আজ ২০.০২.২০১৫ (শুক্রবার)। যতই দেশে ফেরার দিন ঘনিয়ে আসছে ততই খারাপ লাগছে, সেই কবে থেকে অপেক্ষা, দিন যেন ফুরোতেই চায় না আর এখানে? কখন দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যে, সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত, রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যাচ্ছে ঠাহর করাই যাচ্ছে না। আজ তো বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটির দিন, আমাদের যেমন রবিবার। আজ সকাল থেকেই বৈদ্যবাড়িতে নিমন্ত্রণ। তাই উপায় নেই, বেড়িয়ে পরতেই হল। বাহন অটো। সাতসকালে সামান্য যা কিছু পেটে দিয়েছিলাম, তাও এক নিমেষে হজম হয়ে গেলো অটোর ভাড়া শুনে। হালায় কয় কি! রমনা থেকে উত্তরা ৬০০ টাকা! আমার তো মাথাই নষ্ট! কি আর করা! যস্মিন দেশে যদাচার। এখানকার অটোগুলো চারদিকে খোলা নয়, লোহার জাল দিয়ে ঢাকা। উঠে বসলেই ভিতর থেকে ছিটকিনি। একেবারে গন্তব্য এলে তবে তোমার মুক্তি। পিছনে সুমিতা আর ঈশানীকে বসতে দিয়ে আমি সামনে বিশালবপু ড্রাইভারসাহেবের পাশে কেৎরে বসলাম আর এইভাবে বসে-আছি-না-ঝুলে-আছি অবস্থাতেই যেতে যেতে অটোচালকের মুখে অনেক কথাই শুনছিলাম। এখানকার রাজনৈতিক হাল-হকিকৎ, জীবন যাপনের কষ্টসাধ্য পথের দিশা, একেবারে যাকে বলে বেতের এক ঝুড়ি, নিন্দা ভুড়িভুড়ি! অবশ্য কেন এই দুর্দশা তার একরকম ব্যাখ্যাও পাচ্ছিলাম, অবশ্যই তার নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোন থেকে। একসময় পথ শেষ। খাঁচার দরজা খুলতেই নেমে বাঁচলুম। নেওয়া হল মিষ্টি, ফল (ভদ্রতা আর কি!) আবারও সহাস্য বৈদ্যবাবু গাড়ী নিয়ে এসে হাজির। বৈদ্যবাবুর বাড়ি সীমান্তে। সীমান্তের ওপারে গাজীপুর। ৬নং রোড, উত্তরা হাউজিং বিল্ডিং। বৈদ্যবাবুরা যে ফ্ল্যাটে থাকে এখন সেটা ভাড়ার। ৬ তলা উঠতে জিভ বেরোব বেরোব করছে। বৈদ্যবাবুরা স্থায়ী বাসস্থান কিনে নিয়েছে ইতিমধ্যে, একটু দূরেই, যাবে মাসখানেকের মধ্যে। দরজায় ওনার বৌ প্রিয়া। আবারও সেই উষ্ণ আতিথেয়তা, যার মাঝে একটুকুও কৃত্তিমতার লেশ নেই। প্রিয়াকে প্রথম আলাপেই ভালো লেগে গেল। ও নিজেও চাকরি করে। একটা বাচ্চা আছে (ও বাবা! কি গুরুগম্ভীর স্বভাবের!) এরপর আড্ডা এবং চমকে ওঠা। মানে চমকে উঠতেই হল। দ্বিপ্রাহরিক আহারের নমুনা পেশ হতেই। কি নেই তাতে! প্রচুর খাবার দাবারের পাশাপাশি ইলিশ, পাঁঠার মাংস, মুরগীর মাংস, মিষ্টি! কি করেছে এরা! আমার মেয়ে এমনিতেই স্বল্পাহারী। ফলে ও’র চমকানোটা আরো বেশী। আমার স্ত্রী অল্প চমকিয়ে পুলকিত হৃদয়ে এবং বেশী বাক্যব্যয় না করে ইলিশে ল্যান্ড করল, আমি পাঁঠায়। হাঃ হাঃ হাঃ। আহারান্তে নিতান্তই কষ্ট করে দেহটাকে সোফায় এলিয়ে দিতে না দিতেই সুসংবাদ! অনিরুদ্ধ বুলবুল আসছেন। আগেই এই প্রসঙ্গের উত্থাপন করেছিলাম। আমি জানতাম না ওনার শরীর অত অসুস্থ। কি অসুখ সেটা উহ্যই থাক। মাথায় ক্যাপ, পরনে কোট-প্যান্ট, কবি হাজির হলেন। ভারি সদালাপী মানুষ। শুধু আমাকে দেখবেন বলেই ৬ তলা সিঁড়ি ভেঙ্গে একদমে উঠে এলেন। আন্তরিকতা না থেকেও ওপর-ভদ্রতার নমুনা আমার জীবনে অনেক এসেছে। আর আন্তরিকতা থাকলে কি হয় সেটা বুলবুলসাহাবকে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না। অথচ কাকে ছেড়ে কার কথা বলি, হুমায়ূন ভাই বা মাসুমভাইয়ের কথা আগে বলেছি বলেই না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু সাবলীল মনির? শিমুল শুভ্র? আনিছুর রহমান? বাদ যায়নি শিমুল শুভ্রের স্ত্রী আমার ওপার বাংলার এক বোন রুম্পাও। এরা সশরীরে হাজির না থেকেও যেভাবে দুঃখপ্রকাশ করে গেছেন ক্রমাগত, নিয়মিত খবর নিয়েছেন আমার – কি বলব! আর আগুনভাই তো বসে আছেন সুদুর মালয়েশিয়ায়। আইএসডি করে প্রতি ৩/৪ ঘণ্টা বাদে বাদে ফোন করে খবর নিয়েছেন আমার। আর একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি কবি সরকার মুনীর। এই মহান আত্মার কথায় একটু পরেই আসছি। যাইহোক অনিরুদ্ধ (যদিও এটা তাঁর আসল নাম নয়) বুলবুলের সাথে কথা বলে জানলাম উনি আজই ফরিদপুর যাচ্ছেন। যাওয়ার পথে আমাদের বইমেলায় নামিয়ে দেবেন। কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এল। আমার স্ত্রী, মেয়ের একটু ঢুলুনিভাব এসেছিল, ওদের চাগিয়ে তুলে নামিয়ে আনলাম রাস্তায়। বুলবুলসাহাব বসলেন স্টিয়ারিং-য়ে, আমি পাশে, পিছনে সুমিতা, ঈশানী। গানে আছে – ‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ’। ঠিক সেইরকম ভাবেই পথে যেতে যেতে অনেক গল্প হল। অনেক অচেনা গল্প হল চেনামানুষ বুলবুলসাহাবের কাছ থেকে। জ্যামসমৃদ্ধ পথে উত্তরা টু সোরাবোর্দী প্রাঙ্গণ আসতেই ঘণ্টা তিনেক পার! তবে এই ৩ ঘণ্টা বুলবুলসাহেবেরর পাশে বসে থাকাটা একটা অভিজ্ঞতা। কত অজানা তথ্যই যে পেলাম। আমার বৌ, মেয়ে ঘুমিয়ে অচেতন (পেটে অত উত্তম দ্রব্যাদি পড়লে যেটা স্বাভাবিক)। আমি টানটান হয়ে বুলবুলসাহেবের কথা শুনছি। ভদ্রলোকের অকল্পনীয় স্মৃতিশক্তি। অত কঠিন অসুখ ওনার স্বাস্থ্য হয়ত অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে, তবে স্মৃতিশক্তির ভান্ডারে হাত দিতে পারেনি। ২ বছর বয়সে পড়া কবিতা ঝরঝর করে বলে যাচ্ছেন। আরো কত কথা। তার মধ্যে একটি বলি। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) প্রথম গভর্নর হয়ে আসেন মোনায়েম খান (যাবার পথে সেই খানের সমাধিও দেখালেন)। এই মোনায়েম খান ছিলেন আইয়ুব খানের সহচর। ইনি নাকি বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত (তৎকালীন দিনে স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহৃত হত) শুনে ভারি বিরক্ত হয়ে একবার এক বিদ্যালয় পরিদর্শনে এসে বলেছিলেন – ‘তোমরা রবীন্দ্রনাথের গান গাও ক্যান? নিজেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারো না?’ সেই বিদ্যালয়ে সব উপস্থিত ছাত্রদের মধ্যে একটি বাচ্চাও ছিল। তিনিই আজকের অনিরুদ্ধ বুলবুল। আমি দেখছিলাম বুলবুল সাহেবের লুকিং গ্লাসের এক কোনা ভাঙা। ভাবলাম বোধহয় অসাবধানতায় বা ছোটখাটো দুর্ঘটনার শিকার। জিজ্ঞাসা করতেই বেরিয়ে এলো আরও একটা মজার গল্প। ততক্ষণে মেয়ে ও মায়ের তন্দ্রা কেটেছে। ওরাও শুনছে।  বুলবুলসাহাব একবার তার গাড়ীর লুকিং গ্লাস লাগালেন, দুদিনের মধ্যে সেই বস্তুটি চুরি যায়। যাইহোক, আবার লুকিং গ্লাস কেনার জন্য দোকানে হাজির। অবাক হয়ে দেখলেন দোকানী যে লুকিং গ্লাসটা লাগিয়ে দিল, সেটা তারই সেই চুরি যাওয়া লুকিং গ্লাস। তো লাগানোর পর আবার একদিন লুকিং গ্লাস হাওয়া। এইবার সেই দোকানী ফোন করেছে – ‘লুকিং গ্লাস নেবেন নাকি?’ বুলবুল সাহাব দোকানে এসে দেখেন তারই লুকিং গ্লাস আবার তার গাড়িতে লাগানো হচ্ছে। এর পরের বারও আবার সেই কান্ড! এবার রেগে মেগে তিনি লুকিং গ্লাসের এক কোনা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দিলেন। নে এবার ভাঙা জিনিষ নে। আর তার লুকিং গ্লাস চুরি হয় নি। হাঃ হাঃ হাঃ। হাসতে হাসতে আমরা লুটিয়ে পরার জোগাড়। যাই হোক, আমাদের বইমেলার সামনে নামিয়ে দেবার আগে ধরিয়ে দিলেন নিজের স্বাক্ষর করা বই। নাম –‘স্বপ্ন কাজল’। ভেতরে সই করলেন স্টিয়ারিঙে বই রেখেই - ‘কবি অজিতেশ নাগ কে ভালোবাসার উপহার, ২০.০২.২০১৪’। আগুন নদী তো বলেইছিলেন, আরো কিছু কবিদের মুখে শুনেছি তিনি দেখা করেন না। বস্তুত আমি যেদিন বাংলাদেশে পা রাখি, সেইদিনই তাঁর ঢাকা ছেড়ে চলে যাবার কথা। তিনি যান নি। উপরন্তু সেই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে ছুটে গিয়েছিলেন মীরপুর থেকে উত্তরা – আমি অভিভূত! আর তার সাথে দেখা হয় নি। পরে ফোনে কথা হয়েছে দু-একবার মাত্র। ভালো থাকবেন বুলবুলসাহাব। আর নিজের শরীরের যত্ন নেবেন।


আবার বইমেলা। আবার সেই ২১শে বইমেলা। হুমায়ূন ভাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন একাডেমী চত্বরে। কি করে বোঝাই এই সব পবিত্র মানুষদের সান্নিধ্য পাবার জন্য স্বল্প সময় আমার হাতে। তাতেও ভাগ বসাচ্ছে ঢাকার ট্রাফিকজ্যাম। আবারো দেখা পেলাম হাস্য মুখে মাসুমভাইয়ের। হাতে ঝুলছে (অথবা দুলছে) তার বিখ্যাত ট্যাবলেট। অনতিবিলম্বে যোগ দিলেন সরকার মুনীর। আরেক মহান ব্যাক্তিত্ব। মুনীরভাই, দোষ নেবেন না, প্রথমে দেখাতেই আপনাকে সামান্য দাম্ভিক বলে মনে হয়েছিল। পরে বুঝেছিলাম সেটা আসলে ছিল নারকেলের রহস্য। অপরটা কঠিন, ভেতরে মুচমুচে। সুপেয় জলেরও কমতি নেই। ঐ সময় উনি একটা নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরীতে ব্যস্ত ছিলেন। পরে ঐ ওয়েবসাইটটি স্বয়ংসম্পুর্ন হয় এবং তাতে আমার বাংলাদেশ ভ্রমণ নিয়ে একটা লেখাও প্রকাশ হয়। http://thedailylifenews.com/। মাসুমভাইয়েরও মনের কোনায় ঐসময়েই একটা শুধুমাত্র ছোট গল্প প্রকাশের জন্য একটি নিজস্ব ‘ডট কম’-এর ভাবনা উঁকি মারছিল। পরে ওয়েবসাইটটি হয়ে যায় এবং উল্লেখ্য তাতে প্রথম ছাপা গল্পটি আমারই। এখন অনেক লেখকই সেখানে নিয়মিত লিখছেন। আরো একটা সম্মানের ব্যাপার। ছোট গল্প ডট কম ( http://chhotogalpo.com/bd/) এর যে লোগো, সেটাও আমার করে দেওয়া।