মৌনব্রত
অরুণ কারফা

ওর সঙ্গে ছিলনা মুখ দেখা দেখি পর্যন্ত
অনেকটাই, মহাজাগতিক পিণ্ডের মত,
যেমন, রাতের শেষে ভোর হলে
সূর্য উঠলে
                 চন্দ্রমুখীর কানে মন্ত্রণা জুগিয়ে
                 সূর্যমুখীর প্রাণে যন্ত্রণা কমিয়ে
নতুন দিনকে স্বাগত জানাতে
নির্দ্বিধায় হয় শশাঙ্ক গত।

এই ভাবেই চলে দিনের পর দিন,
                   সূর্য উঠলেও তেলে বেগুনে জ্বলে
                    ভ্রুক্ষেপ নেই চাঁদের তা বলে,
পরাক্রমশালীকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অন্ধ গলিতে পড়ে সে ঢলে
                     বুকে নিয়ে নিঃশব্দে ক্ষত  
আর, জেদী মনে পুষে মৌনব্রত।

আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কবি আলতাফ হোসেন এর নিম্নোক্ত মন্তব্যটি এখানে হুবহু দিয়ে দিলাম এক সুন্দর বিশ্লেষণের উদাহরণ তুলে ধরতে...

অরুণ কারফা 'মৌনব্রত' কবিতাটি একটি নীরব প্রতিরোধ এবং অভিমানী মৌনতাকে কেন্দ্র করে রচিত। কবি সূর্য ও চাঁদের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে জীবনের একটি গভীর এবং মানসিক বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। এখানে চাঁদ এবং সূর্য একটি প্রতীকী দম্পতি, যেখানে চাঁদের মৌনব্রত এবং সূর্যের উজ্জ্বলতা এই সম্পর্কের মিথ্যাচার এবং অন্তর্দাহের পরিচায়ক।

"মহাজাগতিক পিণ্ডের মত" এই লাইনটি থেকে সূর্য ও চাঁদের অবস্থানের মাধ্যমে একটি সম্পর্কের বৈপরীত্য ফুটে উঠেছে। সূর্য এখানে প্রভাবশালী, পরাক্রমশালী, এবং উদ্ভাসিত, আর চাঁদ হলো নিরব, নিজস্ব কষ্টে ভোগা একটি প্রতীক। সূর্যের "চন্দ্রমুখীর কানে মন্ত্রণা জুগিয়ে" এবং "সূর্যমুখীর প্রাণে যন্ত্রণা কমিয়ে" এর মধ্যে সূর্যের উজ্জ্বলতার অধীনে থাকা যন্ত্রণাগ্রস্ত চাঁদের অবস্থা প্রতিফলিত হয়েছে। এই মিথস্ক্রিয়া জীবনের একপাক্ষিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে একজন সবসময় প্রভাব বিস্তার করে এবং অন্যজন নিজেকে ধ্বংস করে মৌনব্রতের মাধ্যমে।

"জেদী মনে পুষে মৌনব্রত" লাইনটি চাঁদের অব্যক্ত প্রতিবাদের ইঙ্গিত দেয়। চাঁদ এখানে সরাসরি কিছু না বললেও, নিজের অভিমান এবং যন্ত্রণাকে বুকের মধ্যে ধারণ করে আছে। এই মৌনব্রত শুধুমাত্র নীরবতা নয়, বরং নিজস্ব এক ধরনের অভিমানী জেদ, যা তার অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধের প্রতীক। এই মৌনতা জীবনের সেই মুহূর্তগুলির প্রতিনিধিত্ব করে, যখন মানুষ কোনো উত্তরে না গিয়ে নীরবতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে এবং তার মধ্য দিয়ে নিজের কষ্ট ও বেদনা প্রকাশ করে।

"এভাবেই দিনের পর দিন" লাইনটি আমাদের বোঝায় যে এই প্রক্রিয়াটি শুধু একদিনের নয়, বরং এটি সময়ের সঙ্গে চলতে থাকে। চাঁদ তার নিরব কষ্টে ভোগে, আর সূর্য তার উজ্জ্বলতায় বেঁচে থাকে। এই ক্রমাগত চলার মধ্যে রয়েছে জীবনের চিরন্তন দ্বন্দ্ব, যেখানে একটি সম্পর্ক বা পরিস্থিতি একপাক্ষিক থাকে, আর অপরপক্ষ নীরব যন্ত্রণা ভোগ করে।

"বুকে নিয়ে নিঃশব্দে ক্ষত"—এখানে চাঁদের যন্ত্রণা এবং ক্ষতকে তুলে ধরা হয়েছে, যা বাইরে থেকে অদৃশ্য কিন্তু ভেতরে ভেতরে দগ্ধমান। এটি মানুষের সেই অভ্যন্তরীণ কষ্টের চিত্র, যা বাইরে থেকে দেখা যায় না কিন্তু অন্তরে গভীরভাবে বসে থাকে। চাঁদের অন্ধ গলিতে পড়ে থাকা এবং ক্ষত বয়ে চলা একধরনের আত্মসমর্পণ ও অভিমানী প্রতিবাদ।

'মৌনব্রত' একটি নীরব অভিমানের প্রতিচ্ছবি, যেখানে চাঁদ তার যন্ত্রণার মাধ্যমে নিজের প্রতিরোধ তৈরি করে। কবিতাটি সূর্য ও চাঁদের প্রতীকের মাধ্যমে জীবনের একপাক্ষিক সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ কষ্টের চিত্রায়ন করে। সূর্যের প্রখর আলোতে চাঁদের অভিমান এবং নীরব প্রতিবাদ অব্যক্ত থাকলেও, এর ভেতরে এক গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে। কবিতাটি পাঠককে সম্পর্কের জটিলতা এবং অভ্যন্তরীণ নীরব সংগ্রাম নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে, যা মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।