প্রায় সবারই সকাল, বিকেল আর রাত্রি আসে নিয়ম মেনে। সেই ঘুম থেকে ওঠা, অফিস যাওয়া অথবা না যাওয়া, রাতে হতক্লান্ত হয়ে ফিরে খেয়ে ফের ঘুম। মাঝখানে টুকটাক নানা পাপ আর টুকটাক পূন্য কামিয়ে নেয়ার তরে মন্দিরে, মসজিদে বা গীর্জায় হানা দেওয়া। কিন্তু প্রকৃত পূণ্য বা ভালো কাজ কি আমরা করি, বা করলেও ক’টা?
সেই পূণ্যের লোভেই গতকাল হাজির হলাম কবি’র বাসাবাটিতে। সেই কবি, যার কলম কালজয়ী পঙক্তির জন্ম দেয় -
‘‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি… তোমার জন্যে গলির কোণে, ভাবি আমার মুখ দেখাব, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। ...’’
এই তীর্থযাত্রায় আমি যাদের সঙ্গ নিলাম তারা হলেন এই আসরের কবি দেবব্রত সান্যাল আর কবি শান্তনু ব্যানার্জী। নিতান্তই ভয়ে ভয়ে দুরুদুরু বক্ষে, হাতে এক একখানি কবির কাব্যগ্রন্থ, হাজির হলাম তিনতলায়। দরজায় টোকা। আমাদের বসতে দেওয়া হল কবির বসার ঘরে। বিলাসিতার তিলমাত্রহীন ঘরখানা দেখে আমরা বাকরুদ্ধ। ছাদ অবধি বোঝাই বই, চারদিকে শুধু বই আর বই। লেখার টেবিলে বই, একচিলতে শোওয়ার খাটে বই, এমনকি স্থানাভাবে মাটিতেও বইয়ের রাশি। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ ভক্তের মনোভাব নিয়ে বসে।
অনতিবিলম্বে হাজির কবি শঙ্খ ঘোষ। যাকে এক ঝলক দেখেই মনে হয় – হে স্রষ্টা, তোমায় সেলাম। প্রনাম নিলেন না। যদিও ততক্ষণে তার পদযুগল ছুঁয়ে ফেলেছে আমাদের বিনত দৃষ্টির অঞ্জলি।
এরপরের সময়টুকু শুধুই স্মরণীয়। কিভাবে পেরিয়ে গেল অনেকটা সময় টের পেলাম না। কবিতা নিয়ে কথা হল, আমাদের নিজ নিজ জন্মস্থান নিয়ে কথা হল, কবিদের নিয়ে কথা হল। আসলে ‘কথা হল’ এই ব্যাপারটাই এহ বাহ্য। তিনি বললেন, আমরা শুনলাম। অত্যন্ত মিতবাক, ধীরভাষী। যথারীতি চা, সন্দেশ সহ আপ্যায়ন করতেও ভুললেন না। নিজে থেকে আমাদের নাম,ধাম জিজ্ঞেস করলেন, জেনে নিলেন আমাদের পেশাটাও। প্রশ্রয় দিলেন তাঁর সাথে ছবি তোলার। আমি পরম শ্রদ্ধার সাথে তাঁর হাতে তুলে দিলাম আমার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘যাপিত হৃদয়’। মনে হল এতদিনে আমার বইটি এ নদী, ও নদী ঘুরে পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল, আজ সাগরের দেখা পেল অবশেষে। সস্নেহে দেবব্রতবাবু আর আমার নিয়ে যাওয়া শঙ্খ ঘোষ কাব্যগ্রন্থে সাক্ষর প্রদান করলেন আর বইদুটিকে অমূল্য থেকে অমূল্যতম করে দিলেন এক ঝলকেই। শান্তনু বোধকরি হাত কামড়াচ্ছিল মনে মনেই।
কিভাবে যে ঘণ্টাখানেক অতিক্রম গেল বুঝতেই পারলাম না আমরা তিনজনে। বেরিয়ে আসার সময় কবি নিজে দরজা অবধি এগিয়ে এলেন। বুঝে নিলাম কবি শুধু কবিতাই লেখেন না, কবিতাকে নিজের সাথে একাত্ব করে ফেলেছেন আর সে দুঃসাহস তিনি ধারণ করতে পারেন। হ্যাঁ তিনিই পারেন যার এ জন্মের পার্থিব নাম - শঙ্খ ঘোষ।
সিঁড়ি দিয়ে মোহগ্রস্তের মত তিনজন ধীর পায়ে নেমে আসছি। মনে এল আরো কিছু অনাদি সৃষ্টি –
তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া
পাতালমুখ হঠাত্ খুলে গেলে
দুধারে হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই
শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।
যে যার গন্তব্যে প্রস্থানের পূর্বে মনে মনে বললাম - আবার আসব কবি, এই ধানসিঁড়িটির তীরে।
** কবিতা আসরে আমাদের তিনজনের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী ‘তুমি রবে নীরবে - ( তিন কবির এক কবিতা )' কবিতারূপে আজই প্রকাশিত হয়েছে। পড়ে দেখবার অনুরোধ জানাচ্ছি।