আজকের বাংলা ভাষায় অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত – এসব তো আছেই। আরো আছে। যেমন রবৃত্ত ছন্দ। এটা কি? এটা হচ্ছে বাংলা ভাষা ও বাঙালির ধ্বনি উচ্চারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছন্দ, যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘হসন্তের ছাঁচ’। চলিত বা প্রাকৃত বাংলার স্বভাব রক্ষা করে এ ছন্দের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। ফলে এ ছন্দকে সাধু বাংলার বাইরে বাউল গানে, লোককথায় ও ছড়ায় খুঁজে পাওয়া যায়।
এছাড়া মধ্যযুগীয় কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পাওয়া যায় ধামালি ছন্দ। অনেকে মনে করেন আধুনিক স্বরবৃত্ত ছন্দ এই ধামালি ছন্দ থেকেই এসেছে। আবার অক্ষরবৃত্ত ছন্দেরও উৎস হিসেবে দেখা হয় অনুষ্টুপ্ (বৈদিক), বসন্ততিলক (বৃত্তছন্দ), পাদাকুলক (মাত্রাছন্দ), পারনি (তামিল ছন্দ) কিংবা ফারসি বয়েৎ ছন্দকে। আবার এই লাইনটা তো সবাই পড়েছেন – ‘মহাভারতের কথা/ অমৃত সমান। কাশীরাম দাস ভণে/ শুনে পুণ্যবান্। এতে কোন ছন্দ? এটা পয়ার ছন্দ। পয়ার ছন্দেরই একটি বিবর্ধিত রূপের নাম হচ্ছে মহাপয়ার। এতে পয়ারের ৬ মাত্রার অন্ত্যপর্বের পরিবর্তে ১০ মাত্রা হয়। এ ছন্দের প্রথম উদাহরণ পরিলক্ষিত হয় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মিনী উপাখ্যান কাব্যে। এ ছাড়া ষোল শতকে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর কাব্যে ভঙ্গপয়ার নামে এক ধরনের ছন্দের প্রবর্তন করেন, যাতে পয়ারের প্রথম আট মাত্রা বাদ দিয়ে ৬ মাত্রার অন্তপর্বে দু মাত্রার অতিপর্ব যোগ করা হয় এবং একে পুনরুক্ত করে অন্য একটি পূর্ণ পয়ার-চরণের সঙ্গে অন্ত্যমিল তৈরি করা হয়।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলা সাহিত্যের কবিরা পয়ার ছন্দের প্রচলিত রীতি ভেঙে সৃষ্টি করেন একাবলী, দীর্ঘ ত্রিপদী, দীর্ঘ চৌপদী, লঘু ত্রিপদী ইত্যাদি ছন্দ। এরপরে এলেন মধুকবি। তিনি নিয়ে এলেন তাঁর অদ্বিতীয় অমিত্রাক্ষর ছন্দ। এ বিষয়ে বিশদ লেখা বাতুলতা মাত্র। অন্যদিকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দের নানাবিধ সফল প্রয়োগের পাশাপাশি বৈদিক গায়ত্রী ছন্দে বাংলা কবিতা রচনায় সফলতা লাভ করেন। তাঁর রচিত গায়ত্রী ছন্দ বর্তমানে গৌড়ী গায়ত্রী নামে পরিচিত। আর আমাদের বিদ্রোহী কবি? তিনি তাঁর অগ্নিবীণাসহ অনেক কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দে নতুন এক ধরনের ঝোঁক বা শ্বাসাঘাত তৈরির চেষ্টা করেন, যা তাঁর ‘বিদ্রোহী‘, ‘ধূমকেতু’ প্রভৃতি কবিতায় লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া তাঁর অনেক গানেও তিনি চার পর্বের স্বরবৃত্ত ছন্দে তিন অক্ষরের অতিপর্ব প্রয়োগ করে গজল গানের নতুন ছন্দভঙ্গি উদ্ভাবন করেন।