অবশেষে রিক্সা করে বইমেলা। রাস্তার দুদিকে – একদিকে বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গন অন্যদিকে সুহরাওয়ার্দ্দী উদ্যান। মানে দুইদিকে খোলা মাঠের মত জায়গায় সে এক ভারি হইহই-রইরই কান্ড। শুধু বই, বই আর বই। বই ছাড়া আর কিছুই নেই। দেখেও চোখের শান্তি, মনের আরাম। যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা নামক এক ভদ্রলোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গনে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই মেলায় দেশের খ্যাতনামা সব প্রকাশনী, বই বিক্রেতা ছাড়াও দেশের বাইরে, যেমন ভারত, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশ থেকেও নানা প্রকাশনা সংস্থা তাদের বই ও প্রকাশনা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।  যাই হোক আমি তো একপ্রকার দৌড়ে পৌঁছলাম জাগ্রতি প্রকাশনীর স্টলে। নিমেষে হাতিয়ে নিলাম গোটা ১৫টা ‘শতরূপে ভালোবাসা’র কপি। বলাই বাহুল্য সবগুলোই আমার জন্য নয়, একটা রেখে বাকিগুলো হবে আমার বাংলার কবিমানুষদের জন্য সামান্য উপহার। বাংলা কবিতার আসরের কবিদের মধ্যে এই বছর শুধু আমিই এসেছি বাংলাদেশে। বিভূতিবাবুর আসার কথা ছিল, আসতে পারলেন না মায়ের অসুস্থতার কারনে। আর ‘শতরূপে ভালোবাসা’ দু-বাংলার মানুষদেরই সম্পদ বিশেষ। তাই পশ্চিমবঙ্গের অন্ততঃ চৌদ্দজন কবিকে খুশী করতে পারলে আমার চেয়ে বেশী আনন্দিত আর কেউ হবে না। পরে দেশে ফিরে মনে হয়েছিল – ইসস! আরো ক’খানা আনতে পারতাম! ২১শে বইমেলা থেকে বই কিনে উপহার দেবার আরেক উদ্দেশ্যও আছে। ইন্টারনেট থেকে এপার বাংলার মানুষেরা বইটা কিনলে গুনতে হবে প্রায় আড়াইগুন পয়সা।


আজ বইমেলা থেকে এবার অনেক বই কিনলাম, অনেক বই উপহার পেলাম। কোনো কোনোটা কবি’র সাক্ষর সমৃদ্ধ – আমার বাকি জীবনের সম্পদ। কিছু কিছুর নামোল্লেখ করতে চাই। আঁধারে কান্না হাসে (আনিছুর রহমান), রাসেলের প্রাণ কাঁদে (কবীর হুমায়ূন), অর্ঘ্য (শিমুল শুভ্র), মননের মানচিত্র (সরকার মুনীর), দুঃখবোধের সরলতা (কবীর হুমায়ূন), স্বপ্ন কাজল (অনিরুদ্ধ বুলবুল), কবিগান – ইতিহাস ও রূপান্তর (স্বরোচিষ সরকার)। শেষের বইটা দিয়েছেন কবীর হুমায়ূন। এখন আর কবিতা লিখছি না, এই সময়ে এই বইটাই পড়ছি। এদের জন্য আমার ‘যাপিত হৃদয়’ নিয়ে আসতে পারিনি। পরে অবশ্য কলকাতায় ফিরে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়ে ছিলাম। যাই হোক, এইসব করতে করতেই এসে গেলেন কবীর হুমায়ূন ভাই, সাদরে আহ্বান করে নিলেন আমায়। একটু পরেই যোগ দিলেন সদাহাস্যময় রসিক মানুষ মাসুমভাই। বিশ্বাস করুন, মনেই হচ্ছিল না জীবনে প্রথমবার এঁদের সঙ্গে দেখা। এত উষ্ণ মানবিকতা এঁদের। শতচেষ্টা করেও ভোলা যায় না যে! যে দুজনের কথা বললাম (তার সাথে আগুন নদী এবং যাদের কথা বলতে যাচ্ছি) এঁদের ভালোবাসা আমার সারাজীবন পথের পাথেয়। হুমায়ূন ভাইয়ের অগাধ কাব্য জ্ঞান আর মাসুম ভাইয়ের সরলতা আমাকে মোহিত করে রাখবে আজীবন। আর আতিথেয়তা যা পেয়েছি তার কথা বহুমুখে উল্লেখ করলেও যারা এঁদের সরাসরি সান্নিধ্যে আসেন নি, তারা অনেকটাই বুঝতে পারবেন না। পরে একদিন হুমায়ূন ভাই আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন - দুই বাংলার মধ্যে তফাৎ কি বুঝলেন? আমি বলেছিলাম – আমাকে ছোটবেলায় এক অবাক প্রশ্নের মুখে বারবার দাঁড়াতে হয়েছে – মা ভালো না বাবা ভালো? এই ব্যাপারটা ঠিক সেইরকম। একদিকে আমার মাতৃভূমি, অন্যদিকে পিতৃভুমি। তফাৎ কি করে করি বলুন তো! এই বাংলায় হয়ত অনেক সমস্যা আছে, বীভৎস যানজট, ট্রাফিক আইনের চরম অব্যবস্থা, দারিদ্রতা, রাজনৈতিক ডামাডোল, প্রাণহানির আশঙ্কা, দ্রব্যমূল্য, গাড়িভাড়ার আকাশছোঁয়া অবস্থা...., তবু এত কিছু ছাপিয়েও আছে আপামর মানুষের আতিথেয়তা, সুব্যবহার, নিপাট ভালোবাসা, যার তুলনায় আর সবকিছুই তুচ্ছ মনে হয়। এই দুজনের কথাই ধরুন, একজন ব্যাংকের ব্যস্ত অফিসার, অন্যজন বড় ব্যবসায়ী (একই কথা বৈদ্যবাবুর ক্ষেত্রেও খাটে) তবু সব কিছু অবজ্ঞা করে প্রথমজন মীরপুর থেকে অন্যজন বনানী থেকে নিয়মিত সঙ্গ দিয়ে গেছেন। আমাদের হোটেলের গেট অবধি পৌঁছে দিয়ে অত রাতেও ফিরে গেছেন নিজের নিজের বাড়ি। এমনকি রিক্সায় তুলে দিয়ে ভাড়াটাও রিক্সাওয়ালার হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন, আমাদের শত আপত্তি সত্বেও। পরে আরেকজনের কথা বলব, যিনি চরম অসুস্থ দেহেও নিজে গাড়ি চালিয়ে এসেছেন উত্তরায়, ৬ তলা সিঁড়ি ভেঙ্গে এসেছেন শুধুমাত্র আমার সঙ্গে আলাপ করবেন বলে, শুধু তাই নয়, আমাদের সেই গাড়ি করেই পৌঁছে দিয়েছেন উত্তরা থেকে বইমেলায়, যে মানুষটার সেইদিনই ফরিদপুর যাবার কথা। ভাবা যায়! ভোলা যায়! আপনারাই বলুন!


যাইহোক, এরপর খাওয়া দাওয়া হল। চিকেন, বিফ সহযোগে। এই বেলা বলে রাখা ভালো, খাবার নিয়ে আমার কিন্তু কোন ছুৎমার্গ নেই। পৃথিবীর সব খাদ্যই চেখে দেখবার ইচ্ছে রাখি। আমি এর আগের বছর ব্যাংকক যাবার যে পরিকল্পনা করেছিলাম তার অন্যতম কারন ছিল – স্কুইড আর অক্টোপাস চেখে দেখা। তো ব্যাংকক যাওয়া হল না ঠিকই, তবে মেয়ের কল্যাণে একদিন কলকাতায় বসেই আমার স্কুইড খাওয়া হয়ে গেলো। যাইহোক, আমার এই নিরালম্ব খাদ্যাভ্যাসের আভাসটুকু পেয়েই হুমায়ূন ভাই হাঁক ছাড়লেন – এই কে আছিস, গরু নিয়ে আয় গরু। বইমেলার মাঠে এই খাবারগুলো, বিশেষ করে আমতেল দেওয়া বিফের আইটেমটা – আঃ! লা জবাব! প্রচুর আড্ডা হল। আমার স্ত্রী এবং মেয়েও প্রচুর আনন্দ পেয়েছে সেটা তাদের মুখের মানচিত্র পড়েই বুঝতে পারলাম। ঈশানীকে তার বিশেষ প্রিয় দুরঙ্গা আইসক্রীম কিনে দেবেন বলে হুমায়ুনবাবু তো রীতিমত ছোটাছুটি শুরু করে দিলেন, ভালোবাসা যা দিলেন তা একেবারে নিজের মেয়ের মত। ক্লিক ক্লিক ফটো উঠে গেল পটাপট। যাইহোক, এবার বইমেলা থেকে যাওয়া হল শহীদ মিনার। রাতের আলোয় দেখলাম অমর শহীদ মিনার, প্রথম বার, দুচোখ ভরে। সেজে উঠছে একটু একটু করে। ৩ দিন পরেই সেই মহান দিবস। আবার আসব এই মিনারের পাদদেশে ২১শের সকালে, মনে মনে স্থির করলাম। এরপর বেশ রাতে বাড়ি ফেরা, ডিনার, ঘুম। বলাই বাহুল্য আগুন নদী কিন্তু আমাদের সাথেই ছিলেন, দূরভাষে, সবসময়। আর রোজ রাতেই কথা হয় মিতা’র সাথে। অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিই। ও’র সাথে কথা বলতে বলতেই মনে পড়ে – যাঃ! কেটে গেল বাংলাদেশের আকাশের নিচে একটা দিন। কি তাড়াতাড়ি!