আয় তবে ভাইবোন/ আয় সবে আয় শোন
গাই গান, পদধুলি শিরে লয়ে মা’র
মা’র বড় কেউ নাই/ কেউ নাই কেউ নাই।
নতি করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!’  

ওপরের লাইন ক’টি চেনা চেনা মনে হচ্ছে? হবেই তো। এ যে আমাদের সেই বিদ্রোহী কবি নজরুলের লেখা চিরস্মরণীয় লিখনী। যে কবি এমন লিখনী লিখতে পারেন সেই কবি কেন চিরতরে মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন? আমাদেরকে বিস্মিত করে চিরকাল। আসুন একটু ফিরে দেখি।

কবির সারাটা জীবন ছিল বন্ধনহীন। এলোমেলো আর খামখেয়ালীতে ভরা। তাকে আহত করেছিল নানান আঘাত। হিন্দু মুসলমানের আঘাত, সাহিত্যিকদের আঘাত, দুঃখ দারিদ্রের আঘাত, দায় দেনার আঘাত এমন কত কি। তবু তার কলমকে আহত করতে পারেনি কেউই, কোনদিনও। আসলে তার নিজের জীবনই ছিল ভারি বৈচিত্রময়। তৎকালীন সামাজিক নিয়মনিষ্ঠা মেনে তাকে চলতে বাধ্য করতে পারেনি কেউ।

১৯১৭ সাল নাগাদ তিনি পল্টনে যোগ দেন। সেই পল্টন ১৯২০ সালে ভেঙ্গে যাওয়ায় তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি চুরুলিয়ায় চলে যান। ছিলেন দিন আস্টেক। সেই সময়ই তাঁর মায়ের সাথে তাঁর মতান্তর ঘটে এবং তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে যান, আর ফিরে আসেন নি, এমন কি মায়ের মৃত্যুর মত মর্মান্তিক সংবাদ পেয়েও। কিন্তু কেন? এই প্রশ্ন যাবতীয় গবেষকদের ভাবিয়েছে দশকের পর দশক।

এমনকি হুগলী জেলে যখন বন্দীদশা কাটাচ্ছেন অনশনে, তখন ছেলের সাথে দেখা করতে তথা অনশন ভাঙ্গাতে কবির মা গ্রাম থেকে ছুটে এসেছিলেন। কোন মা-ই বা ছেলেকে অভুক্ত দেখতে পারে! কিন্তু হায়! কবি কথা বলা তো দুরের কথা, দেখাই করলেন না। মা ফিরে গেলেন ভগ্ন হৃদয়ে। কেন?

মুজাফফার আহমেদ একবার কবিকে (১৯২১) তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য কাকুতি মিনতি করেন, কিন্তু কবি যান নি। এত অভিমান? নিজের জন্মদাত্রী মায়ের বিরুদ্ধে?

গবেষকদের মতে, নজরুল ছিলেন স্বাধীনচেতা, বাঁধবাঙ্গা বাণ। কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙ্গে লোপাট করে দেবার সাহস ছিল অদম্য। তাঁর নিজের কলমে – ‘আমি মানি না কো কোন আইন আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন! আমি ধূর্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর আমি বিদ্রোহী......’ আর এভাবেই তাবৎ পাঠককুল নজরুলকে দেখতে অভ্যস্ত। অনভ্যস্ত ঝড়ের মত সাহিত্যজগতে তুফান তোলা কবি, যিনি অনাবিল বলতে পারেন – ‘মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস! আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, আমি দূর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার’

সেই টর্পেডো কবি নিজে সমাজের তথাকথিত নিয়মের বিপরীতে গিয়ে হিন্দু মেয়ে বিয়ে, প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, সৈনিক ক্যাম্পে যোগদান ইত্যাদি অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বিনিময়ে জুটে ছিল তিরস্কার, লাঞ্ছনা আর কটূক্তি। শুধু কবিকে নয়, তাঁর পরিবারকেও। নজরুল প্রথমে নার্গিসকে বিয়ে করলেও পরে এক হিন্দু নারীকে বিয়ে করেন এবং এই বিয়ে উপলক্ষে কবিকে ঘরে-বাইরে নানান সমস্যায় জর্জরিত হতে হয়। অন্যদিকে এক হিন্দু নারীকে বিয়ে করায় তৎকালের মুসলিম সমাজও কবিকে তিরস্কৃত করত, এমনকি তারা তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। সারাদেশের জাগরণে যার গান প্রেরণা যোগায়, সে নজরুল তাদের কাছে ছিলেন ঘৃণার পাত্র। এককথায় কবিকে মুসলিম এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পেই পুড়তে হয়েছে। সেই কারনেই (হয়ত) নজরুলকে সমর্থন করতে পারেন নি তাঁর গর্ভধারিনী। বিরক্ত হয়েছিলেন পদে পদে। ঘরে বাইরে জেরবার কবি একমাত্র আশ্রয় হয়ত খুঁজতেন মায়ের কাছে। সেখানেও বিরুপ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় তিনি নিজেই এবার হলেন অভিমানী।

কাজী নজরুল ইসলাম এর ছেলে কাজী সব্যসাচীর মৃত্যু হয় ১৯৭৯ সালের ২রা মার্চে। তাকে এর কয়েকদিন আগে মায়ের সাথে কবির অভিমান নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন কলকাতার ডঃ সুশীল কুমার গুপ্ত। কবির ছেলে তাকে বলেছিলেন, গ্রামের রক্ষণশীল পরিবেশ মূলত কবিকে গ্রাম ও স্বজন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল।  তাই বলে মা’র থেকেও?

তাই কি কবিকে নির্বাক হতে হয়েছিল শেষদিনগুলিতে? মা’কে অবহেলা এবং কষ্ট দেবার কারনে? ১৯৪২ সাল নাগাদ এক অজানা রোগের কবলে পড়ে কবি চিরতরে নির্বাক হয়ে যান। বিজ্ঞান নিশ্চয়ই মানবে না, তবে ঐতিহাসিকরা বলেন - মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার এমন এক অভিশাপ, যার প্রতিফল দুনিয়াতে ভোগ করতেই হয় সবাইকেই। এত বিস্ময়কর প্রতিভা থাকা সত্বেও জাতীয় মনন এবং সমাজ চেতনায় অবহেলিতই থেকে গেলেন। কবি কি পেয়েছিলেন তাঁর যোগ্য সম্মান? সেটি কি মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বলেই? দশ মাস দশ দিন গর্ভের জাতকের এহেন ব্যবহার মা’কে সারাজীবন দগ্ধে দগ্ধে মেরেছিল বলেই কি মায়ের হয়ে সর্বশক্তিমান কঠোর শাস্তি নামিয়ে আনলেন?  

ভবিষ্যৎ হয়ত জানবে এর উত্তর, হয়ত জানবে না। আসুন আমরা নতজানু হই সেই কবির সামনে যিনি আপামর বাঙ্গালিকে উদ্বেলিত করে বলেন -

‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি আমি সেই দিন হব শান্ত!


হে চির অভিমানী কবি, লহ প্রণাম।