"আরিয়ান, ঐ যে তোর কাকু চলে এসেছেন গাড়ী নিয়ে" , বন্ধুর কথা শুনে কলেজের করিডোরের বাইরে মুখ বাড়িয়ে আরিয়ান দেখল আজও ছুটির আগেই কাকু এসে গাড়ীটা পার্ক করে দাঁড়িয়ে আছে । সারাটা রাস্তা আরিয়ান মুখ গোমড়া করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল, একটা কথাও বলল না । বাড়ী ঢুকেই দুম করে নিজের ঘরে দরজা লাগিয়ে দিল ।
আজ আরিয়ান দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, মায়ের কাছে উত্তর না পেয়ে কিছুতেই ছাড়বে না । রাতে মা ডিউটি থেকে ফিরলে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করল ,আরিয়ান "মা , কাকু তোমার কে হয়? আমাদের সাথে ওর কী সম্পর্ক?" ,
ক্লান্ত চোখে একবার ছেলের দিকে তাকিয়েই ওর মা বললেন, "দাঁড়া, বসতে দে একটু, আঠারো ঘন্টা পর বাড়ী এলাম" , আরিয়ান অবিচলিত স্বরে বলল, "তোমায় আজ বলতেই হবে মা" , উনি চোখ বন্ধ করে বললেন , "কতবার বলব আমার খুব ভালো বন্ধু?"
একুশ বছরের ছেলেটার গলা ফেটে বেরিয়ে আসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকারে সমস্ত নিস্তব্ধতা,শালীনতার আব্রু চিরে বেরিয়ে আসে একটা প্রশ্ন, "তবে ও আমার ছোট বেলা থেকে আমার বাবা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে কেন? তুমি বল আমার বাবা মরে গেছে আমার জন্মের আগেই, তাহলে ওকে বিয়ে করে নাওনি কেন? ইললিগাল একটা রিলেশনে থাকতে লজ্জা লাগেনা তোমার? " ।
পাশের ঘরে প্রতিদিনের মত ওর মা ফিরে আসা অব্দি আরিয়ান সঙ্গ দেওয়ার জন্য ছিলেন আরিয়ান চ্যাটার্জি, চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে ওর মুখে একথা শুনে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন ।
এরিয়ানের গালে প্রথমবার ওর মা একটা 'ঠাস' করে চড় মেরে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন , "আমার ভাবতেও ঘেন্না লাগছে এতদিন নিজের দেওয়া শিক্ষায় কতখানি গলদ থেকে গেছে, মানুষ হয়ে ওঠা তো দূরস্থ,তুই বড়দের সম্মান দিয়ে কথাও বলতে শিখিস নি আরি"। অপ্রত্যাশিতভাবে আরিয়ান প্রথমবার মা'কে সেদিন যে কথাটা বলে এক মূহূর্তে চিরদিনের মত ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে বেরিয়ে এসেছিল সেটা আরো একবার আজ ওর নিজের কানে প্রতিধ্বনিত হল, "বড়দেরও সম্মানটা রক্ষা করতে জানতে হয়, ঘেন্না আমার তোমায় দেখে লাগছে মা......."
গাড়ীর কাঁচের ওপারে গড়ের মাঠটা আজও আরিয়ানের দৃষ্টি উদাস করে দিল, ঠিক দশবছর আগের দিনগুলোর মত ।
সে রাত্রে বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসার পরও তো এই গড়ের মাঠই আরিয়ানের কাছে একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল । স্কলারশিপের টাকাটা ছাড়া আর কিছুই সম্বল ছিল না , পকেটটার সাথে রাতের গড়ের মাঠটার কী অদ্ভুত মিল !
সেই টাকাটা হাতে নিয়েই ও পা রেখেছিল মুম্বইয়ের মাটিতে, মাসকতক পর হয়েও গিয়েছিল স্বপ্নের কলেজে পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশনের অ্যাডমিশন... মায়ের স্বপ্ন....কত আশা ছিল এই দিনটাকে ঘিরে... আজ সেই দিনটা এল অবশেষে...কিন্তু ওর পাশে কী অদ্ভুত শূন্যতা, সেই আদর্শময়ী নারীর মুখটা বার বার ভেসে উঠছে কেন? 'মা' ডাকের পবিত্রতা এক নিমেষে সে তো নিজেই নষ্ট করে দিয়েছে ঐ লোকটার সাথে এই বয়সে সম্পর্কে জড়িয়ে! ছিঃ!!! প্রচন্ড ঘেন্নায় সমস্ত দুর্বল অনুভূতিকে দূরে ঠেলে আরিয়ান এগিয়ে গিয়েছিল এক নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে । ওর নিজের নামটার ওপরেও ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল , ঐ লোকটার সাথে কী তবে প্রথম থেকেই মায়ের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ছিল?? তাই কোনোদিনও বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই মা এড়িয়ে যেত!! তাই ওর নামটাও ঐ আরিয়ান চ্যাটার্জি নাম মিলিয়ে রাখা!!!
সেই থেকে নিঃসঙ্গ জীবন কাটানো শুরু হল আরিয়ানের । মুম্বই থেকে ক্রমোন্নতিতে বিদেশ , স্বপ্নের উড়ান ।
তবে বিদেশভূমিতে থাকা , প্রাত্যাহিক জীবনযাপন , ব্যয়বহুল পড়াশুনো ইত্যাদি প্রয়োজনীয়তার সাথে নিজের জমানো পুঁজিটার ক্রমেই ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক তৈরী হতে থাকল , প্রতিদিনের প্রয়োজন যত বাড়ছে , টাকার অঙ্কটা যেন ততই কমে আসছে। তবু নিজের জেদের কাছে হার মানতে শেখেনি আরিয়ান, বাড়ীর বাইরে পা রাখার শুরুর দিন থেকে ওর অ্যাকাউন্টে মায়ের অ্যাকাউন্ট থেকে যে টাকাটা প্রতিমাসে আপননিয়মে ক্রেডিটেড হয়ে যেত,আরিয়ান তৎক্ষনাৎ তা ফেরত পাঠিয়ে দিত , তবুও টাকা আসার নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি একদিনও । শেষে একদিন হাউজরেন্টের বিস্তর ধারের কারনে এরিয়ানের মাথার ছাদটুকুও আর রইল না , পার্টটাইম জবের টাকায় প্রাত্যাহিক খাওয়ার খরচটা কোনোমতে চলে, দিন কাটে ঝাঁ চকচকে আলোকরাশি জড়ানো হাইওয়ের ফুটপাথের ধারে, কখনও বা পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে , কোনোদিন স্ট্রীট ফুড ক্যারাভ্যানে মালিকের দয়ায় গাড়ীর এককোনে । স্বপ্নে ভেসে ওঠে সেই রাতগুলো, শীতের শেষদিকে রাত্রিবেলা ও নিজের ঘরে এসি চালিয়ে দিত, একটুও গরম সহ্য করতে পারত না, মা ভোররাতে এসে ঠিক এসিটা বন্ধ করে গায়ে কম্বলটা টেনে দিয়ে যেত , সকালে চোখখুলে যখন বুঝতে পারত সর্দি লেগে নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা, বেডসাইড টেবিলে হাত বাড়ালেই পিসিএম টা রাখা, সাথে মায়ের হাতে লেখা ছোট্ট একটা প্যাডের কাগজ, "ওষুধটা খেয়ে নিবি, রাতে এসি চালিয়েছিলি" ।
মুখটা মনে পড়তেই ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে বসে আরিয়ান, বাস্তবে ফিরে আসে, ঠান্ডায় কাঁপুনি লাগছে, তবুও ঐ মহিলার স্বপ্ন দেখছিল ভাবতেই ঘেন্নাতেও সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে ।
ওর পকেটের মত ফাঁকা কোনো গড়ের মাঠও তো নেই এখানে, যার সাথে মনের কথা বলে নিঃস্ব রাতগুলো কাটাবে, চারপাশে ছড়ানো ধনবৈভব, প্রাচুর্য , তারই মাঝখানে রিক্ত আরিয়ান.....
জীবন কী অদ্ভুত চক্রে আবর্তিত হয় তাই না? সেদিনের সেই বিদেশের খোলা আকাশের নীচে যে আরিয়ান রাত কাটিয়েছে,সে এতবছর পর নিজের দেশে ফিরে এসেছে ফুটপাতবাসী জীবনগুলোর অভিজ্ঞতা ক্যামেরায় লেন্সবন্দী করে তাদের জীবনকাহিনী বিদেশের ম্যাগাজিনে তুলে ধরবে বলে!!!
পরদিন থেকেই শুরু হল আরিয়ানের এর কর্মঅভিযান । কলকাতার ফুটপাথে হাজার হাজার উলঙ্গ উন্মুক্ত জীবন , ছন্নছাড়া কত কথা ... বেশ কয়েকদিন ওদের সাথে মিশেও এত জীবনসংগ্রামের কাহিনী শুনেও কোনো একটাও আরিয়ানের মনে বিশেষ অনুভূতি জাগাল না । একদিন রাতে হোটেলরুম থেকে বেরিয়ে বেলভেডিয়ার রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে আরিয়ান পৌঁছে গেল ওর পুরোনো রাতের সঙ্গ গড়ের মাঠের ধারে , হঠাৎ চোখ পড়ল ফুটপাথের ধারে একজন প্রৌঢ় মহিলা বসে আপন মনে বকবক করছে.........
আরিয়ানের অবাক লাগল...
ও এগিয়ে গিয়ে মহিলাটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করল ।
না, যা আরিয়ান ভেবেছিল, আসলে তা নয়,মহিলাটি পাগল নন । একটা নতুন গল্পের সন্ধান দেখে বিদেশী ম্যাগাজিনের স্টোরি পিকার আরিয়ান মুখোপাধ্যায়ের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল চিরাচরিত প্রশ্ন, "আপনার নাম কী? ফুটপাথে আছেন কতদিন?........"
এই স্তরের মানুষের সাথে প্রচুর কথোপকথনের অভিজ্ঞতা থাকায় মহিলার জীবনরহস্যে প্রবেশ করতে খুব বেশী সময় লাগল না আরিয়ান । অনেক কথার পর জানা গেল যৌবন যতদিন ছিল ততদিন ওর পুঁজি ছিল দেহ , ও ছিল রাতের কলকাতার পথে এক চলমান ফেরিওয়ালী , দেহ ফেরী করে বেড়াত , সময়ের সাথে যৌবন নিয়েছে বিদায় , তাই ওর বর্তমান বাসস্থান এ ফুটপাথ । ব্যবসা আর নেই , ব্যবসা করার জায়গাটায় ও এখনও বসে আছে , সেই একই রাস্তা , পার্থক্য শুধু এখন আর কেউ ওকে রাস্তা থেকে তুলে প্রতিরাতে হোটেলঘরে নিয়ে যায় না......
মন দিয়ে কথা গুলো গিলছিল আরিয়ান , একদৃষ্টে মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে , হঠাৎ মহিলাটি ওর মলিন কাপড়ে ঢাকা বুকটার মধ্যে থেকে বের করল ছোটো একটা কাগজ টুকরো ... একদৃষ্টে ওটার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল , "জীবনে অনেক পাপ করেছি বাবু , আক্ষেপ নেই, পাপ করে পেট চালিয়েছি , হাত পাতিনি কারো কাছে , কিন্তু একটা পাপের দাগ গঙ্গায় ডুব দিলেও এ হাত থেকে যাবেনা ....."
আরিয়ান অবাক ভাবে বলল, "কোনো বিশেষ ঘটনা?"
মহিলাটা অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, "জ্ঞান হয়ে থেকে জেনেছি মা মরেছে জন্ম দিতে গিয়ে, বাপের খোঁজ পাইনি কোনোদিন, মমতা কী জিনিস তা জানার সুযোগ ছিল কই? দেহ ডাগর হয়ে উঠতে দেহটাকেই ভালোবেসেছি , ভালোবাসার ভাগ চাইবার তো লোক ছিল না কোনোদিন.....যেদিন হল, সেদিন তাকে নিজে হাতে ফেলে দিয়েছি....."
আরিয়ান এহেন দেহব্যবসায়ীর মুখে এত হেঁয়ালিমেশানো কথা শুনে আরও একটু অবাক হয়ে গেল, ও বলল, "খুলে বলা যায়?"
মহিলা একটু চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করল , " পেটের জন্য দেহ বেচতাম বাবু , একদিন দেখলাম পেটটাই আমার শত্রু হয়ে উঠেছে , পেটের ভেতরেই জন্ম নিয়েছে কোন এক খদ্দেরের ছেড়ে যাওয়া নিশানি , যখনই বুঝলাম , গেলাম ডাক্তারের কাছে , পেটের জঞ্জালটা নিকেশ করতে ...
ডাক্তার সাহেবা প্রথমেই না বললেন, অনেক দেরী হয়ে গেছিল নাকি, আমার তো দেহ না তুললে পেট চলবে না, তাও বললাম উনাকে....... উনি কী ভেবে আমায় বললেন, পেটের টাকে জন্ম দিতে , আমার ততদিনের খরচাপাতি উনি চালাবেন , কিন্তু বাচ্চাটাকে যাতে আমি ফেলে না দিই , বাচ্চাটাকে উনিই নেবেন ..আমি এমন সুযোগ হাতছাড়া করিনি, দেড় লাখ টাকা চেয়ে বসলাম । আমি একটু আগে যে বললাম বাবু, নিজেকে ছাড়া কাউকে কোনোদিন ভালোবাসিনি, পথের কাঁটা এত সহজে দূর হয়ে যাচ্ছে তাও আবার টাকার বিনিময়ে, আমার আনন্দের সীমা ছিল না....... বাচ্চাটা জন্মেছিল , তুলে দিয়েছিলাম ডাক্তার সাহেবার হাতে , ভালোই হয়েছে ভেবেছিলাম , আমার কাছে থাকলে আমি তাকে কীই বা পারতাম দিতে! ডাক্তার সাহেবা অবিবাহিত ছিলেন, তা সত্ত্বেও আমার ছেলেটাকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন..." , এই বলে মহিলার মলিন গাল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে এল , চোখ মুছে আবার তাকিয়ে বলা শুরু করল, "কিন্তু বাবু, এ জীবনের আর কয়েকটা দিন বাকী আছে জানিনা, আজ এসে বড্ড একা লাগে গো , খালি মনে হয় সেদিন নিজের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে যদি সব ছেড়ে ওকে নিয়ে বাঁচতে পারতাম , আজ হয়ত ও আমার পাশে থাকত..... " এই বলে ছোট্ট কাগজের টুকরোটার দিকে একবার তাকাল, আরিয়ানের হাতে দিয়ে বলল, " হাসপাতাল থেকে চলে আসার দিন ডাক্তারসাহেবা আমায় এ কাগজখানা দিয়ে বলেছিলেন, আমার যদি কোনোদিন ইচ্ছে হয় আমি উনার বাড়ী গিয়ে ওকে দেখে আসতে পারি , সারাজীবনে একবারও যাবার কথা মনে হয়নি, আজ কাল বুকটা বড় খালি লাগে, যাবার সাহসে কুলোয় না, কী মুখে যাব ?".....
আরিয়ান হাতের কাগজটার দিকে একঝলক দেখল, হলদে হয়ে যাওয়া দুমড়ানো একটা প্যাডের কাগজ ... হ্যালোজেনের আলোয় অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া হরফগুলো আনমনা হয়েই চোখ পড়ল আরিয়ানের, টানা টানা ইটালিক ষ্টাইলে লেখা লাইনগুলো দেখে আরিয়ানের চোখের শিরা উপশিরায় ক্ষনিকের জন্য যেন রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে গেল..... ওর অতি পরিচিত হস্তাক্ষরে তাতে লেখা ছিল কলকাতায় দশবছর আগে ওদের একমাত্র ফ্ল্যাটের ঠিকানা টা ..... নীচের স্বাক্ষরটা দীর্ঘ দশবছর পর আবার দেখল আরিয়ান, 'ডাক্তার স্বাগতালক্ষী মুখোপাধ্যায়" , এই সাইনটা ছোটো থেকে আরিয়ানের খুব প্রিয় , কতবার মা'কে পীড়াপীড়ি করেছে 'মা, আমায় শিখিয়ে দাও না কেমন করে তুমি অমন সুন্দর সই করো....আমিও নিজের সই করব...'
মূহূর্তে আরিয়ান উঠে দাঁড়ায় , ওর পায়ের পেশিগুলো শক্ত হয়ে গেছে , মনের অবস্থা ভাষায় বর্ণনীয় নয় , যত দ্রুত সম্ভব হোটেলে পৌঁছে গাড়ীটা নিয়ে ও বেরিয়ে পড়ল .........
রাত ঠিক এগারোটা দশ , আবার সেই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আরিয়ান, দশটা বছর আগে এই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আরিয়ান এর প্রতিজ্ঞা আর কোনোদিনও এ দরজা বা দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মুখটা দেখবে না , অদ্ভুতভাবে সেদিনও ওর রিস্টওয়াচে বেজেছিল রাত এগারোটা দশ ।
কলিং বেলটা কয়েকবার বাজাতেই দরজা খুললেন ডাক্তার স্বাগতালক্ষী , দেখেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ..
আরিয়ান কোনো ভূমিকা না করে মা'কে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল , "মা , বড় ভুল করেছি মা , অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমায় , অনেক পাপ করেছি তোমায় ভুল বুঝে , ক্ষমা করতে পারবে না ?" , স্বাগতালক্ষী বরাবরের মত নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নিরুত্তাপ, বরাবরের মত স্নেহময়ী হাতদুটো স্পর্শ করল আরিয়ান চিবুক , শান্তস্বরে বললেন , "আমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে না , চাইতে হলে সেই মানুষটার কাছে চেয়ো একদিন যাঁকে অপমান করে নিজের অশিক্ষার পরিচয় দিয়েছিলে...." , আরিয়ান মাথা নীচু করে জবাব দিল, "আজ আমি সব কিছু জানি মা , আমি জানি আমি তোমার মত মহীয়সীর রক্ত নই , আমায় তুমি কোনোদিন মুখ ফুটে কোনো কথাই বলোনি, জানতে দাও নি, যদি বলতে,আমার হয়ত চোখটা এত দেরীতে খুলত না........."
পরদিন সকালে আরিয়ান নিজে গিয়ে আরিয়ান চ্যাটার্জি কে ওদের বাড়ী তে নিয়ে এল । বড় আমুদে লোক এই আরিয়ান চ্যাটার্জি, আরিয়ান ক্ষমা চাইতেই হেসে বললেন, "আরে আমি কিছুই মনে করিনি সেদিন, অবশ্যই তোমার অধিকার আছে, একজন লোক তোমার মায়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে সে আদৌ তোমার মায়ের যোগ্য কিনা তা তো তোমাকেই বিচার করতে হবে , সেদিন তোমার আমায় পছন্দ হয়নি , তাই স্পষ্ট করে আমায় এখানে আসতে বারন করেছিলে"...... দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আরিয়ান নিভৃতে উনাকে বললেন, " আচ্ছা , আপনি মাকে বিয়ে করেননি কেন? আমার জন্য?" , উনি একটু ভেবে বললেন, "কে বলেছে করতে চাইনি? কলেজের প্রথমদিন থেকে চেয়েছিলাম , বলতে পারিনি , স্বাগতা কোনোদিনও আমায় ভালোবাসেনি , স্বাগতা যাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসেছিল সে ওকে ঠকিয়ে চলে গেছে , কলেজজীবনেই, স্বাগতা তখন দুসপ্তাহের প্রেগনেন্ট, সেই ওর অ্যাবরশনের দিন থেকে আমি ওর পাশে থেকেছি, বিয়ে করতে চেয়েছি , স্বাগতাকে কোনোদিন রাজী করাতে পারিনি , হয়ত তোমাকে এতকিছু বলা আমার উচিত হল না...." --- এই বলে উনি থেমে গেলেন ।
উনি চলে যাওয়ার পর আরিয়ান মাকে ডেকে বলল, "মা, একটা সত্যি কথা বলবে? আমার নাম আরিয়ান কেন রেখেছিলে?"
স্বাগতালক্ষী এড়িয়ে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে বললেন, "এ আবার কী প্রশ্ন? মনে এসেছিল তাই..."
আরিয়ান কিন্তু দমল না, ও বলল, "সত্যি বল মা, কেন মনে এসেছিল? চ্যাটার্জি কাকুর মত মানুষকে দেখে ?"
স্বাগতালক্ষী বললেন, "ওটা কাকতালীয়" , আরিয়ান অসহিষ্ণুভাবে বলল, "কাকতালীয় নয় মা, কাকতালীয় নয় , এমন বড় মনের একজন পুরুষকে দেখে জীবনে কোনদিনও তোমার তাঁকে আদর্শ পুরুষ মনে হয়নি অস্বীকার করতে পারো মা? নাকি জীবনে একবার একটা কাপুরুষের সাথে কাটানো কয়েকটা মিথ্যে স্মৃতি সারাটা জীবন তোমাকে বাধা দিয়ে এসেছে?"
স্বাগতালক্ষী অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন একবার, অস্ফুটে মুখ দিয়ে কিছু কথা বেরিয়ে এল, বোঝা গেল না , আরিয়ান কাছে এসে মায়ের মুখটা বুকের কাছে ধরে বলল, "সারাটা জীবন তো সবার কথা ভেবে পঞ্চান্নটা বছর কাটিয়ে দিলে মা, একবারও কী নিজের কথা ভাববে না?"
এই প্রথমবার স্বাগতালক্ষীর দুচোখ বেয়ে নেমে এল অঝোর অশ্রু , আরিয়ান বাধা দিল না , শুধু বলল, "মা, এবার আমি তোমার কথা ভাবব , তুমি ওনাকে বিয়ে করো"।
স্বাগতালক্ষী দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, "তা হয় না আরি, সমাজ কী বলবে! ছেলের বিয়ে দিয়ে পরলোকগমনের বয়স আমার...."
আরিয়ান মৃদু হেসে বলল, "সমাজ সেদিন কোথায় ছিল মা যেদিন তুমি নষ্ট হতে চলা একটা প্রাণকে নিজের বুকে স্থান দিয়েছিলে? সমাজ কি মেডেল দিয়েছিল তোমায়? তবে আজ তুমি বিয়ে করলে সে সমাজ যদি তোমায় মন্দ কথা বলে তা তোমার গায়ে লাগবে কেন?"......
আজ আবার হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসছে আরিয়ান , পাশে আজ আর শূন্যতা নেই , আরিয়ান জীবন আজ পরিপূর্ণতা পেয়েছে , ডানদিকে আছে মা, বাঁদিকে বাবা,আরিয়ান চ্যাটার্জি , আরও একজন আছেন, যাঁকে নিয়ে আরিয়ান আজ ওর ম্যাগাজিনের পাবলিশিং ভেন্যুতে পৌঁছে সোজা স্টেজে উঠল, ওর কভার পেজের নায়িকা , আজ প্রকাশিত হল কভার স্টোরি , "দ্য স্ট্রাগল অফ আ পেভমেন্ট লেডি" , ম্যাগাজিনের পাঠকেরা তাঁকে গল্পটা পড়ে চিনবেন , তবে আশা করি আমার পাঠকরা তাঁকে আগেই চিনেছেন...... ভারতীয় সময় অনুযায়ী ঘড়িতে তখন ঠিক এগারোটা দশ ।