সেদিন বাহিরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো,
ওরা যখন নীল গাড়ীতে তুলছিলো আমাকে,
শরীরের অর্ধেকটা ভিজে জবজবে ছিলো,
বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার শীতল জলে,
ওখান থেকে সোজা শ্রীঘরের মেঝেতে,
অশ্রুসিক্ত নয়নে ওখানে বসে ভাবি আর কাঁদি,
কাঁদি আর ভাবি আমার অসুস্থ শিশু পুত্রটির কথা,
অশুভ যতো চিন্তা আমায় দিশেহারা করে ছিলো সেদিন।
ভুলটা ছিলো আমারই, ধরা পড়তে হলো পুলিশের হাতে;
হাত জোড় করে করুণ মিনতি করেছি,
'আজ ছেড়ে দেন গো দারোগা বাবু,
একটা পয়সাও রোজগার করিনি আজ,
ঘরে আমার বাচ্চাটার খুবই অসুখ,
তাকে কে দেখবে গো দারোগা বাবু?'
কে শুনে কার কথা, ওরা যে নির্দয় প্রকৃতির মানুষ;
ওরা বুঝতেই চায় না আমাদেরও একটা জীবন আছে!
পেটে ক্ষুধা আছে, আবার কারো কারো সংসার;
ওদের চেতনায় একটুও বোধোদয় নেই,
আমরা যে এই নিষ্ঠুর সমাজের মানুষেরই অবদান,
মেরে ফেলো আমাদের, বিছিয়ে দাও সারি সারি লাশ;
সিটি কর্পোরেশনের কুকুর মারার মতো মেরে ফেলো,
আর নয়তো বাঁচতে দাও, বাঁচার মতো।
আমি কামিনী বলছি, রমনা পার্কের কামিনী;
তোমরা অনেকেই চেনো আমাকে দেহের প্রয়োজনে।
একদিন যে শিশুটি জন্মে ছিলো তার মায়ের কোলে,
মায়ের চোখে ছিলো কতোইনা স্বপ্ন,
সন্তান তার অনেক বড় হবে, সুন্দর সংসার হবে;
হয়েও ছিলো ছোট্ট একটা সংসার,
কিন্তু বিধাতাও সেদিন করে ছিলো বিংশ শতাব্দীর নির্মম পরিহাস,
ফলে অন্তরা চৌধুরী হয়ে ছিলো আজকের কামিনী।
চোখের তারায় স্বপ্ন নিয়ে আর দশটা নারীর মতো
আমিও গেলাম বধূর বেশে স্বামীর ঘরে,
স্বামী হলো, স্বামীর ঘরে সংসারও হলো;
পৃথিবী আলো করে একটি শিশু পুত্রও এলো,
সুখে দুঃখে ভালোই কেটে যাচ্ছিলো আমার জীবন।
সুখ যে কপালে সয় না সেটাও বুঝতে পারলাম,
যখন স্বামী ফিরতো মাতাল হয়ে,
হঠাৎ এক নিশি রাতে স্বামী ফিরলো চরম মাতাল হয়ে,
সাথে ছিলো তার বিকৃত চেহারার মাতাল বন্ধু,
সেই রাতেই যা হবার তাই হলো,
নির্মম নির্যাতনে স্বামী আমায় বাধ্য করলো
পর পুরুষকে দেহ দানে, আমি হলাম ধর্ষিতা;
কিযে লজ্জা আর কিযে ঘৃণার জন্ম হলো,
আমার আহত অন্তর গহিনে, কাউকেই বলতে পাড়িনি তা;
তীরবিদ্ধ পাখির মতো কেবলি মনে হয়েছে,
আমি হারালাম, আমি সব হারালাম।
সেই থেকে শুরু প্রতি রাতের ধর্ষিতা জীবন,
একেক রাতে একেক রকম হায়েনার হিংস্র থাবা,
আমাকে খাবলে খাবলে গ্রাস করতো,
কতো যে কষ্ট আর কতো যে মনের যন্ত্রণা
মুখ বুঝে সবই সহ্য করেছি,
শিশু পুত্রটিই ছিলো তার একমাত্র কারণ,
প্রতিটি নিস্তব্ধ রাতে নীরবে নিভৃতে
নীড় ভাঙ্গা পাখির মতো ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি,
হয়েছি অনেক পুরুষের দেহ পসারিণী।
প্রলয় যখন আসে মানুষের দুয়ারে
তখন সব কিছু ধ্বংস করে বেদখল করে দিয়ে যায়,
এক রাতের অন্ধকারে স্বামী আমার
পালিয়ে গেলো সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে,
সাথে নিয়ে জমানো সব টাকা পয়সা গহনা।
এক দিন যায়, দুই দিন যায়, অনেক দিন যায়;
সে আর ফিরলো না তো ফিরলোই না,
সেদিন বজ্রাঘাতে খণ্ডিত হয়ে ছিলো আমার আকাশ,
কোথায় যাবো, কি খাবো, কিভাবে হবে শূন্যতা পূরণ?
প্রতিটি মুহূর্ত ভাবিয়ে ছিলো আমায়,
মা বাবা তারাও যে ছিলো না এই পৃথিবীতে,
পথে পথে আর মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরেছি,
ছোট্ট একটি কাজের আশায়,
সেদিন কোথাও খুঁজে পাইনি বেঁচে থাকার ঠিকানা।
অবশেষে ঠাঁই মিললো এক বড় সাহেবের ঘরে,
বিবি ছিলো সহজ সরল আত্মভোলা এক নারী,
আর সাহেব ছিলো সেই দলেরই হারামি এক পুরুষ,
তার লোলুপ দৃষ্টি আমাকে একটুও রেহাই দেয়নি,
কারণে অকারণে বিবিকে পাঠাতো তার বাপের বাড়ি,
আর আমি হতাম তার প্রতি রাতের দেহ পসারিণী।
এই ভাবে গোপনে আর কতো দিন?
একদিন তো ধরা পড়তেই হবে, তাই হয়েছিলো;
কিযে ঘৃণা আর কিযে অপমান মাথায় নিয়ে
ঘুণে ধরা এই নিষ্ঠুর সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে
আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে অজানার পথে,
হারাতে হয়েছে বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়টুকুও।
সেদিনও বাহিরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো,
যেদিন আমি কামিনীর পথ বেছে নিয়েছি,
শিশুর জ্বালা আর পেটের ক্ষুধা,
আমাকে বানিয়েছে আজকের কামিনী,
পচে যাওয়া এই নিষ্ঠুর সমাজ
আমাকে দিতে পারেনি সুস্থ কোন ঠিকানা,
দিতে পারেনি একটু সুখের বাতাস,
নষ্ট কষ্ট বুকে নিয়ে আজো আমি পথ চলি,
আর ভাবি প্রথম জীবনের রঙিন স্বপ্নগুলোর কথা,
যে স্বপ্ন হারিয়ে গেছে নিষিদ্ধ রাতের অন্ধকারের খেলায়,
কামিনী ফুলের মতোই ঝরে গেছে বহু পুরুষের থাবায়,
আজো সেই স্বপ্নগুলো হৃদয় গহিনে ডুকরে কাঁদে
ক্ষণে ক্ষণেই আমার চোখে বৃষ্টি হয়ে ঝরে।