একদিন আমার লাশ বাহী এম্বুলেন্স যাবে
বাপের বাড়ি
একটা ঘোর লাগানো সাইরেনে
লালবাতি জ্বলবে অনির্বাণ।
পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে ক্রন্দনরত দেবতার দল
কেউ করবে আফসোস! কেউ ফেলবে দীর্ঘশ্বাস!
শুধু আমার যাত্রা অনন্তকাল!
আমি ফিরবো সাদা কাফনে
গোলাপ জল আর আতরে
চারদিকে সুগন্ধ ছড়াবে টগর আর শিউলিফুলের
কি সুন্দর সুবাস!
যেন এক ফুসফুস গন্ধ নিয়ে
চিরতরে ঘুমিয়ে থাকা যায়।
মাইকে বলছে হিমুদা আমার সাফল্যগাঁথা
আমার আসার খবর ছড়িয়ে দিচ্ছে
এই নিসর্গে শ্লোকের মতো।
আমার ভীষণ ভালো লাগছে আজ
কষ্টের অর্জিত ডিগ্রি আর ননী মাস্টারের ছেলে শুনে
কি মজার! আমি কত পরিচিত হয়ে যাচ্ছি
এই পার্থিব স্বর্গে।
কত দিন যে স্নান করি নি!
ডাক্তারের চেম্বারে ঘুরে ঘুরে
আজ বহু বছর পর
আমি একটা স্বাভাবিক শুচিতায় ডুব দিয়েছি।
আদিত্যদা, বর্ণদা, সৈকতদা,সোনাদা
সবাই মিলে আজ, আমাকে পরিষ্কার করছে! মাথায় পানি ঢালছে
গায়ে চন্দন,হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে।
আমি মহান সৃষ্টিকর্তার পবিত্র সন্তান
এটা প্রমাণ করার জন্য যেন এই মহাসমারোহ।
আমি ভীষণ আবেগে আপ্লুত!
ব্রাহ্মণ ঠাকুর চলে এসেছে ততক্ষণে
নশ্বর দেহটাকে কি যেন বলে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিচ্ছে
পাশে গীতা প্রতিযোগিতা চলছে যেন
সবাই এক মিহি সুরে পড়ছে প্রতিটি শ্লোক।
আমি সেসব শুনছি খুব মন দিয়ে
নিজেকে এত পবিত্র কখনো লাগেনি!
আজ প্রতিটি শব্দ আমার অবিনাশী স্নায়ুতে
গেঁথে দিচ্ছে বিনুনি করে
যেন এক একটা শব্দের মালা।
দেবতা দেবীরা কাঁদছে হৃদয়ের শ্রদ্ধা থেকে
আমার সন্তানেরা কাঁদছে,কাঁদছে সকলে।
কিন্তু আমার সহধর্মিণী!
সে এক পাথর হয়ে তাকিয়ে আছে অপলকভাবে
আমার দৃষ্টি সরছে না তাঁর সেই
কাজল কালো চোখ থেকে।
আমি তো অতীতে,
সেই চোখের মায়ায় ডুব দিয়েছিলাম।
আজও তাঁর ভিন্ন হলো না
আমি আসক্ত হয়ে পড়লাম
শেষবারের জন্য সেই মায়ায়।
মন্ত্র শেষ হলো ব্রাহ্মণ ঠাকুরের
আমাকে কাঁধে নিলো দেবতারা
আমাকে বিদায় দিতে এগিয়ে এলো
আমার সহধর্মিণী!
আজকে কপালের লাল টিপ কেমন যেনো
ভেস্তে গেছে কপালে! চুলগুলো এলোমেলো।
শাঁখা গুলো ভাঙ্গছে কটমট করে
আমি ভীষণ ভয় পেলাম তাঁকে নিয়ে!
আমাকে আশ্বস্ত করলো যমরাজ
উনি কথা বলেছে নাকি ঈশ্বরের সাথে!
তাই দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হলাম।
দেবতারা আমাকে নিয়ে এলো শ্মশানে
কালিমা,মহাদেবের মন্দির সেখানে
আমি প্রণাম করলাম
নিবেদন জানালাম পরিবারকে দেখে রাখার।
কীর্তনগান চলছে পুরো শ্মশানের ধুধু প্রান্তরে
হরিনাম চলছে পুরোদমে
নেচে - গেয়ে, হাত তুলে
আমিও এই মহানামে যোগ দিলাম
বিলিয়ে দিলাম নিজেকে একনামে।
হঠাৎ দেখি চিতা প্রস্তুত
আমাকে ডাকছে মন্ত্রের দূত।
গেলাম আমি চিতার কাছে
দেখি আমার নশ্বর দেহ ঘুমিয়ে আছে
চিতার উপর গা এলিয়ে।
আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম
এমন করে কি কেউ ঘুমায়?
ইচ্ছে করলো জাগিয়ে দেই
ঘুমিয়ে থাকা দেহটাকে!
পরে ভাবলাম একটু সবুর করে দেখি
ঠাকুর মশায় কি যে বলে!
মন্ত্রের দূত আবার বলে-
ব্রহ্মার রথে চড়তে
বীরদর্পে বসলাম আমি
আগুনের শিখাতে।
ব্রাহ্মণ ঠাকুর মন্ত্র পড়ছে
যজ্ঞে অনেক কিছু আহুতি দিচ্ছে
জ্বলছে প্রদীপ, দীপ,ধূপ কাঠি
বেল, ফুল,ফল পাতা সাজানো
কত কত বরন ডালি!
যজ্ঞের তালে নশ্বর কবজ পুড়ছে
ছাই হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে মাটিতে।
আমার রথ উড়তে শুরু করছে
চিতার উত্তাপ থেকে অসীমে।
আমি গল্প করছি; কবিতা বলছি
এক যমদূতের সাথে
পার্থিব ইতিহাসে আমার কৃতিত্বের বিজয়গাঁথা
যেন তার জানা থাকে।
এক সময় নামিয়ে দিলো সে আমাকে
একদলছুট মেঘের দলে
আমার প্রশ্ন পর্ব চলবে সেখানে।
ঈশ্বর এলো না!
এলো না আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে
আমার ভীষণ রাগ হলো! কষ্ট পেলাম খুব গোপনে
ঈশ্বর সেটা জানতে পারলো
চলে আসলো আমার সামনে।
আমি ভীষণ খুশি হলাম
তাঁকে এত কাছে পেয়ে।
চিত্রগুপ্ত হিসেবে দেখলো পাপ পূর্ণ্যের
পূর্ণ্যের হলফনামায় কিছুটা বেশি ছিলো
আমি স্বর্গে গেলাম
নিরাকার ঈশ্বরের সাথে।