উত্তপ্ত প্যাডেল,ধারালো কোণা এবং আমার নগ্ন পা,
পায়ের পাতায় শত কাটা-ছেড়া,
শীতের রাতে ফেটে যাওয়া গোড়ালি,
কয়লার আগুনে দগ্ধ এক জোড়া পা।
আকাশ ভেঙে নেমেছে আগুনের বারিধারা,
কাঠফাটা রোদের বেদনা,
সমস্ত দেহ বেয়ে ঘাম ঝরছে,
চাপা বাতাসে আমার সাদা চুল উড়ছে,
বয়স আমাকে থামাতে পারছেনা।
বয়স হোক বা শ্রম,
কাটা-ছেড়া হোক বা আগুন-গরম,
আমি পরোয়া করি না।
আমি এত কষ্টের পরোয়া করি না।
রিকশার হুডি টেনে বসে আছে একজন সুন্দরী নারী,
কথাবার্তায় কোমল,পড়েছে শাড়ি।
কপালে চন্দন,ঠোঁটে রক্তজবার উজ্জ্বলতা,
মোবাইল ফোনে কোনো মানবের সাথে রসিকতা।
দরদামে ভালো;
আশি টাকার ভাড়া ছিল,সত্তরে রাজি করাল।
চললুম গন্তব্যের পথ চেয়ে,
এক বেলা না খেয়ে,
চললুম নিতু এবং নিতুর মার কথা ভেবে।
পৌছালাম গন্তব্যে;
—"আম্মাজান সত্তর টাকা ভাড়া!দেছেন চল্লিশ,আর তিরিশ কই?"
—"আর তিরিশ কই মানে?কি বলছেন?চল্লিশের কথা ছিল সত্তরের নয়।"
—"আম্মাজান;ভাড়া তো শত্তুর দেওনের কথা আছিলো!"
—"ঝামেলা করছেন?যত দিয়েছি ওত-ই কথা ছিল।"
—"না আম্মাজান,আমি গরিব মানুষ!আমি মিছা কইতাছি না,আফনে সত্তুর দিবেন কইছেন!"
—"ইয়ার্কি করেন?মিথ্যুক!মেয়েমানুষ পেয়ে বেশি টাকা মারার ধান্দা?"
সে নারী চেঁচাচেচি শুরু করল,জমাট হলো সকল আল্লাহর বান্দা।
লোক জড়ো হতে লাগল,
এক বাহাদুর পুরুষ এসে চড় মারল,
জনৈক ব্যক্তি গালিগালাজ করল,
আমার হাত থেকে টাকা গুলো কেড়ে ফেললো,
ঘামের সাথে রক্ত মিশ-মিশ করতে লাগল।
রিকশার পাশে হাটু গেড়ে বসে আছি অনেকক্ষণ!
কান্না আসছে,চোখে অশ্রু ভাসছে!
এ অশ্রু পড়তে দিব না,
আমি ভুলেও কাদঁব না,
পুরুষ মানুষ কাদেঁ না।
আমাদের মতো গরীবদের সাথে এমনই হয়!
—"এই কুত্তার বাচ্চা!এখনো যাস নি?থাপ্পড় আরেকটা দিব?"
তাগড়া তরুণ,দেশের ভবিষ্যত!
শিক্ষায় দারুণ,পোশাকে বড়লোকি সিফত,
বৃথা মানব!(অমানব)
আবারও তরুণের গলা হতে নিকৃষ্ট অশনি,
বললাম,"জ্বী বাবাজি,যাইতাছি এহনি।"
কান্না থামাতে পারছি না,দু-বিন্দু অশ্রুজল ঝলক দিল তামাটে ত্বকে,
এই কান্নার মূল্য আছে?কাদঁছো কোন সুখে?
চোখ মুছলাম,রিকশায় উঠলাম,প্যাডেল চাপলাম!
এবার গন্তব্য;কোনো শ্মশান বা গোরস্থান,
কারণ;আত্মা দাফন করব।
আত্মাহীন জগতে কেন আমি আত্মা নিয়ে ঘুরব?
—"এই মামা,দাঁড়ান!দাঁড়ান বলছি!"
—"আম্মাজান যাত্রি নাহি নিচ্ছি।"
—"আমি কোথাও যাব না।"
—"তই,গাড়ি থামাইলেন ক্যান কন না?"
নিশ্চুপে সে বালিকা আমার হাতে দুটো চকচকে একশ টাকার নোট রাখল,
আমার চোখ হতে অশ্রু ঝরতে লাগল।
উষ্কখুষ্ক চুল,কণ্ঠে মলিন,বর্ণে ঈষৎ কালো!
তবুও আমার কাছে তিনি শ্রেষ্ঠ সুন্দরী।
আমি কিছু বলার আগেই সে আবার বলল,
"দু-বিন্দু অশ্রু কথা বলেছে,আপনি সত্য!"
আমি কাদঁতে রইলাম,জনতার স্রোতে হারিয়ে গেল সে বালিকা!
আমি নিজে-নিজে বলতে লাগলাম,"মানুষ!মানুষ!মানুষ!"
সুখে থাকো তুমি বালিকা,সুখে থাকো তুমি মানুষ।
এই কবিতা তোমার জন্য,এই আত্নাকে জীবিত রেখেছি তোমার জন্য।
নিতু আমার ভাঙা মোবাইলে কল দিল,"আইতাছি মা গো!আইজ আর যাত্রি লমু না।"
নিতুর জন্য চিপস্ নিলাম,
নিতুর মার জন্য নিলাম কমলা।
চোখে আনন্দঅশ্রু আর কিছু সুখ জড়ো করে
বাসায় চললাম।