আমি তো বৃষ্টির দেশের লোক, কদমের দেশের লোক
নৌকা-লাঙল, নদী-মাঠ-খাল, সবুজের দেশের লোক।
তোমাদের মাঝে আমি তো বিলীন। ধান ক্ষেতের আগাছা যেমন
লোকচক্ষুর আড়ালে মূল্যহীন বাঁচে, উজানে ওঠা মাছের মতো
পড়ে আছি চোরাফাঁদে আটকা বিদেশ-বিভুঁইয়ে।
দূরদেশে পড়ে আছি জীবিকার সন্ধানে। পেটের দায়ে মেখে দেই
তোমাদের তেলানো মাথায় তেল, গতর খাটি, দোকানে
বানাই রুটি, ঝাড়ু দেই রাস্তা। যেন অন্যের ভিটায় লাউ চাষ করছি
যত্নে বেঁধে বাঁশের মাচান।

আমার বাবা একজন পুরুষ্ট ধানের শিষ দেখে
কাতর কৃষক, নদীচরে গরু চরানো রাখাল।
আমার মা একজন আনাজ চাষী, মরিচ পোড়া ঝালে
লালশাক রাধা গৃহিণী। আমার ভাই একজন...
আজও আমার বধুর বাঁকা ঠোঁটে কাক তাড়ানো সুর
কানে বাজে। চোখ বুঁজলেই দেখি
গলা-উঁচু রাজহাঁসেদের পিছু ছুটা একটা শিশু- আমার সন্তান।

আমি তো এসেছি ফেলে কাদা খুচে মাছ ধরা, নৌকার গলুইয়ে বসে
জল ছোঁড়া ভালোবাসা, পাট-পঁচা গন্ধ ভরা ডোবা। কচুক্ষেতের পাশে
খড়ের গাদায় রঙিন ছবি তোলার আনন্দ।
আমি তো এসেছি ফেলে পানের বরজ, ঘুঘু ডাকা আম-বন
লাল মাটির দেশে পদ্মফোটা ঝিল, ঝিমধরা বাঁশের তেপান্তরে
বনমোরগের ঝাঁক। আমি তো এসেছি ফেলে
পড়ার ঘরের পাশে ফুলের বাগান, পুকুরের ঘাটে নুয়ে থাকা
সৈয়দী পেয়ারার ডাল। সুপারি বাগানে বাঁধা কালো গাভীটা।

আমাদের কলাক্ষেতে সবুজ পাতার ভীড়ে
ঝড় ওঠে কোনদিন, কোনদিন খেলা করে তুমুল আলোর জোছনা।
আমাদের জীবনের অলিতে গলিতে
সুখ এসে হাসি দেয়, দুঃখ রেখে যায় দু’ফোটা চোখের জল।
যে রাতজাগা পাখির অশুভ ডাকে বেড়ে যায়
আমার শিশুর অসুখ, যে বন্য শ্বাপদের নখের আঘাতে
নষ্ট হয় আমাদের আশার ফসল, যে অন্ধ দানবের
রগচটা গুংড়ানো শুনে শংকাচ্ছন্ন আমার স্বজনেরা
তাকে গ্রামছাড়া করতেই আমার এ বিদেশ-যাপন।

ওগো ভিনদেশি, ওগো অচেনা মানুষ। তোমাদের দেশে আমি
নিঃসঙ্গ যন্ত্রণাকাতর, বেঁচে আছি যেন ধান ক্ষেতের বদ্ধ জলে
লেজপঁচা তিতপুটির একাকি রক্তসাতার।
ভীষণ দারিদ্রে পড়ে তোমাদের তল্লাটে
বাড়িয়েছি হাত, ফেলছি গায়ের ঘাম। বড়ই এতিম আমি
অকুল সাগরে ভাসি দলছুট মাছ।

★★★
কবিতা : বিদেশ যাপন
কবি : আকিব শিকদার
কাব্যগ্রন্থ : জ্বালাই মশাল মানবমনে (২০১৮)