শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত । হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে ।
যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ
জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে । হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে ।
আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি ।
আম্মা বলেছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক
কত রাত তো অমনি থাকিস ।
আমার ঘুম পেলো । এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি
নিহত হয়ে থাকলাম ।
অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না । ফরহাদ
আধ ঘণ্টা আগেই ষ্টেশনে পৌঁছে যায় । লাইলী
মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায় । নাহার
কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না ।
আর আমি এদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে এসে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত ষ্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি ।
কুয়াশার সাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো ।
শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে । চোখের পাতায়
শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ
লাল সূর্য উঠে আসবে । পরাজিতের মতো আমার মুখের ওপর রোদ
নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী । ছড়ানো ছিটানো
ঘরবাড়ি, গ্রাম । জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে । তারপর
দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা ।
কলার ছোট বাগান ।
দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে । বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান ...।
বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন ।
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা । তুই না থাকলে
ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায় । হাত মুখ
ধুয়ে আয় । নাস্তা পাঠাই।
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে
ঘষে ঘষে
তুলে ফেলবো ।
(কাব্যগ্রন্থ : সোনালি কাবিন । প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর ১৯৭৩ ।)