পরদিন ১৯.০২.২০১৫ (বৃহস্পতিবার)। আজ সকাল থেকেই বক্ষ দুরুদুরু। আজকের গন্তব্য বারদি। হয়ত একটা নাম, হয়ত বাংলাদেশের ৬৪টা জেলার অজস্র অজস্র সবুজে ঢাকা গ্রামের মধ্যে একটা নামমাত্র, তবু সে নাম উজ্জ্বল, সে নাম দেদীপ্যমান সতত বুকের মহলে। শুধু আমার নয়, আমার বাবারও প্রায় সারাজীবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। আমার বাবা হয়ত তার বাবার কাছে শুনেছে তাঁদের পিতৃপুরুষের গ্রামের কথা, আবছা আবছা। তবু সে নাম বংশপরম্পরায় রয়ে গেছে অনিভন্ত মশালের মত – বারদি। বারদি মানে লোকনাথ বাবা, বারদি মানে জ্যোতি বসু, বারদি মানে নাগেদের জমিদারী, বারদি মানেই আমাদের গ্রাম। “এবার আমায় বাড়ি নিয়ে চল” জ্ঞান হারানোর আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু, গিনেস বুকে নাম ওঠা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের সোনারগাঁওয়ের মেঘনা পাড়ের বারদি গ্রামের সোনার ছেলে জ্যোতি বসুর শেষ কথা। ঢাকা থেকে বারদীর দূরত্ব বড়জোর ঘণ্টা দুয়েকের পথ। গুলিস্তান থেকে প্রতি ঘণ্টায় সরাসরি বারদীর উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। আমাদের যদিও সে সব ঝক্কি কিছুই পোহাতে হল না। বলেছিলাম না, সেই সৌরভ বৈদ্যর কথা। তিনি সাতসকালেই উপস্থিত তার গাড়ি নিয়ে, সারথিসহ। প্রথমে চললাম বৈদ্যবাবুর কারখানা দেখতে। তার জামাকাপড়ের কারখানা। তিনতলা জুড়ে। একতলায় ছিমছাম বড় অফিস। আলাপ হল তার ব্যবসা-সাথী রাণাবাবুর সাথে। বৈদ্যবাবু সব ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখালেন। সে এক বিশাল কান্ড কারখানা। কোথাও কাপড় কাটা হচ্ছে, তো কোথাও সেলাই আবার কোথাও ডিজাইন তোলা হচ্ছে। আবার কোথাও নেমে আসছে উঁচু মেশিন থেকে থরে থরে লুঙ্গি। রানাবাবু সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন – ঢাকা দেখলে আপনি বাংলাদেশের কিছুই দেখলেন না। আসল বাংলাদেশ দেখতে হলে চলে যান গ্রামবাংলায়, নিদেন পক্ষে পুরানো ঢাকায়। তো গিয়েছিলাম পুরানো ঢাকায়। সে অভিজ্ঞতায় পরে আসছি। আপাতত লাঞ্চ এবং বিবিধ সামগ্রী, অবশ্যই ইলিশ, সহযোগে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে না তুলতেই এবার বেড়িয়ে পড়তে হল। বেরোবার আগে অবশ্য আমার স্ত্রীর একটা উপহার-লাভ হয়েছে। বৈদ্যবাবুরা তাকে দিলেন একখানি পাঁচ অঙ্কের ঢাকাই জামদানি।


এবার পাখির চোখ বারদি। বৈদ্যবাবু আর গেলেন না। আমাদের গাইড এবার বৈদ্যবাবুর ড্রাইভার কামাল। একেবারে গ্রাম্য সরল ছেলে একটি। যেতে যেতে কত কথাই যে বলছিল। বাংলাদেশের কথা, নিজের কথা। এদিকে যত পথ কমে আসছে ততই বুকের কাঁপুনি অনুভব করছি। বারদি গ্রামে ঢুকতেই অজান্তে কখন চোখে জল এল। মনে হল এই সেই সব মাটির রাস্তা, যে পথ ধরে কতই না হেঁটেছেন আমার পুর্বপুরুষেরা, পুর্বনারীরাও। গ্রামের পুকুর, জলাজমি, ঘাস-মাটি, কচুবন, ঘাসে ঢাকা মাঠ-প্রান্তর, চেনা-অচেনা গাছপালা – এ সবই সাক্ষী একদিন আমরা ছিলাম এই গ্রামেতেই, সে গ্রামের মাটিতে এবার আমি। মনে পড়ল একবার এই বারদি’কেই স্বপ্নে দেখে আমি লিখেছিলাম -


                           এক অসীম শান্তি ... আমার ডাইনে বাঁয়ে,
                           সামনের অপ্রশস্ত মাটির পথ পেরিয়ে,
                           আদিগন্ত খোলা মাঠ...সোনারং গুলে দেওয়া...
                           আমার মাঠের ধান...


                          সবে ভোর ভোর,
                          মাটির দাওয়ায় আমি...চোখ ধুইনি এখনও,
                          আমার গ্রাম-বাংলাকে দুচোখ ভরে দেখি,
                          এখনও পুর্নভোর হয়নি...


                          আমি প্রতীক্ষায়।


প্রতীক্ষা তাহলে এতদিনে শেষ হল! মনে হল এই তো স্থান, এই পথে, এই মাঠে ঘুড়ে বেড়াবারই তো কথা ভেবেছি শয়নে-স্বপনে। সুন্দরে অপরূপ গ্রাম-বাংলা। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পিঠা-পুলি – সব সব মিলিয়ে এই তো দেশ, এই তো সোনার বাংলাদেশ।


গাড়ি এসে থামল লোকনাথ বাবার মন্দিরের সামনে। সামনে বিশাল মাঠ। এই মাঠ আর লোকনাথ বাবার সুবিশাল মন্দির চত্বর সমেত সবটাই ছিল নাগেদের জমিদার বাড়ি। এখন কিছুই নেই। স্থানীয় মানুষ জানালেন নাগবংশ এখনো আছে একটু দুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পূজা দিলাম বাবার মন্দিরে আমি আর মেয়ে। অনেকটা সময় কাটালাম পিছনের আমবাগানে। কথা বিশেষ বলতে ইচ্ছা করছিল না। খুব বাবার কথা মনে পড়ছিল। তিনি দেখে যেতে পারলেন না। এবার আমি তাকে শোনাব সব গল্প। যদিও গল্প হলেও সত্যি। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। এখানে এখনও প্রকৃতির সজীবতা আর নিবিড় নিঃস্তব্দতার মাঝে ভক্তির পূর্ণ অস্তিত্ত্ব বিরাজমান। যাই হোক, একটা বেদনা-বিধুর অথচ আনন্দ-ঘন অনুভূতি নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। আবার আসব এই আশা নিয়েই। মনে থাকবে মন্দির চত্বরে সেই ভিখারিনীর কথা যিনি শুধুমাত্র একটি ভারতীয় মুদ্রা চেয়েছিলেন, রেখে দেবেন বলে। দিলাম। তার সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, তারও এপার বাংলায় বাড়ি ছিল, চলে যেতে হয়েছে একদিন সবকিছু ফেলে, শুধু সুখ-স্মৃতিটুকু সম্বল করে। একবার ভাবলাম নিয়ে যাই একমুঠো মাটি, পড়ে ভাবলাম – নাঃ থাক, থাক আমারই একান্ত হৃদয়ে।


বিকেল ঘনিয়ে আসছে। নিভে আসছে একটু একটু করে দিনের মিঠে আলো। তবু জ্যোতি বাবুর পৈত্রিক ভিটেটুকু দেখতেই হয়। গেলাম। আবার হারালাম ইতিহাসের পাতায়। বাড়িটি জ্যোতি বাবুর বাবার। এখনো পিছনের দেওয়ালে বাবা-মার নাম খোদাই করা আছে। কাগজে টুকে নিলাম। ‘ডাঃ এন কে বসু, শ্রীমতি হেমলতা বসু, তারিখ ১৩ই অগ্রহায়ণ ১৩২৯ বাং, পাঁচু ওস্তাগার’। যদিও ‘পাঁচু ওস্তাগার’ কেন লেখা বুঝলাম না। দ্বিতল বাড়িটি পশ্চিমবঙ্গের কিশোর বাহিনীর (২০১০) সৌজন্যে আজো দাঁড়িয়ে আছে। এই সময়ে একটি মুসলিম পরিবারের দখলে। বাড়ীর বারান্দায় হাত ছোঁয়ালাম। এই বারান্দায় কতই না খেলা করে বেড়িয়েছেন বালক জ্যোতি বাবু। এই বাড়ি থেকেই তিনি বিলেত চলে যান, সেখান থেকে কলকাতায়। কথিত আছে, বারদি গ্রামের এক মুসলিম মহিলার দুগ্ধ পান করে তিনি বড় হয়েছেন (সুত্র: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, জনকণ্ঠ-১৮ জানুয়ারি ’১০)। বাংলাদেশের সাথে ছিল জ্যোতি বসুর আত্মার সম্পর্ক  এবং কৈশোরের স্মৃতির টানে, মাটির টানে, নাড়ির টানে তিনি বারবার ফিরে আসতে চেয়েছিলেন বারদি গ্রামে। বারদি গ্রামকে তিনি কোনদিন ভুলতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসু সপরিবার এই বাড়ি দেখতে বারদিতে আসেন। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে জ্যোতি বসু নিজের মেয়ের মত স্নেহ করতেন। এই সময়ে তাঁর বাড়ীর সামনেই তাঁর নামে নামাঙ্কিত একটি দ্বিতল পাঠাগার নির্মান করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাঠাগারের দেওয়ালে লেখা আছে – ‘জ্যোতি বসু স্মৃতি পাঠাগার ও সেমিনার হল, বারদী, সোনারগাঁ, নারায়নগঞ্জ’। বড় শান্ত, সমাহিত সেই পরিবেশ। ভেতরে গিয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দরজা তালাবন্ধ আর ধারেকাছেও কেউ নেই। সুতরাং পিছনে পড়ে থাকল স্মৃতি, আমরা এগিয়ে চললাম চারচাকায় ভর করে।


কামাল বলল – তাজমহল দেখবেন না? তাজমহল! এই গ্রামে? পোলায় কয় কি? বিস্ময়ের রেশ কাটতে না কাটতেই সে হাজির আমাদের নিয়ে বড়পা গ্রামে। নিঝুম গ্রাম্য পরিবেশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে চারতলা সমান এক তাজমহল। সাদা পাথরের তৈরি। নিশ্চয়ই পাঠকসমুদয় আগ্রার স্মৃতি রোমন্থন করবেন না। তবে সেই তাজমহল না দেখে থাকলে (যেমন আমি দেখিনি) বড় ভাল লাগবে। অন্তত প্রচেষ্টাটি বাহবা কুড়োবার মত। আমার স্ত্রী ক্যামেরার পিছনের মানুষ, তাই বুঝতেই পারছেন সমগ্র যাত্রাপথে ঘনঘন ক্লিক ক্লিক। সবই সঞ্চিত টাটকা স্মৃতির তাগিদে। এবার ঘরে, থুড়ি হোটেলে ফেরা। বড়পা গ্রামেই এক স্থানীয় রেস্তোরাঁয় পেট ঠান্ডা করে (এই ঘোরাঘুরিতে কখন দুপুরের খাবার তলিয়ে গেছে) ফিরে চললাম। বিদায় বারদি। সুযোগ পেলে আসব আবার। ততক্ষণ ভালো থেক। ফেরার পথে একবার বৈদ্যবাবুকে ছুঁয়ে সোজা রমনা ও ডিনার এবং বলাই বাহুল্য ঘুম। বিছানা ছোঁয়া মাত্রই।