভবের
পেরেক হতে শেখায়; যাচিত কষ্টের গোপন
দেয়াল হতে শেখায়; মানুষকে তার মতো মজবুত
পাথুরে পার্বত্যহৃদয় গড়ে দেওয়ার অপ্রিয় শিক্ষা দেয়!

যে হৃদয়ে দুঃখ থাকলেও দুঃখের অনুভূতি নেই,
কষ্ট থাকলেও কষ্টের আকার-আকৃতি নেই,
কান্না থাকলেও চোখের অশ্রু নেই, পাতাশোভিত
সুনির্মল স্নিগ্ধ গাছের পাতাঝরা দুঃখময় যাতনা নেই,
স্বপ্ন ভেঙে গেলে শিহরণ নেই। গল্প ফুরিয়ে এলে
দীর্ঘশ্বাস নেই, কবিতা শেষ হলে ঢের আপসোস নেই;
সাজানো সৌকুমার্য কাঁচের গ্লাস টুকরো টুকরো হয়ে
ভেঙে গেলে- ভেঙে যাওয়ার সাড়াশব্দ নেই।
প্রায় মরে যাওয়া পরিযায়ী পাখির ঠোঁটে বিরহবিধুর
মায়াকান্নার অবশিষ্ট বাক্য নেই। অকস্মাৎ নিজেকে ধ্বংসের মেঠোপথে হারিয়ে ফেলার এটুকু
হৃদয়ের জমিনে কোনো টর্নেডো বা ভূমিকম্প নেই!

এজন্য আমি নিজের ভেতর প্রসবিত পাহাড়কে
ঠেলেঠুলে আর অকৃত্রিম সত্যিকারের পাহাড়ের
কাছে যাইনি! কিন্তু; আমি সূর্যাস্তের বিমোহিত
ডুবে যাওয়ার সময়েও তার কাছাকাছি থেকেছি।
আমি দেখেছি সূর্যাস্ত আমাকে তার নীলাভ লাল
রঙের ছোঁয়ায় আদর মেখে মেখে সাথে রাখে,
আমি পাখির পালকে বসে ডুবে যাওয়া সূর্যের
শেষ মুক্তাঝরা হাসিতে নিষ্পাপ নির্মলতা দেখেছি!
আমি সারি সারি ঝাউবনের আবডালে দাঁড়িয়ে শেষ
ডুবে যাওয়া সূর্যের চোখেমুখে বিস্মিত বিষাদ দেখেছি,
অন্ধকারের পাকস্থলীতে গিলে ফেলা সূর্যাস্তের হাহাকার
আর আত্মচিৎকারের ক্লান্তি দেখেছি!

অস্তমিত সূর্য আমাকে কানেকানে শোনায় সংক্ষিপ্ত জীবনের এক অন্তিমতার গল্প। সারাবেলার উচ্ছল উৎপলা উর্বশীর চোখে রোদের জলকেলি খেলে
সময়ের শেষ অনুচ্ছেদে নীরবে নিশ্চল মায়া রাঙিয়ে
চলে যাওয়ার কবিতা শোনায়! আমার কাছে এসে
বিদায়বেলার লালিমাখচিত রঙ মেখে বিষাদের চরম
বিলাপধ্বনি পাঠ করে শোনায়।

আর আমি হাহাকার নিয়ে শুনি একটা একটা
গান, কবিতা, গল্প। আমি অস্তমিত সূর্যটার
শেষ চেহারায় তাকালে আমাকে দেখি!
একটা নিশ্চুপ ভাঁড় হা-হুতাশ আমি হয়ে
তাকিয়ে থাকি নরম সূর্যাস্তের দিকে।

এতাবৎ আমি চেয়েছি গোধূলির পায়ে বসে
একবার সমুদ্র আর সূর্যাস্তকে একসাথে দেখি।
সমুদ্রের কোলে বসে সূর্যাস্তকে; আর
সূর্যাস্তের দেশে দাঁড়িয়ে নিবিড় সমুদ্রকে!
আমি চেয়েছি আমি ভুলে যাই সমুদ্র আর সূর্যাস্তের
দুই পৃথিবীসম বিচ্ছেদের বিস্তৃত ফারাক।
ভুলে যাই গোধূলির আলোমাখা উপেক্ষিত সমুদ্রের
কাছে নির্বাসিত সূর্যের তালাকনামা;
ভুলে যাই সূর্য'যে সমুদ্রকে সেই কবেই ত্যাগ করেছে!
তখন থেকে আমি ডুবে যাওয়া রক্তিম সূর্যাস্ত
আর সমুদ্র আমার হারিয়ে যাওয়া নিরীহ অতীত!