মোদ্দা কথাটা খুব সহজ, সরল – কবিতা বলতে আমি কি বুঝি? অবশ্য জবাবটাও এক কথাতেই দেওয়া যেত – কালবৈশাখী বলতে আমি যা বুঝি অথবা প্রসববেদনা যাকে বলে।

আসলে কবিতা লিখব বলে বসলেই কবিতা লেখা যায় না। কবিতা আসে। আসে কালবৈশাখীর মত। চুল পাট পাট করে আর সাজিয়ে গুছিয়ে বসে শুধু শুন্যপাতাই সম্বল হয়, এমন হয়েছে অনেকবার। আমি রবিঠাকুর নই যে কবিতায় ফুটিয়ে তুলব শিল্পের নান্দনিকতা, আমি বিদ্রোহী কবি নই যে মাথার উপর দিয়ে গোলা উড়ে গেলেও কিস্যু যায় আসে না।

কবিতা আসলে একটা বোধ আর শব্দের মারাত্বক খেলা। হয়ত বাইরে শেষ বিকেলের ছায়া ঘনিয়ে এসেছে, আমি লিখলাম ছায়াশিবির। বেশ মনঃপূত হল। আর কবিতার পর কবিতা লিখে এই যে একটা প্রশ্ন অনবরত খুঁচিয়ে যায় – যা লিখলাম, সেটা লিখলাম, কবিতা হল কি? এই অতৃপ্তি আমাকে অনবরত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আমার মতে এটাই প্রসববেদনা। এই বেদনা অনুভবের, দৃশ্যযোগ্য নয়। এই বেদনায় কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় কবিতা।

কবিতা মানেই ছন্দ। ছন্দ মানে কিন্তু অন্ত্যমিল নয়। আধুনিক গদ্য কবিতাতেও থাকে ছন্দ। প্রাচীন চর্যাপদের কবি যখন লিখলেন – ‘গাগরি বারি ঢারি করি পিচল চলতো হি অঙ্গুলি চাপি’ তাতেও রয়েছে এক অনুপম ছন্দ। একবার কোন জায়গায় লিখেছিলাম কবিতা মানে হল – কবি+তা। অনেকটা ভাবনার ডিমে তা দিয়ে কবিতারূপ শিশুর জন্ম দেবার মতই। কবির বেদনা, আনন্দ সব মিলে মিশে থাকা দৈনন্দিন যাপিত হৃদয়ই কবিতার জন্মভূমি। সময় বিশেষে কবির আনন্দ-বেদনা যখন উপমা দ্বারা সুন্দর ছন্দে ভাষায় প্রকাশ পায় তখনই কবিতার জন্ম হয়। এ শুধু আমার কথা নয়, আদি কবি লিখে গেছেন –

“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চ মিথুনা দেবক মবধীঃ কাম মৌহিতম্‌”

আর রয়েছে কবির কল্পনাশক্তির দৌড়, তার সাথে পাল্লা দিয়ে শব্দকোষের ওপর দখল। অনেকটা পায়েসের সাথে কিসমিস আর মিষ্টদ্রব্যের সহায়তা। আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলব চারদিকের যা কিছু ঘটে চলেছে একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, তার সবটাই কিন্তু (a+b)2 এর ফর্মূলা নয়। তবে সবটাই বাস্তব, তবে তার সাথে পরাবাস্তবের পাশাপাশি শয্যা রয়েছে বিছানো। কবির ভাবনার চাদরে সেই সব শয্যা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। বাইরে থেকে পাঠক বুঝতে পারেন লৌকিক সবটাই, আবার কিছু অলৌকিক, আধিদৈবিক আর আধিআত্মিকের অস্ত্বিত্ব অজানাই থেকে যায়। থাকুক, তা নইলে কবি আর মানুষের পার্থক্য কিসের?

গ্রিক ভাষায় ’কবি’ শব্দের অর্থ হল ’স্রষ্টা’। আর স্রষ্টা সবসময় সৃষ্টি করে চলেন। এই সৃষ্টির প্রবহমান গতি বড় বিচিত্র। একজন কবিই তার সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা বিশেষ বিশেষ রূপকল্প সৃষ্টি করতে পারেন। সে ক্ষমতা তার আছে। সব মানুষ হয়ত আইনস্টাইনের ফর্মূলা বোঝেন না, তা বলে আইনস্টাইনকে ফেলে দিতে হবে এমন তো কথা নেই।

এবার আসি কবিতা লেখার উপকরণ নিয়ে। না না, হাতা খুন্তি জাতীয় কিছু হাতের কাছে গুছিয়ে নিয়ে বসার দরকার নেই। কবিতা মানে শব্দ আর শব্দের হয় অনেক রকম ফের – (১) প্রচলিত, (২) অপ্রচলিত, (৩) রূপক, (৪) অলঙ্কার (৫) সদ্য প্রবর্তিত, (৬) সম্প্রসারিত, (৭) সঙ্কুচিত, বা পরিবর্তিত। এরপর আসি কবি ও কবিতার শিল্প মূল্য বা সমালোচনায়। চিত্রকর বা যেকোন শিল্পীর মত তাঁকেও এই তিন ধরণের বিষয়ের যে কোনো একটি অনুকরণ করতে হয়ঃ ১. বস্তু যেমনটি ছিলো বা আছে, ২. বস্তু সম্বন্ধে লোকে যা বলে বা মনে করে, ৩. বস্তুর যেমনটি হওয়া উচিৎ।

লিখলে হয়ত পাতার পর পাতা লিখে যাওয়া যায়, যা বিরক্তিউদ্রেক ভিন্ন আর কিছুরই সৃষ্টি করবে না। আমার কাছে কবিতা হল নারীর মত, কবিতা রক্তের মত, কবিতা প্রলুব্ধতার মত, কবিতা জিজ্ঞাসার মত, কবিতা সত্যের মত। সব শেষ কথা হল কবিতার আরেক নাম আনন্দ। একজন মা যেমন অসহ্য প্রসববেদনার শেষে একটা সন্তান ভূমিষ্ঠ করেন, পান স্বর্গীয় আনন্দ, একজন কবিও একখানি কবিতা লেখার পর পান সাহিত্যের শেষ মূল্য; আনন্দ। সুন্দর আনন্দ দেয় তাই কবিতায় সুন্দরকে করে আবাহন। বস্তুত বলা যায়, যা আনন্দ দেয় মন তাকেই সুন্দর বলে, আর সেটাই কবিতার সামগ্রী। আর আনন্দ দেয় কেন? কারণ তা রূপ ও অরূপের, খন্ড ও অখন্ডের পরিপূর্ণ ঐক্য আমাদের প্রতিভাত করে বলে। কাব্য সৃষ্টির তত্ত্ব, তাই রূপের দ্বারাই অরুপকে প্রকাশ করা, অরুপের দ্বারা রুপকে আচ্ছন্ন করে দেখা।

সাধে কি কোলরিটজ বলেছেন, ‘Best Words In The Best Order.” আর ওয়ার্ডস ওয়ার্থের মতে, ‘কবিতা সব জ্ঞানের মূল্যবোধ, সৌন্দর্যের প্রকাশ।’

এই অবধি লিখতে লিখতে দেখতে পাচ্ছি বাইরে ঘনিয়ে আসছে প্রায়ান্ধকার পরিবেশ, আবার প্রসববেদনা অনুভব করছি। অতএব প্রবন্ধের এইখানেই ইতি, কবিতার শুরু।

যদি সাথে নাও, কথা দিচ্ছি মাছরাঙাদের উপহার দেব জলছবি,
মহামহোপাধ্যায় উপাধীপ্রাপ্ত বৃক্ষের অন্তরালে লুকিয়ে যে পরী,
ওর হাসিটুকু পবিত্র আধারে সংগ্রহ করে –
অকাতরে তোমাদের মাঝে বিলিয়ে দেব পরমাত্মীয় যৌবন –
আবার নবজন্মের ফসল হব বলে।