মাঝরাত্তিরে বিদঘুটে বীভৎসতম অন্ধকারে,
অদূরের কোনো এক শ্মশানের অষ্টেপৃষ্ঠে
নিজেকে আবিষ্কার করি একাকী। এক ক্লেশিত
উদ্ভট নিঃসঙ্গতার চাদরে– কি অপূর্ব শরতের পথঘাট!

নয়-দশ কদম পা বাড়ালে দুইদিকে উনিশ শতকের
মাঝামাঝি গড়ে উঠা পুরাতন কতক মানব সম্প্রদায়ের
অনাড়ম্বর খোলাবসতি; কিন্তু কোথাও কেউ নেই!
এদের অপূর্ব সাংস্কৃতিক-প্রথাপূর্ণ ফাঁকা উঠোন থেকে
ভেসে আসে নিঃসঙ্গচর ভয়ার্ত একটি কুকুরের মরা
কুশ্রী শব্দ! অনুভূতির খরা হৃদয় দিয়ে শুনি; মায়াভরা
মৌনতা দিয়ে শুনি।

স্থবির হৃদয়ের খালি উঠানে জীর্ণ কুকুরের
এই বিকটতম শব্দ ছাড়া চারপাশে কোনো শব্দের
টুঁশব্দও নেই! শব্দ নয়— হয়তো ক্ষত নিঃসঙ্গতার
চিৎকারধ্বনি! কুশ্রী বলা যাবে না; ডিপ্রেশনের
মাত্রাতিরিক্ত বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া।
হয়তো ক্লান্ত কন্ঠের বিকৃত ভয়াল সুর!

আচ্ছা, তাবৎ মহাবিশ্বে মানুষের মতো কুকুরও কি
নিঃসঙ্গ একা? তারাও কি দিনশেষে নিঃসঙ্গ মানুষের মতো
একা হয়ে বাঁচে? নাকি দিনের আলোয় দলবেঁধে হাঁটলেও তারা আজন্ম ভেতর ভেতর এক অবিশ্বাস্য একা!

তাদেরও ক্ষুধা হয়, মানুষের মতো অসুস্থতা অনুভব হয়,
তাদেরও পঙ্গুত্ব হয় কোনো এক উচ্ছিষ্ট খাবার আহারের অহেতুক দায়ে! সঙ্গীবিচ্ছেদে মারাত্মক নিঃসঙ্গ হয়!
কুকুরেরও যে একটা নির্মল, শোভিত, স্নিগ্ধ প্রাণ আছে
এতাবৎ বিশ্বে কেউ অনুভূতি দিয়ে বোঝে? সুষম
খাদ্যাভ্যাসের জাতাঁকলে হৃষ্টপুষ্ট মানুষদের জানা নেই
কুকুর যে অবহেলিত উচ্ছিষ্ট খাবার খায়!

কখনো অস্বাস্থ্যকর, দূর্গন্ধযুক্ত খাবার খেয়ে ঢলে পড়ে
নির্মম মৃত্যুর মুখে; খাদ্যাভাবে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায় নির্মমভাবে! শুকিয়ে হয় চরম রুগ্ন, রুক্ষ! নির্বাসিত হয় মানুষের বসতভিটার দ্বারে দ্বারে! কেবল ভাষাপ্রকাশের শব্দ ছাড়া তাদেরও যে দুঃখ পোষার অনুভূতি কিংবা কষ্ট পাবার অসীম হৃদয়যন্ত্রণা হয়, কেউ কি খুব একটা ভাবে?
ভাবতে চায়?

তাদের একাকীত্বের ভার একটা শহরও বহন করে না!
কারণ তারা মানবেতিহাসের অবিমিশ্র ঘৃণা!
হীনতম, নির্বাসিত, নিগৃহীত, অবলা নির্ভাষীচরিত্র;
তারাও মানুষের মতো নিঃসঙ্গ!
নিঃসঙ্গ মানুষের মতো অবহেলিত!
নিঃসঙ্গ পৃথিবীর মতো একা!
নিঃসঙ্গ চাঁদের ঝলসানো রুটির মতো
বিস্বাদ, বিষাক্ত, বিমূর্ত, বিদগ্ধ!
আমি হাহাকার দেখেছি কুকুরের চোখে মুখে দীর্ঘশ্বাসে!
আমি অবহেলা দেখেছি কুকুরের অস্তিত্বের ধূমজালে!
তাবৎ পৃথিবীতে কুকুরের হাহাকার নিবারণের জন্য প্রয়োজন সভ্যতার মায়া আর মানবিক প্রেমের শহর!

কুকুরের হাহাকার ঘুচলে সৃষ্টিকর্তা মানুষের হাহাকার রোধ করবেন; সৃষ্টজীবের প্রতি দয়া করলে সৃষ্টিকর্তা তাঁর প্রতি দয়া করেন— নয়তো মানুষও হবে আধুনিক শহরের নির্বাসিত নিজের ভেতর যুগযুগান্তর বয়ে বেড়ানো নির্মম হাহাকার,
এক চরম সংকট গেয়ে বেড়ানো মানবেতর হাহাকার!