শীতের রাতে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা; তামাম শহর যেন এক বিশাল শ্বেতচাদরে ঢাকা গোলাপের কলি! হৃদয়ের প্রতিটি শ্বাসে হালকা শীতল বাতাস; আমি সেই বাতাসের সঙ্গে ভাসি নিঃস্ব হয়ে! পৃথিবীর এই নিঃসঙ্গ পথে— প্রতিটি মুছে যাওয়া পায়ের চিহ্নের মতো আমি হারিয়ে গেছি! এই পৃথিবী এক অসীম খালি বাগান, যেখানে ফুলগুলো শুকিয়ে যায়; আর আমি সেই অবশিষ্ট শুকনো ডাল —যেখানে কোনো পাখি গান গায় না!

দুর্মর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ভাঙা মন আরও ভেঙেচুরে যায়, অতলে তলিয়ে যায় পাপীর বীভৎস মুখ! মাটির রক্তের মতো বয়ে যায় কোমল বেদনার অশ্রু! গাছের পাতায় প্রতিধ্বনিত অশ্রু আকাশের মেঘের কান্নার মতো নীরবে ডুকরে কাঁদে— শোকাবহ সুরে! পর্বতচূড়ায় বিষণ্ণ বাতাস থেকে আসে উড়ন্ত মেঘের গুঞ্জন, বৃষ্টি এসে মুছে পৃথিবীর ধুলো! গুনাহের অগ্নিতাপে হৃদয় এক বিরাট সাগর, যেখানে ঢেউয়ের বদলে শুধু পাপীর হাহাকার ভেসে আসে! আর পৃথিবী? সে শোনে; কিন্তু নিঃশব্দে থাকে!

চোখের নীলে ফুটে উঠা ছায়াবীথি নক্ষত্রে ঘন অন্ধকার, আকাশের কালো ছায়ায় খুঁজি আমার নীচু মাথা; তোমার স্নেহের চাঁদ কি আমায় আলোকিত করবে? আলোর মশাল পাবার মতো কিংবা বিরান বাগানে একটি ফুলের মতো তৃষ্ণা নিয়ে অশ্বত্থ গাছের নীচে গিয়ে দেখি তোমার পথ চিরসত্য; আমি ভুলপথে! দিলের উঠোনে যতটুকু আলো ছিলো –তা এখন কেবল পাখির ছায়ার মতো ম্লান!
তুমি যদি দয়া না করো তবে কোথায় পাব মুক্তির পথ?

নীল জমিনের ক্ষতচিহ্নে শুকনো মাটির শোক! অন্ধকারের কোলে –এই কুয়াশার নীচে এক পাথরের হৃদয় কাঁদছে,
তুমি কি শোনো? আমার হৃদয় এখন তোমার কাছে—
বিশ্বের সবকিছু থেকে দূরে এই জায়নামাজের এককোণে! আত্মসমর্পণের একটি পাখির মতো প্রতিটি শ্বাসে তোমার
দয়া চেয়ে কাঁপছি! শীতল বাতাসের মতো আছড়ে পড়ে যাচিত অশ্রু! তাপিত অশ্রুতে ডুবে যায় পৃথিবীর চির শান্ত কোমল নদীনালা, পর্বত, পাহাড়!

প্রতিটি শীতের রাতের মতো, প্রতিটি ঝরাপাতার মতো
আমি নত হয়ে পড়ি তোমার দরবারে! আকাশের অতলে ফেরেশতাদের পাখা কাঁপানো শব্দের মৌন সঙ্গীত আমার তাওবার পরে! দূরে ঊষার সফেদ আলোর মতো হালকা রোশনি আমার হৃদয়ে-- যতটা দূরে, যেন ততটাই কাছে!
যদি তুমি এই অধমের অন্ধকারে একরাশ আলো হও; তবে আমি তোমার করুণার এক নদী হয়ে বহে যাব! তোমার রহমতের জোয়ারে তবে আমি বালির দানার মতো ভেসে যাব মহাকাল!

বিশাল আকাশের নীচে —তবু আমি এক পাপী;
হৃদয়ের নদী থেকে বইছে মেঘের স্ফুটিত বেদনা! প্রভুর
প্রেমে মত্ত যে ব্রজপথিকের একসময় স্নিগ্ধ এক সরল পথ ছিলো, আজ তার সেই পথই অজানা! বিশাল সাগরে লুকনো দুঃখ তুমি তো জানো! এ পৃথিবী যেন মোর দহন;
তোমার কাছে পলায়ন— তবুও তোমার করুণার আশায় বাঁচি! জলপ্রপাতের মতো তোমার রহমতের এ ধরায় যতটা পথ নিজের মতো হেঁটেছি ততটাই অন্ধকার! আমি এখন তোমার পথে হাঁটতে চাই।

আমার তৃষ্ণা; এ অন্তহীন বিরহ!
সুন্দর বসন্তের মতো তোমার রহমতের সুধা চেয়ে আমি তোমার দ্বারে দ্বারে কাঁদছি! তোমার মায়ামুগ্ধ করুণায় গুনাহের সকল রক্তাক্ত চিহ্ন মুছতে— আরও একটি রাতে; আরও একটি সকালে —আল্লাহর কাছে যখন ফিরে আসা হয় না, নিস্তব্ধ রাতের অনুশোচনায় তখন দু-চোখে জল গড়ায়! অবিনশ্বর শূন্যতায় শরীর যেন দাঁড়িয়ে থাকে মধ্যরাতের জায়নামাজে, পাপীর পদচিহ্নে!
যতবার থেমে যায় প্রার্থনা, ততবার চোখে জল!

আল্লাহর পথ ভুলে যে পথিক ভূলোক-দ্যূলোক ভেদে দূরে বহুদূর হেঁটে চলে যায়, তার ফিরে আসার আত্মসমর্পিত দিনে পিছনে ফিরে তাকানো যেন এক স্বচ্ছ হিমশীতল ভোরের চোখের মতো সুন্দর!