একেবারে ঠিক রাত তিনটেয় ফোন দিলেন আগুন নদী। বাংলা কবিতার আসরের এই স্বনামধন্য কবিকে আলাদা করে নিশ্চয়ই চিনিয়ে দিতে হবে না। সেই আগুন নদীর ফোন এলো কাঁটায় কাঁটায়। দিনটা ছিল ১৮ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৫। কি করে তাকে বোঝাই ঘুম কি আর রাতে এসেছে? আজ ভোর চারটেয় বেরোতে হবে। তার উপর বাংলাদেশ। নিছক বেড়াতে যাচ্ছি বললে নিশ্চয়ই কিছুই বলা হয় না। আমার পিতৃভূমি (এবং আমার স্ত্রীরও)। একদা এই দেশে ঢাকা জেলার বারদি (মতান্তরে বারুদী) গ্রামের জমিদার ছিলেন আমাদের পিতৃপুরুষ শ্রীকামিনী কুমার নাগ। প্রতাপশালী জমিদার। ভীষণ প্রজাবৎসল। সুতরাং বাংলাদেশের সাথে আমার একটা নাড়ির যোগাযোগ আছেই। যে দিগ্বিজয়ী মহামানবের আলোয় আলোকিত এই বারদি গ্রাম, তিনি হলেন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষ শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী। কামিনীকুমার নাগ মহাশয় এই সাধু পুরুষটিকে প্রথম আশ্রয় দেন, তাকে থাকার জন্য জমিপ্রদান করেন এবং জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। জানিয়ে রাখি, আমরা এপার বাংলায় চলে আসি স্বাধীনতা তথা দেশভাগের অনেক আগেই। আমার বাবার বয়স এখন ৮৮। তার যখন দেড়/দুবছর বয়স, তার বাবা-মা চলে আসেন এপার বাংলায় বাচ্চাদের হাত ধরে। আমার বাবারও ইচ্ছে ছিল জীবৎকালে একবার বারদি ঘুড়ে আসেন। পারেন নি। এখন দৃষ্টিশক্তিহীণ। তাই আর প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং আমিই যাচ্ছি বাবার প্রতিভু হয়ে। প্রথমবার। পিতৃপুরুষের দেশে। ঘুম কি আর আসে?
যাইহোক, আবার ফিরে আসি ১৮ই ফেব্রুয়ারীর কথা, তার আগে কি টেনশন! একে প্রথম বিদেশ সফর, তায় বাংলাদেশ। টেনশনের চাপে দেড় মাস আগেই ভিসার আবেদন করে বসে আছি। কিছুতেই পাচ্ছি না। অবশেষে চিন্তা মিটল, পেলাম ভিসা। পাশে পেলাম আগুননদীর মত একজন কবিবন্ধুকে, যার অবদান এই কালো কালো অক্ষরের ধাঁচে কিছুতেই বাঁধা যাবে না। ৩ দিন আগে থেকেই ক্রমাগত তার ফোন আসা চালু সুদুর মালয়েশিয়া থেকে। একবারে অভয়বাণী যাকে বলে, দাদা কিছু চিন্তা করবেন না। কোন হোটেলে যাব, কিভাবে যাব, কার সাথে দেখা করব সব সব কিছুর আগাম খবর দিয়ে একেবারে নিজের জনের মত আগলে রেখেছেন সদাই। পাশাপাশি বাংলা কবিতার আসরের ওপার বাংলার অনেক কবিই সাড়া দিলেন, দিলেন পাশে দাঁড়াবার আশ্বাস। কবীর হুমায়ূন ভাই তো 'আলোঘর'-এর নিজস্ব একটি আবাসিক ব্যবস্থায় আমাকে গুঁজে দেবার একটা ব্যবস্থা পাকাই করে ফেললেন। ওপার বাংলার অনেক কবি সানন্দে আহ্বান জানালেন আমায়। তাদের কথা যথা সময়ে বলব। কেউ কেউ সজাগ করলেন আমায় সেদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়েও। কিন্তু বন্ধু, পথে যখন নেমেছি, তখন দাঁড়াতে তো পারব না! সামান্য পেট্রলবোমার সাধ্য কি আমাদের অসামান্য ইচ্ছাশক্তির গতিরোধ করে?
যাই হোক, আগুন নদীর অভয়বাণী সঙ্গী করে কাঁটায় কাঁটায় ভোর চারটেতে বেড়িয়ে পড়া গেল। আমার সাথে আমার স্ত্রী সুমিতা আর কন্যা ঈশানী (হুমায়ূন ভাইয়ের ভাষায় ‘পিচ্চি মেয়ে’)। ৩/৪টে লাগেজ ট্যাঁকে করে সোজা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। পথে আরো একবার আগুন নদীর ফোন এলো। সব ঠিকঠাক জেনে নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। এক অজানা উত্তেজনা থেকে থেকে কাঁপিয়ে যাচ্ছে হৃদয়। একই অবস্থা আমার স্ত্রীরও। ওরও অনেক আগের জন্মের মানুষজন ফরিদপুরের বাসিন্দা ছিলেন। এখনো কেউ কেউ রয়ে গেছেন সেথায়। জানিনা সেথায় যাওয়া হবে কিনা এযাত্রায়। বিমানবন্দরে প্রবেশ করে এক এক কাপ কফি খাওয়া গেল। যথারীতি চেক-ইন করে চেপে বসলাম জেট এয়ার ওয়েজের বিমানে। সবে সিটবেল্ট খুলে গুছিয়ে পাউরুটিতে কামড় দিয়েছি, ঘোষণা হল আমরা নামছি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। যাঃ বাবা! চলে এলো! মরণপণ করে সিট বেল্ট বেঁধে পাউরুটি গিলতে লাগলাম। নেমে দাঁড়ালাম ঢাকার মাটিতে। আঃ! একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলাম। হ্যাসম্যাস পোলামাইয়া তাগো দ্যাশের মাটিতে আইয়া খাড়াইসে!
আমার স্ত্রীর একজন ছাত্রীর দিদি, জামাইবাবু থাকেন উত্তরায়। তিনি তার ব্যাবসাপত্র লাটে তুলে দিয়ে একখান ঢাউস গাড়ি নিয়ে সকাল থেকেই বিমানবন্দরের সামনে অপেক্ষমাণ। নাম সৌরভ বৈদ্য। চেক আউট করতে করতে দেরীই হয়ে গেল। তার আগে অবশ্য খানিকটা ভারতীয় রুপী বাংলাদেশী টাকায় রূপান্তর করে নেওয়া গেল। হিসাব অনুযায়ী দুই দেশের টাকার হিসেবটা হল এক রুপীর অনুপাতে ১ টাকা পঁচিশ পয়সা। শেষমেশ বাইরে এসে দেখি সদাহাস্য মুখে হাজির বৈদ্যবাবু। তিনি তো তার বাসায় নিয়ে গিয়ে তুলবেনই। আমরাই তাকে কোন মতে আটকে চললাম আগুন নদীর কথামত রমনা হোটেল। ৪৫, বঙ্গবন্ধু এভেনিউ। আগুন নদী ভাইএর সৌজন্যে ৯০৬নং ঘরে ঠাঁই হল। আলাপ হল আগুন নদীর চেনামানুষ 'আরমান' নামক একটি অল্পবয়সী ছেলের সঙ্গে। একে ভোলার নয়। এর কথা পরে বলব। ন’তলার ওপর থেকে নিচে জ্যামজমাট গুলিস্তান আর ওপরে আদিগন্ত খোলা আকাশ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম – এই বাতাসেই কোথাও না কোথাও মিশে আছে আমার কয়েক কয়েক কয়েক জন্মের আগের মানুষজনদের শেষ নিঃশ্বাস। হায় দেশভাগ! হায় রাজনীতির নোংরা ষড়যন্ত্র!
তবে চিন্তায় নিমগ্ন থাকা গেল না বেশীক্ষন। একে একে ফোন দিতে লাগল – আগুন নদী ভাই, কবীর হুমায়ূন ভাই, মহিউদ্দিন মাসুমভাই, অনিরুদ্ধ বুলবুল সাহাব ইত্যাদি। শুভেচ্ছায় ভেসে গেলাম আমরা। একটু পরে নিচে নেমে এলাম। পায়ে না হাঁটলে কি আর কোন জায়গা জানা যায়? প্রচুর হকার সমৃদ্ধ (আমাদের এসপ্ল্যানেড মনে পড়ে গেলো) ফুটপাথ। একটা গ্রামীন ফোনের সিমকার্ড পেয়েছিলাম বৈদ্যবাবুর কল্যাণে। সেটা রিচার্জ করলাম। সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে তো। একটা স্থানীয় সিগারেট চেখে দেখলাম। নামটাও চমৎকার। ডার্বি। স্বাদ মন্দ নয়। কিছু লজেন্স কিনলাম চুঙায় (ঠোঙ্গায়) আর কিছু স্ট্রবেরী। খুব যে দরকারি তা নয়, তবু...। দুপুরে হালকা ঘুমের আস্তরণ পেরিয়েই বিকেলে ছুট ছুট বইমেলায়। এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি। ২১শে বইমেলার নাম সুখ্যাতি শুনে আসছি সেই বাল্যকাল থেকেই। যদিও নিজের চোখে দেখাটা একটা স্বপ্নবিশেষ ছিল। তো আমার ধারণা ছিল ২১শে বইমেলা ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু। ভুল ভাঙল টিকিট কাটার পরেই। বাংলা কবিতার আসরের কবিরা রে রে করে আমার ভুলটা ধরিয়ে দিলেন। ২১শে বইমেলা চলে গোটা ফেব্রুয়ারী মাস ধরে! আমার এবার আপসোস হল, ইসস! আগে জানলে! তাহলে ‘শতরূপে ভালোবাসা’ মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে থাকতে পারতাম! যাকগে! গতস্য শোচনা নাস্তি!