কবিতায় প্রেম। প্রথমে শব্দদুটি লিখলাম, বেশ কিছুক্ষন দেখলাম, তারপর মুচকি হাসলাম। হাসি এল। আসলে হাসবার কারন আর কিছুই নয়, শব্দদুটি লিখে মনে হল প্রেম ছাড়া আবার কবিতা হয় নাকি? যদি বল কি, তাহলে বলতেই পারো – অপ্রেম। আরে বাবা! তাতেও তো প্রেম শব্দটা রয়েছে। যদি বল বিরহ – তবে তাতেও আছে প্রেম, বিচ্ছেদের প্রেম। আসলে প্রেম মানে তো আকর্ষন, প্রেম মানে তো টান, প্রেম মানে তো মোহ, মায়া সব কিছু। তাই কাঁদতে ইচ্ছা যদি করে, সেটাও তো কান্নার প্রতি টান, কাঁদতে ভালোলাগা, আর ভালোলাগা থেকেই আসে প্রেম। তাই বিরহ, শোক, যন্ত্রণা, বিচ্ছেদ, আকাংখ্যা, মিলন, কষ্ট, আনন্দ – যাই বল না কেন, সবটাই প্রেমের রূপ পরিগ্রহ করা বারে বারে, কৃষ্ণের অসংখ্য রূপধারণের মত। কবিতা যদি এই বিরহ, শোক, যন্ত্রণা, বিচ্ছেদ, আকাংখ্যা, মিলন, কষ্ট, আনন্দ – এই সব বিষয়ের ওপর রচিত হতে পারে, তবে এককথায় ভেবে দেখলে, সব কবিতাই কি প্রেমের কবিতা নয়?
আর কবিতা লিখতে গেলে তো প্রেম আসবেই। কেন? কেন না সাহিত্যের একটি বিশেষ সৌন্দর্য আর মেধামণ্ডিত শাখাটির নাম হচ্ছে কাব্য সাহিত্য। এর একটি প্রশাখায় অবস্থান কবিতা নামের দিগ-পাশ-তল শব্দ-অলঙ্কারের সুষম ও পরিমিত ব্যবহারের এক নিপুণ মাধ্যম বলা যায়। আমার কাছে কবিতায় আভাসিত প্রেম, ভালবাসার বিষয়কে সাশ্রয়ী মনে হয়। তবে প্রেম বা ভালবাসাকে আমরা বিভিন্ন সময়ে কাল-পাত্রভেদে ভিন্নভিন্ন ভাবে দেখি, নর ও নারী প্রেম, ঈশ্বর প্রেম, সমাজ ও দেশজ প্রেম ইত্যাদি। তবে প্রেমের সবগুলো বিষয় নিয়েই তো আমরা প্রতি নিয়ত খুঁজে চলি কবিতা।
আর তাই আমি প্রেমিক। কবিতা প্রেমিক অথবা কবিতার প্রেম। যাই বল না কেন? আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি যার নাম নেব, কাব্যসাহিত্যে প্রথম প্রেমিককবি হিসেবে তিনি আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস। তার প্রথম জীবনের কবিতাগুলো রচিত হয়েছে মধুর ও হালকা রসে, দ্বিতীয় স্তরের কবিতা ছিল বেশ ভারী ও বিষাদপূর্ণ। তাঁর তৃতীয় স্তরের কবিতাগুলো ছিল প্রথম ভাগের এবং চতুর্থ স্তরের কবিতা দ্বিতীয় ভাগের কবিতার অনুরূপ। কিন্তু সব স্তরের কবিতায়ই ছিল প্রেমের ছোঁয়া । যেমন ‘‘The pity of love”, ‘‘The sorrow of love”, ‘‘O Do not love too long” ইত্যাদি।
তো কথা হচ্ছিল কবিতায় প্রেম কেন? একটা উত্তর তো আগেই দিলাম। আরো কি কি বিষয় ভাবায় শোন। কবিতায় প্রেম আর প্রেমে কবিতা থাকবে না তা কি করে হয়! রাগে-অভিমানে, অভিযোগে এমনকি আবেগ প্রকাশে কবিতার আবেদন ছিল, আছে। কবিতায় মানুষ নিজের মনের কথা খুঁজে পায়। আর সেখানেই আমার প্রথম ভাবনা আবার প্রতিষ্ঠা পায়। যে কবি যেভাবে দেখছে জীবনকে, সেটাই তার কাছে প্রেম। কারো কাছে প্রেয়সীকে জড়িয়ে রাখা প্রেম, কারো কাছে প্রেয়সীর থেকে শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখাই প্রেম। এই রকম একটা অদ্ভুত দোলাচলে কবিতা নিয়ে আসে সেই বিভিন্ন প্রকারের প্রেমের বার্তা। কিভাবে? পড়ে দেখুন,
একটা অদ্ভুত অথচ কি অবাক করা কবিতা লিখেছেন কবি নির্মলেন্দু গুন – ‘আমি বলছি না ভালবাসতেই হবে, আমি চাই কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য’। দারুণ না? অতি সামান্য চাওয়া, পাওয়াতেই নিহিত প্রেম, নিহিত কবিতা।
জীবনানন্দ? তিনি আবার অন্যপথে প্রেমকে আহ্বান করেছেন – ‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে। ফিরে এসো.........। এখানে কবি সামান্য হিংসুটে। তিনি সহ্য করতে পারেন না সুরঞ্জনার আশেপাশে কাউকে। এমন তো প্রায়শঃই হয়।
হেলাল হাফিজ একদম অন্য পথে প্রেমপ্রকাশ করছেন – ‘লোকালয়ে থাকব না আর, আমরণ পাখী হয়ে যাবো, খাবো মৌনতা তোমার’। পিছনে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেখতে পাচ্ছেন? হাঃ হাঃ হাঃ। সামান্য কষ্টেরও মিশেল আছে কিন্তু।
এতক্ষনে সবাই হয়ত ভাবছেন স্বয়ং রবিঠাকুর হাতের কাছে থাকতে.....। আসলে কবিগুরুর মত বিশ্বপ্রেমিক আর ক’জন আছে। তার প্রেমের কবিতা আর বিষয় বিশ্ববিদিত। তাই তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা মানে চর্বিতচর্বন করা। তাই বাইরেই তাকাই খোলা জানলা পথে। প্রথমেই যাকে দেখতে পাচ্ছি তিনি চিলির কবি, কূটনীতিক ও রাজনীতিক পাবলো নেরুদা। নোবেল পুরস্কৃত এই কবিকে এক কথায় বিংশশতাব্দীর অন্যতম সেরা প্রেমের কবিতার জনক বলা যায়। বলা হয় তিনি ছিলেন আদ্যপান্ত প্রেম ও রাজনীতির কবি। প্রথম প্রেম, হতাশা ও একা থাকা বা হওয়ার কবিতা থেকে সমাজ বাস্তবতা, পরে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার অনুসারী হয়ে প্রকৃতি থেকে নেয়া উপমা ও প্রতীক আগুন, জল, বাতাস ও মাটি এ চারটি অনুষঙ্গ তার কবিতায় বারবার ব্যবহৃত।