অনেক বছর ধরেই বাংলা সাহিত্যের পাঠক হাইকু শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ হাইকুর সঙ্গে বাংলা ভাষার পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন “জাপানযাত্রী” গ্রন্থের মাধ্যমে। “জাপানযাত্রী” গ্রন্থে হাইকুর সঙ্গে পরিচয় করাতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, “তিন লাইনের কাব্য জগতের আর কোথাও নাই”। এই প্রসঙ্গে জাপানি যে দুইটি হাইকুর অনুবাদ তিনি পেশ করেছিলেন তা হয়তো অনেক বাঙালির মনে আছে। কিন্তু কবিতা উল্লেখ করলেও কবির নাম কিংবা হাইকু নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণে যাননি রবীন্দ্রনাথ। সে কারণে হয়তো এখনো, ‘হাইকু-র উৎপত্তি কোথায়’, ‘বৈশিষ্ট্য কী’ বা হাইকু বস্তুত কী ধরনের কবিতা, এই প্রশ্ন ক’টির উত্তর জানার আগ্রহ অনেকের।
পনের শতকের মাঝের দিকে ‘ওয়াকা’ বা ‘জাপানি পদ্য’তে একটি নতুন ধারায় কবিতা লেখা শুরু হয়, যে ধারার নাম ছিল ‘হাইকাই’। জাপানি ‘হাইকাই’ শব্দটির অর্থ হল মজা, কৌতুক, নিচুতা, পার্থিব ইত্যাদি। এই ধরনের পদ্যগুলোতে কৌতুকের পরিমাণ ছিল বেশি। সবচেয়ে পুরোনো ‘হাইকাই’ দেখতে পাওয়া যায় ৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘কোকিন শু’ নামক একটি ওয়াকা সংকলনের মধ্যে। সে যুগে হাইকাইকে উচ্চশ্রেণির রচনা বলে মনে করা হত না। কখনো কখনো জনপ্রিয় হলেও হাইকাইকে অনেককাল পর্যন্ত ওয়াকার প্রধান ধারার বাইরে রাখা হতো। কিন্তু এদো যুগে (১৬০৭-১৮৬৭) যখন বিখ্যাত জাপানি কবি মাতসুও বাশাও হাইকাই রচনা করেন তার আগে থেকেই হাইকাই নানাভাবে উন্নতি হতে শুরু করেছিল এবং তা সাহিত্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছিল।
একদিকে ওয়াকা’র প্রাচীন ধারায় এর ঐতিহ্য অনুযায়ী সে সময়ের পরিচিত কবিরা একই বিষয়বস্তু এবং প্রায় একই শৈলীতে লিখে চলছিলেন। আরেকদিকে ‘হাইকাই’ লেখা কবিরা নতুন স্বাদের বিষয়বস্তু এবং নতুন শৈলী ও প্রকাশভঙ্গীর সন্ধান করতে করতে ক্রমশ ‘হাইকাই’ কাব্যধারার উন্নতি করছিলেন। সংক্ষেপে বলা যায় যে ওয়াকা’র প্রধান ধারা চিরকালই পরম্পরাকে মেনে চলছিল আর ‘হাইকাই’ এই পরম্পরাকে অগ্রাহ্য করে নিত্য নতুন ক্ষেত্রে রস খুঁজে যাচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষে হাইকাই’র প্রধান বিশিষ্টতা হল নতুনত্ব বা অপ্রত্যাশিতকে পাওয়া। বাশাও এই কথা তার বিভিন্ন রচনায় বারবার বলেছেন। আর হাইকাই-এ কৌতুকের উপাদান সবথেকে বেশি থাকে থাকে-এটাও মনে রাখা ভালো।
এদো যুগে হাইকাই ধারায় সবথেকে বেশি লেখা হতো ‘রেনকু’ কবিতা। ‘রেনকু’ হলো ধারাবাহিকতা রক্ষা করে কাব্য রচনার একটি স্টাইল। অনেক কবি যখন সমবেতভাবে যখন একটি দীর্ঘ হাইকাই রচনা করেন তখন তাকে বলা হয় ‘রেনকু’। পাঁচ-সাত-পাঁচ স্বরের সাহায্যে প্রথমে একজন কবি রচনা করেন প্রথম চরণ। এরপর দ্বিতীয় কবি রচনা করেন সাত-সাত স্বরে দ্বিতীয় চরণ। তারপরে আবার একটি পাঁচ-সাত-পাঁচ স্বরের চরণ রচনা করেন পরবর্তী কবি। এরপর সাত-সাত স্বরের চরণ রচনা করেন চতুর্থ কবি। এভাবে পর্যায়ক্রমে কয়েকজন কবির হাত ঘুরে একটি ‘রেনকু’ জন্ম নেয়। বাশাও যখন কবিতা লেখা শুরু করেন—তখন একটি রেনকুতে ছত্রিশটি চরণ রচনার রীতিই প্রচলিত ছিল। সেকালে হাইকাই সভায় অনেক কবি একসঙ্গে মিলিত হয়ে ‘রেনকু’ কাব্য রচনা করতেন। মাতসুও বাশাও-এর বিখ্যাত ভ্রমণবিষয়ক গ্রন্থ 'ওকুনো হোসোমিচি'-এর মধ্যে ‘সুকাগাওয়া’ ও ‘ওওইশিদা’ অংশে রেনকু সভার বর্ণনা পাওয়া যায়। এই রেনকু সভার কবিদের মধ্যে বাশাও ছিলেন সবথেকে দক্ষ ও জনপ্রিয়। ‘রেনকু’ রচনা করতে গিয়ে হাইকাই সাহিত্যে তিনি নতুন কিছু যুক্ত করেছিলেন যার নাম ‘হাইকু’।
‘হাইকু’ কীভাবে প্রথম লেখা হল সে প্রসঙ্গে বলি—‘রেনকুতে’ প্রত্যেক কবির অংশকে আলাদাভাবে বলা হয় ‘হোক্কু’। রেনকু রচনার সময় যদি বাশাও উপস্থিত থাকতেন এবং তার হাত দিয়ে যদি কোন রেনকু শুরু হতো তাহলে সেটি বেশ ভালো ‘রেনকু’ হয়ে উঠত। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যেতো বাশাও যে ‘রেনকু’ শুরু করলেন, পরবর্তী কবিরা চরণ দিয়ে বাশাওয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না। যে কারণে বাশাও প্রায়ই রেনকুর প্রথম অংশ অর্থাৎ তার হোক্কুকে স্বতন্ত্র করে লিখতেন। শুধুমাত্র পাঁচ-সাত-পাঁচ স্বরের সাহায্যে লিখে একটি হক্কুকে একটি পুরো কবিতা হিসেবে সম্পূর্ণ করে প্রথম দেখিয়েছিলেন বাশাও। যে কারণে তার হাতে স্বতন্ত্র ‘হোক্কু’ জাপানি কবিতার নতুন শৈলী হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এই স্বতন্ত্র হোক্কু-ই আধুনিক হাইকু’র প্রথম নিদর্শন, যে কারণে বাশাওকে বলা হয় হাইকুর পিতা।
হাইকুর ক্ষেত্রে শব্দের “ভগ্নাংশ”, “স্বর” এবং “কিগো” সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাশাও এর পাঁচ-সাত-পাঁচ স্বরের একটি হাইকু ইংরেজি অক্ষরে উদাহরণ দিলে স্বরের বিষয়টি পরিষ্কার হবে। একটি কবিতায় বাশাও লিখেছেন এভাবে :
“ha-tsu shi-gu-re (5)
sa-ru mo ko-mi-no o (7)
ho-shi-ge na-ri” (5)
এর বঙ্গানুবাদ এরকম :
“প্রথম বৃষ্টির ঠান্ডায়
বানরও চায় গায়ে জড়াতে
কিছুটা শুষ্ক খড়’’
এবার ‘কিগো’র প্রসঙ্গে আসি। ওয়াকা বা জাপানি পদ্যে স্বরগণনার প্রচলিত রীতি যেমন অবশ্যপালনীয়, তেমনি আর একটি অলঙ্ঘনীয় নিয়ম আছে। সেটা হল ‘কিগো’ ব্যবহার করা। ‘কিগো’ হলো জাপানি কবিতায় ব্যবহৃত ঋতুসূচক বা ঋতুনির্দেশক শব্দ। জাপানি কবিরা সব সময়েই প্রত্যেক কবিতাতেই ‘কিগো’ ব্যবহার করেন। কোন শব্দটি কোন ঋতুর প্রতীক তা জাপানি সাহিত্যের সুদীর্ঘ পরম্পরায় ক্রমে ক্রমে গৃহীত হয়ে গিয়েছে। যেমন ‘চাঁদ’ হেমন্তকালের ‘কিগো’। যদিও সমস্ত ঋতুতেই চাঁদ দেখা যায়, তবু এই ঋতুর চাঁদকেই পরম্পরাগতভাবে সবচেয়ে সুন্দর মনে করা হয়ে থাকে। বাশাও-এর ‘ওকু নো হেসোমিচি’ গ্রন্থের শেষ পর্যায়ে ‘সুরুগা’ অংশে চাঁদ নিয়ে একটি হাইকু আছে, যেটি হেমন্তেই লেখা। জাপানের সর্বত্রই চার ঋতু—বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত এবং শীত। সুতরাং সেখানে বর্ষা ও শরতের কোন ‘কিগো’ নেই। এবারে একটি ‘কিগো’ ব্যবহারের দৃষ্টান্ত দেব:
“কী গভীর সে নৈঃশব্দ্য
মনে হয় যেন ঝিঁ ঝিঁ’র ডাককেও
ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে শিলাখণ্ডগুলি”
এটিও বাশাও-এর একটি হাইকু। এখানে “ঝিঁ ঝিঁ” এই কবিতার ‘কিগো’। এই কিগো থেকে বোঝা যায় এটি গ্রীষ্মের কবিতা। হাইকু তথা সমস্ত জাপানি সাহিত্যে “কিগো” পাওয়া যাবে। যেমন “পুতুলের উৎসব” বসন্ত কালের, “চন্দ্রমল্লিকা” হেমন্তের কিগো। জাপানি কবিতায় “কিগো” একটি প্রধান উপাদান। গত এক হাজার বছর ধরে জাপানি কবিতার বিষয়বস্তু ও শৈলীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে কিন্তু “কিগো” ব্যবহারের রীতি অপরিবর্তিত রয়েছে। যে কারণে শুধু হাইকু নয়, সমগ্র জাপানি কবিতা বুঝতে গেলে “কিগো” বোঝাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সুতরাং, এককথায় রেনকুর প্রথম অংশ ‘হোক্কু’ আর রেনকু না লিখে তাকে স্বতন্ত্র করে লিখলে যে ‘হোক্কু’ হলো তাইই ‘হাইকু’। বাশাও যখন স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘হোক্কু’ লিখতেন তখন তাকে আলাদা করে ‘হাইকু’ বলা হতো না। ‘হাইকু’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় আরও পরে, উনিশ শতকের শেষের দিকে। নামকরণ করেন শক্তিশালী জাপানি কবি মাশোকা শিকি। মাসোকা সিকি শুধুমাত্র হোক্কুর নাম হাইকু নাম দিয়েই থামেননি। নতুন স্টাইলে হাইকু লিখেও দেখিয়েছেন। তার আগে হাইকু মোট ১৭ স্বরে অর্থাৎ পাঁচ-সাত-পাঁচে লেখা হতো। তিনি দেখিয়েছেন ১১ স্বরেও (তিন-পাঁচ-তিন) হাইকু লেখা যায়। এছাড়া তিনি জাপানি কবিতায়, কবিতা লেখার নতুন একটি ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। এই ধারার নাম হল তানকা। সেই ধারায় বর্তমান জাপানি কবিরাও কবিতা লিখে থাকেন।
যা হোক, যখন বাশাও রেনকুর জন্য হোক্কু লিখতেন তখন অনুসারী কবিদের সুবিধার জন্য নৈব্যক্তিক বা বস্তুনিষ্ঠ বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করতেন। কিন্তু যখন তিনি স্বতন্ত্র হোক্কু লিখতেন তখন ব্যক্তিগত বা অন্তর্মুখী ভাবনা প্রকাশ করতেন। তার লেখা হাইকুর মধ্যে বেশির ভাগ হাইকুই স্বতন্ত্র হোক্কু। কিন্তু মাঝে মাঝে রেনকু’র হোক্কুও আছে।