নেরুদা কবিতা লিখতেন পরম আগ্রাসে। একটা উদাহরণ দিই – ‘পূর্ণ নারী টসটসে আপেল, গরম চাঁদ, সমুদ্র শ্যাওলা, বিচূর্ণ কর্দম আর আলোর ঘন বর্ণে, কোন অস্পষ্ট উজ্জ্বলতা খুলে দেয় তোমার স্তম্ভদ্বয়ের মধ্যে? কোন প্রাচীন আঁধার স্পর্শ করে, একটি মানুষ তার বোধ দিয়ে? ভালোবাসা জল ও নক্ষত্রের সঙ্গে ভ্রমণ, ধোঁয়াশা বাতাস এবং হঠাৎ গোধূমচূর্ণের সঙ্গে ভালোবাসা হল একটি সংঘর্ষ বজ্র-বিদ্যুৎ আর দুটি শরীরের সঙ্গে যা পরাজিত হয় এক ফোঁটা মধুর মাধুরীতে।’। উফফ! আর পারা যায় না!!!
সবাই বলে কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি। আমি কিন্তু কাজীর মত প্রেমিক কবি খুব দেখেছি। প্রেমের কবিতায় খুব বেশী হামবড়া শব্দের বাগাড়ম্বর নেই। একদম সাদামাটা ছন্দে নজরুলকে পেয়েছি আমি। যেমন – ‘বাঁশীটি মন করলে চুরি, ভাংলে বুকে প্রেমের চুরি, অবলা বলে ভুলালে, ছলে পরালে গলে প্রেমের ফাঁসি’। যথার্থ প্রেমের কবিতা আর কি? শুধু প্রেমিকাকে ভালোবেসে কাজীসাহেব দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেন!!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রেমের কবিতা লিখতে গেলে কি করতে হবে? জাস্ট প্রেমিক বনে যাও। হাঃ হাঃ হাঃ। প্রেমিক কে? এইখানে বিপাশা কি বলে একটু শুনি। ‘যে ভালো ভালো কথা বলে, গান গায়, মিষ্টি করে হাসে, নাকি বাজে কথা বলে লোক কে হাসায় নিজে হাসে, বিপদে আপদে পাশে থাকে! অথবা যে চুপটি করে শুধু কথা শোনে ভিড়ের মাঝে তোমায় খোঁজে, মাঝে মধ্যে হারিয়ে যায় নতুন করে পাওয়ার আশায়? প্রেমিক হতে গেলে, আগে প্রেমে পড়তে হবে।ভোর বেলা শিশির ভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে হবে। নদীর কুল কুল করে বয়ে যাওয়ার সাথে, নিজেকেও ভাসিয়ে দিতে হবে। বর্ষায় ভেজা, সোঁদা মাটির ঘ্রাণ নিতে হবে। হঠাৎ করে দমকা হাওয়ায় খুলে যাওয়া জানালার কাছে দাঁড়িয়ে, ঝড়ের সাথে মনটাকে উড়িয়ে দিতে হবে। আর গলা ছেড়ে বলতে হবে- “ভালবাসি ভালবাসি। শুধু তোমায় ভালবাসি!”
যাই হোক, প্রথমেই বলেছিলাম রবিঠাকুরকে টানবো না। প্রেমপর্যায়ের কবিতাগুলি তো প্রেমের মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু আমি সেই মানুষটাকে চেনাতে চাই যিনি ছিলেন প্রেমিক কবিগুরুর অনুপ্রেরণা। আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪). আধুনিক বাংলা কাব্যে ইউরোপীয় রোমান্টিক বৈশিষ্ট্যের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। জীবন ও জগতের প্রতি বীতরাগ, প্রকৃতির প্রতি প্রেম, সংসারধর্মে অনীহা কল্পনাধর্মিতা তাঁর কাব্যের বিষয়। স্বীয় জীবনভাবনায় অপরিমেয় আস্থাসমৃদ্ধ ইউরোপীয় রোমান্টিক জীবনচেতনাকে বাংলা কাব্যে তিনিই প্রথম প্রয়োগ করেন। মূলত তাঁর দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
আপাতত শেষ করছি নন্দন কবি আহসান হাবীবের কবিতা দিয়ে। আদ্যপান্ত প্রেমের কবি ছিলেন আহসান হাবীব। আহসান হাবীবের প্রেমের কবিতায় গড়ে উঠেছে প্রেমের ঐশ্বর্য, অতিন্দ্রীয় বোধ, না পাওয়ার বেদনা ও অস্থিরতা। দেখা যাক পড়ে তিনি কেমন লেখেন – ‘‘আমার একটাই গন্তব্য ছিল, তুমি। তোমারও গন্তব্য আছে তাই, বারবার তোমাকে হারাই। ভুল পথে কান্ত হই, নিজের অজ্ঞাতে বারবার, নিজের দরজায় এসে দাঁড়াই এবং আমার একটাই গন্তব্য থাকে, তুমি।’ কি লিখব? সুপার্ব! কম হবে না তো?
শেষ করতে চাচ্ছি একটা কথা বলেই। প্রেম আছে, তাই কবিতা আছে। কবিতা আছে তাই প্রেম অমর। প্রবাদ বা কিংবদন্তিতুল্য কিছু কিছু বাক্য এমন আছে, যেগুলো বলনে-শ্রবণে শীর্ণপ্রায় হয়ে গেছে। থেঁতলে যাওয়া শরীরের মতো দর্শনকটু বা খসখসে অমসৃণ ত্বকের মতো হয়ে গেছে তাদের রূপ। সেসব বাক্যের একটি হলো ‘প্রেম আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর।’ ব্যবহারবাহুল্যে বাক্যটি শ্রুতিশীর্ণ হলেও অন্তঃরহস্যে বাক্যটি এখনও টানটান উত্তেজনা নিয়ে বিদ্যমান। প্রয়োগক্ষেত্রের পেলবতায় বাক্যটি একটু মূর্ছা গেলেও আভিজাত্য ও আন্তঃলাবণ্যে জীবন্ত তরুণ। কবিতায় প্রেমের দু’টি পরিভাষা বেশ পরিচিত— প্রকৃত প্রেম ও রূপক প্রেম। রূপক প্রেমের অঙ্গনে প্রেমের সেসব উপাদান আসবে, যা মানবসত্তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আর প্রকৃত প্রেম মানে একজন বান্দার সঙ্গে আল্লাহ অথবা ঈশ্বরের নিবিড়তম সম্পর্কসূত্র সৃষ্টি হওয়া। অথবা বলা যায়, আমাদের চর্মচক্ষুর আড়ালে অথচ নিকটতম স্থানে (গ্রীবাস্থিত ধমনীতে) আসন পেতে থাকা সত্তার সঙ্গে যে প্রেমের সম্পর্ক, সেটাই হলো প্রকৃত প্রেম আর তাঁকে কেন্দ্র করেই রচিত হয় প্রেমের কবিতা অথবা কবিতায় প্রেম।