যেটুকু খবর আছে, চর্যাপদে ব্যবহৃত ছন্দ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম ছন্দ। চর্যাপদে যারা সেইসময়ে কবিতা লিখেছিলেন তাদের মধ্যে নামউল্লেখ করতে হয় – কাহ্নপাদ, লুইপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ। চর্যার পদগুলি প্রধানত পয়ার ও ত্রিপদী পদে রচিত। এতে মাত্রাছন্দের প্রভাবও দেখা যায়। ১৬ মাত্রার পাদাকুলক ছন্দের ব্যবহারই এখানে বেশি। তবে সর্বত্র নির্দিষ্ট মাত্রারীতি দেখা যায়নি। ছন্দপংক্তির পর্বসংখ্যাগত বৈচিত্র্যও এই পদগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, “তত্ত্বকথার ব্যাখ্যা এবং তাকে ব্রাহ্মণ সমাজের শ্যেনদৃষ্টি থেকে গোপন করা – এই দিকে পদকর্তারা এবং সিদ্ধাচার্যরা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বলে কবিতার আঙ্গিকের দিকে দৃষ্টি দেবার অবকাশ পাননি। তবে একটা কথা সত্য, চর্যাগানেই সর্বপ্রথম পয়ার-ত্রিপদীর আদিসুর ধ্বনিত হয়েছে। চর্যায় প্রায় প্রতিটি পদই অন্ত্যমিলযুক্ত। অন্তানুপ্রাসও প্রচুর। যেমন: “বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইলা উদারা”। চর্যায় উল্লিখিত ছন্দ ও অলংকারগুলি পরবর্তীকালের কবিদের পথপ্রদর্শকস্বরূপ হয়েছিল।
আজকাল যারা ছন্দ নিয়ে নাড়াঘাঁটা করছেন তারা জানেন বাংলা ভাষায় বাংলা কবিতার ছন্দকে মোটামুটি তিন ধরনের বলে ধরে নেয়া হয়, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত। আমি কিন্তু এসবের ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। আমি একটু অন্যদিকে চোখ ঘোরাব।
এমন অনেক ছন্দ আছে যা আজকাল আজ খুঁজে পাওয়া যায় না। মূলত সংস্কৃত ভাষায় উৎপন্ন হয়েছিল এইসব ছন্দের। যেমন, ইন্দ্রবজ্রা, বসন্ততিলক, মালিনী, স্রগ্ধরা, তোটকম বা তোটক, শার্দূলবিক্রীড়িত, ইন্দ্রবংশা, বংশস্থবিল, তূণক ও ভুজঙ্গপ্রয়াত ইত্যাদি।
ভারতবর্ষে ছন্দচর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। সুদূর অতীতে বৈদিক ভাষা ও সাহিত্য চর্চার সময়কাল থেকেই ভারতবর্ষে কাব্যের প্রধান উপাদানরূপে ছন্দের চর্চা হয়ে আসছে। সে প্রায় খ্রি.পূ ২৫০০-৯০০ অব্দের কথা। ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকির কাব্যে ব্যবহৃত ছন্দকে আদি ছন্দ বলে আমরা জানি। একদিন ব্যাধের শরে ক্রৌঞ্চমিথুনের ক্রৌঞ্চ নিহত হলে ক্রৌঞ্চী আর্তস্বরে বিলাপ করছিল। তা শুনে বাল্মীকির বেদনার্ত হৃদয় থেকে যে ছন্দে সকরুণ অভিশাপোক্তি উচ্চারিত হয় তাই আদি ছন্দ হিসেবে পরিচিত। ছন্দটির নাম অনুষ্টুপ্। বাল্মীকির এ ছন্দোভাবনাই পর্যায়ক্রমে গায়ত্রী, অনুষ্টুপ্, ত্রিষ্টুপ্ ইত্যাদি শাখায় বিভক্ত ও বিকশিত হয়ে নব্যভারতীয় বিভিন্ন ভাষার কাব্যচর্চাকে যেমন প্রভাবিত করেছে, তেমনি নতুন নতুন দেশিয় ছন্দ নির্মাণেও উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা ছন্দের উদ্ভব ও বিকাশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলা কাব্যের বিভিন্ন ছন্দ সৃষ্টির পশ্চাতে সংস্কৃত অনুষ্টুপাদি ছন্দ ভিত্তি হিসেবে কাজ করলেও এক্ষেত্রে এ ভাষার কবি-মনীষীদের আবেগসমৃদ্ধ মৌলিক ও সৃষ্টিধর্মী চিন্তা এবং কৌশলই মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।