বাবার ক্যান্সার। গলায় ব্যান্ডেজ, ব্যান্ডেজে রক্ত।
এগারোটি থেরাপিতে চুল সাফ। চামড়ায় কালো দাগ। বিদেশে নিয়ে
ভালো ডাক্তার দেখালে হতো। টাকা কোথায়...

বউকে ডেকে জানতে চাই- ‘কী করতে পারি?’
বউ বলে- ‘যা ভালো মনেহয় করো।’ বাবা যখন যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে,
চিংড়ি মাছের মতো দলা পাকিয়ে যায়, বড়ো মায়া হয়।
সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িটা বেচে দেবো। কিন্তু, বউ সন্তান নিয়ে
থাকবো কোথায়! এদিকে বাবার মৃত্যু যন্ত্রণা, ওদিকে একমাত্র ছেলেকে
অকুল সাগরে ফেলা।
চিকিৎসার অভাবে বাবা মরলে লোকে বলবে- ‘কেমন ছেলে!
বিনাচিকিৎসায় বাবাকে মারলো।’ বাড়ি ভিটা বেচে দিলে
কুৎসা রটবে- ‘কেমন বাপ! সন্তানের কথা ভাবলো না!’

অসুস্থ বাপ বাড়ি বিক্রির গুঞ্জন শুনে বলেছিলো- ‘আমি আর কদিন!
তোরা সুখে থাক বাবা, নাতিটার খেয়াল রাখিস।’
কার খেয়াল রাখবো, নাতিটার? নাকি অসুস্থ বাবার? ভাবতে ভাবতে
কাচের গ্লাসে বেলের শরবতে চামচ নাড়ছিলাম।
হাত পা কাঁপছে, মুখ ঘামছে। শরবতে তিন ফোটা বিষ
মিশিয়ে দিয়েছি আমি। তীব্র বিষ, মুখে নিলে মৃত্যু।
মনে পড়লো ছোট বেলায় ম্যালেরিয়া জ্বরে
সতেরো দিন ছিলাম হাসপাতালে। চিকিৎসার খরচ যোগাতে
বাবা তার প্রিয় মোটরসাইকেলটি বেচে দিয়েছিলো।
কই... একবারও তো বিষমাখা চকলেট খাইয়ে
মেরে ফেলার কথা ভাবেনি। হাতের চামচ থেমে গেলো।
বাবার বানানো বাড়ি ভিটা বেচেই বাবাকে বাঁচাবো।
পরক্ষণে মনে পড়লো ছেলের
পড়াশোনা, বউয়ের আবদার, সংসারের নানা খরচ।

বেলের শরবতে বিষ। না... বাবার হাতে কিছুতেই
বিষের গ্লাস ধরিয়ে দিতে পারবো না।
বাবা কতো স্নেহে মানুষ করেছে আমাকে। শহরে রেখে
শিক্ষিত করেছে, মোটা অঙ্কের ঘুষে চাকরি জুটিয়েছে, তার হাতে
তুলে দেবো বিষের গ্লাস!
বিষমিশ্রিত শরবত পিরিচে ঢেকে বাবার বিছানার পাশে রেখে
চলে গেলাম দূর। যেন কিছুই জানি না, জানতেও চাই না।
যেন বাড়ি থেকে পালাতে পারলেই বাঁচি, এমনকি পৃথিবী থেকেও...

আমার ছেলেটা গিয়েছিলো বাবাকে ঔষধ খাওয়াতে।
রোগীর পথ্য আপেল কমলা আঙুরের বেশি অংশ
নাতিকে সস্নেহে খেতে দিতো বাবা, আজ দিলো শরবত ভরা গ্লাস।
নাতি এক চুমুক মুখে নিয়েই মেঝেতে ঢলে পড়লো। তারপর...
বাবা বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, ছেলে মেঝেতে
পড়ে আছে নিস্তেজ। কী করবো! হায়... কোনদিকে যাবো আমি...!

❑❑❑
কবিতা : দুটানায় দিনযাপন
কবি : আকিব শিকদার
কাব্যগ্রন্থ : দৃষ্টি মেলো জন্মান্ধ চোখ (২০২৩)