আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি
তখন, ভয় পেলে মায়ের আঁচলে লুকানোর;
অথবা, দৌড়ে বাবার পাশে দাঁড়ানোর;
বাবাকে পাশে পেলে,
বুকের ছাতি তিরিশ ইঞ্চি হয়ে যাওয়ার বয়স আমার।

সেই একাত্তরে -
ডিসেম্বরে, একদিন
দেখতে পাই -
চারপাশের মানুষজন ছুটোছুটি করছে;
কেউ কেউ চিৎকার চেঁচামেচি করছে;
কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে,
"পাক বাহিনী ঢুকেছে গ্রামে।"

আমি মাকে খুঁজি; কিন্তু কোথাও দেখতে পাই না।
তারপর ক্রসফায়ারের মত একটানা গুলির শব্দ।
আমার মনে নেই গোঙ্গানির শব্দ শুনেছিলাম কিনা!
বড় যারা তারা মুক্তির যুদ্ধে গিয়েছিলো,
কেউ ছিলো ঘরছাড়া।
পাক বাহিনী সেদিন, আটই ডিসেম্বরে, ভবেরচরে
দশ জন কিশোরকে গুলি করে হত্যা করে।
অতঃপর, রাতের আঁধারে;
চাচী-ফুপী, প্রতিবেশী খালা, অশীতিপর বৃদ্ধের
গ্রাম ছেড়ে আরও গভীর গ্রামে পলায়ন।

ক্ষেতের আইলের ওপর দিয়ে,
পাড়ার রাস্তা ধরে; যেতে যেতে
আমি দেখি যুদ্ধের আগুনে পুড়ে যাওয়া
ঘর-বাড়ী-গোয়ালঘর;
নাকে লাগে, কৃষকের গোলাভর্তি ধান-পোড়া গন্ধ!
মনে লাগে কষ্টের আঁচড় !

এরপর দেশ স্বাধীন হলো -
সারা দেশে  খুশির বন্যা বয়ে গেলো।
পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে-গঞ্জে,
শহরে-বন্দরে, মসজিদে-মন্দিরে
বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা উড়লো পতপত শব্দে।
তারপর থেকে বছর বছর ঘুরে আসে বিজয়ের মাস।

স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে -
এখনও বকুলের মায়ের আর্তচিৎকার থামেনি!
শহীদ ছেলের জন্য তাঁর বুকের ভিতর
শোকের পাথর ধিকি ধিকি জ্বলে!
বিডিআরএর ল্যান্সনায়েক মোস্তাফিজুর রহমান
একাত্তরে, কোন এক এপ্রিলে -  
দিনাজপুরের দশমাইল গ্রামে আত্মাহুতি দিয়েছিল!
সাতচল্লিশ বছর পরে-  
মোস্তাফিজুরের হাড়গোড় পাওয়া যায় কোন এক কবরে!

আমি দেখি বিমানবাহিনীর ৭১০৬৭ নম্বরধারী
বৃদ্ধ অফিসারকে; মুক্তিযোদ্ধা, এই নব্বই বছরেও ঋজুদেহ।
যুদ্ধের পর সাতাশ বছর ছিলেন দেশান্তরে,
রেমিট্যান্স যোদ্ধা হয়ে;
ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী, অকুতোভয়।
তার দৃপ্ত উচ্চারণে উদ্দীপ্ত শব্দঃ 'আল্লাহু আকবার', 'আল্লাহ মালিক'!

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ অনুভব করেছি -
বরগুনা পাথরঘাটার হোগলাপাশা গ্রামের হাসি রানী অধিকারী,
ঝিনাইদহের কাঞ্চননগরের জয়গুন নেছা, কালিগঞ্জের ফাতেমা বেগম, নেত্রকোণার কলমাকান্দার রোকিয়া খাতুন, নাটোরের তপেজান,
এরূপ আরও শত বীরাঙ্গনার কষ্টক্লীষ্ট জীবনে।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু যুদ্ধের তাপ অনুভব করি -
যখন দেখি রাজাকারের ছেলেরা স্বাধীনতার পতাকা হাতে
মিছিলের অগ্রভাগে চিৎকার করে এগিয়ে যায়;
কিংবা চায়ের দোকানে চা খেয়ে,
দোকানীকে পয়সা না দিয়ে বীরদর্পে হেঁটে যায়!
যখন দেখি রাজশাহীর শহীদ রিপোর্টার সাঈদের ছেলে -
চা দোকানী বাবুল নামে সবাই যাকে চেনে;
সে কনকনে শীতার্ত রাতেও
শিরোইল বাস টার্মিনালের সামনের ফুটপাতে
চা বিক্রি করে সংসারের খরচ মেটায়;
তখন, বিজয়ের মাসে, আমি মুক্তিযুদ্ধের তাপ অনুভব করি।
২১ ডিসেম্বর ২০১৯