প্রস্তাবনা
রবীন্দ্রানাথ ঠাকুরের কি কোনো বিশেষ বর্ণের অনুভূতি কম ছিল! এভাবে বললে শোভন শোনায়। কিন্তু যদি এভাবে বলা হয়.... রবীন্দ্রানাথের কি আংশিক বর্ণান্ধতা ছিল বা Rabindranath thakur had partial color-blindness, তাহলে অনেকেই বিরক্ত হবেন। রবীন্দ্রনাথের অননুকরণীয় প্রকাশভঙ্গীকে মনে রাখলে, ওভাবে বলাটাও সঠিক হবে না।
বর্ণান্ধতা (colour blindness)
আমাদের চোখের রেটিনাতে দুধরণের ফটোরিসেপ্টর আছে…রডস (rods) এবং কনস (cones)। স্বল্প আলোয়, যেমন অন্ধকারে দেখতে সাহায্য করে রডস, আর বিভিন্ন রঙের অনুভূতি তৈরিতে সাহায্য করে কনস। তিন ধরণের কনস আছে, যারা আমাদের মস্তিষ্কে লক্ষ লক্ষ বর্ণমালার অনুভূতি গড়ে তোলে। এই স্বাভাবিক রঙের আনুভূতিকে বলা হয় ত্রিবর্ণানুভূতি(trichromacy)। কনস-এর অভাবের জন্য তৈরি হয় বর্ণান্ধতা। সারা পৃথিবী জুড়ে ৮% পুরুষ ও 0.৫% মহিলা বিভিন্ন ধরণের বর্ণান্ধতায় আক্রান্ত…সংখ্যাটা বিশাল। অনেকে সারাজীবন বুঝতেও পারেন না তাদের বর্ণান্ধতার অসুখকে। এই অসুখ সাধারণত পুরুষানুক্রমিক, এক্স (X) ক্রোমোজোম বাহিত এবং মূলত পুরুষদেরই হয়। কিছু অসুখ, মেডিসিন বা কেমিক্যালস থেকেও বর্ণান্ধতা হতে পারে।
তিন ধরণের বর্ণান্ধতা আছেঃ
১। লাল-সবুজ আংশিক বর্ণান্ধতাঃ তিনের জায়গায় দুরকম কনস থাকলে, তাকে বলা হয় দ্বিবর্ণানুভূতি (dichromacy)। এটাই সবথেকে বেশি দেখা যায়। এল-কনস’এর (L-Cones or long wave cones) অভাব বা ত্রুটি থাকলে, লাল রঙের অনুভূতি থাকে না বা কমে যায়। এই আংশিক বর্ণান্ধতাকে বলা হয় Protanopia। যদি এম-কনস’এর (M-cones or medium wave cones) অভাব বা ত্রুটি থাকে, তখন সবুজ রঙের অনুভূতি থাকে না বা কমে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় deuteranopia।
২। নীল-হলুদ আংশিক বর্ণান্ধতাঃ এস-কনস’এর (S-cones or short wave cones) অভাব বা ত্রুটি থাকলে নীল-সবুজের মধ্যে এবং হলুদ-বেগুনির মধ্যে পার্থক্য করার অসুবিধা হয়।
৩। সম্পূর্ণ বর্ণান্ধতাঃ কারও রেটিনাতে কনস একদম না থাকলে বা অকার্যকারী হলে, তার কাছে পৃথিবী সাদাকালো হয়ে যায়। এই অবস্থাকে monochromatia বা total color blindness অথবা সম্পূর্ণ বর্ণান্ধতা বলা হয়। সম্পূর্ণ বর্ণান্ধতা অবশ্যই একটি বিরল অসুখ।
রবীন্দ্রনাথ ও বর্ণান্ধতাঃ evidence
এখানে evidence শব্দটি ব্যবহার করা হল প্রমাণ বা নজিরের জায়গায়। কারণ সেই শোভনতা.... ...রবীন্দ্রনাথের কোনো অস্বাভাবিকতার স্বপক্ষে প্রমাণ বা নজির! রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতার ধরণ ছিল protanopia…অর্থাৎ তিনি লাল-সবুজের পার্থক্য নিরূপন করতে পারতেন না।
১। এ ব্যাপারে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬১’তে। কলা-ইতিহাসবিদ স্টেলা ক্রামরিশ (Stella Kramrisch) রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে ১৯২১’এ শান্তিনিকাতনে যোগদান করেন। ১৯৬১’তে ছবির অঙ্গ’, বিচিত্র প্রবন্ধ, রচনাবলী ১৪, জন্মশতবর্ষ সংস্করণে (১) তিনি লেখেন,-“ Admittedly in his own words, Tagore was partly colour blind, for red and green affected him in the same way. And, yet in his paintings, reds and greens are put to conjoint effect (8, 15, 19, 25). Their intensity and shade are different when they set off one another in the same painting”.
২। ডঃ জ্যোতির্ময় বসু এবং ডঃ পিকফোর্ড ১৯৮৭’তে তাঁদের গবেষণাপত্র, ‘কালার ভিশন অ্যাণ্ড এসথেটিক প্রবলেমস ইন পিকচারস বাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ -এ বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এই তথ্য প্রকাশ করেন (২)।
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯২৬’এর ৩-রা জুলাই ইতালিতে রোমা রঁলার সাথে সাক্ষাত হয়েছিল।সেই প্রসঙ্গে রোমা রঁলা (৩) বলেছিলেন,-“ 'Tagore said that he could respond very little or not at all to the "red" colour. In Italy, he was not at all attracted to the wide fields of red poppy flowers, almost like a spreading fire engulfing the countryside. [On the other hand] he used to have immense pleasure in looking at the various shades of blue and violet colours”.
৪। ১৮৯৪ সনে রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন (৪),- “কত রকমেরই যে রঙ চতুর্দ্দিকে ফুটে উঠেছিল সে আমার মতো সুবিখ্যাত রঙকানা লোকের পক্ষে বর্ণনা করা ধৃষ্টতামাত্র”।
৫। ১৩৯১ সনে রাণী চন্দ্র (৪) বলছেন,-“ গুরুদেব প্রায়ই বলতেন তিনি রঙকানা, বিশেষ করে লাল রঙটা নাকি তার চোখেই পড়ে না”।
৬। ১৩৯৩ সনে নির্মলকুমারী মহলানবিশ (৬) লিখছেন,- “ ‘পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল যে উনি রঙকানা ছিলেন। লাল রঙটা চোখে পড়তো না, মানে লাল আর সবুজের বেশী পার্থক্য বুঝতে পারতেন না”।
রবীন্দ্রনাথ ও বর্ণান্ধতাঃ গান ও কবিতায়
রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা নিয়ে আলোচনায় শুরু হয় তাঁর চিত্রশিল্পকে ঘিরে। এ ব্যাপারে কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারীর দীর্ঘ গবেষণামূলক বই ‘ রঙের রবীন্দ্রনাথ’ (৭) বের হয় ১৯৯৭ সনে। আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব গান ও কবিতায়.....রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায় তাঁর আংশিক বর্ণান্ধতার কোনো প্রতিফলন হয়েছিল কি না!
গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য আর গীতালি-এই তিন গ্রন্থের বিশাল সংখ্যক গীতিকবিতায় কেমন ছিল রঙের ব্যবহার? খুবই সীমিত!
গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য আর গীতালিঃ রঙের প্রয়োগ
নীল আকাশে সাদা মেঘের
অরুণ-কিরণে সোনার বরণ
রাঙা রাখীর নীলাম্বর
অরুণ-বরুণ-পারিজাত
নীল অন্ধকারে সবুজ নীলে
শুভ্র আসনে শ্বেতচন্দন-তিলকে
নীল নিকষে রাঙা পর্বতে
শ্যামল কালো শ্যামল বসুমতী
রাঙা ধুলায় নীল নয়নের
শুভ্র কমলগুলি।
রঙিন বসন্ত নিয়ে কবির দুটি নাটিকা-ফাল্গুনী আর বসন্ত। কি রঙ আছে এখানে---
রঙিন বসন মেঘ রাঙা
রাঙা পাল।
কোনো কোনো শব্দ আমার চোখে হয়তো পড়েনি। কিন্তু, মোটমুটি এইই।
পঞ্চাশ দশকের অন্যতম কবি আলোক সরকার। ১৩৫৫ থেকে ১৩৬০-র মধ্যে, তার প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থে কেমন ছিল রঙের ব্যবহার?
--- --- ---
শ্বেত উত্তরীয় ধূসরবর্ণ ধূলো
সাদা ঘর লাল কৃষ্ণচূড়া
নীল হাততালি আসমানি রঙের ছায়া
সাদা শিখা শ্যাম দূর্বাদল
সাদা শীত লাল হয়ে ওঠে কৃষ্ণচূড়ায়
হলুদ বাতাস ধূসর ফাল্গুনী
সূর্যের সলজ্জ সোনালি
সমুদ্রের নীলের উপরে একা
পলাশ লাল, পান্না, লাল মুক্তা, লাল চুনি
নীল দূরের পথে সোনার দ্বার
সবুজ গাছের পাখি সাতরঙের জানলা
রাঙাধুলোর নীলহাওয়ায়
লাল রঙের গোলাপ রডোডেনড্রন রক্তসংহতি
হলুদ আলোর সিঁড়ি শ্যামল বাড়ি
রঙিন টিপ রাঙা শাড়ি
ট্রামের লাল আলো সাদা বেদনা
শ্যামাঙ্গী বধূর লালটিপ
লাল আলোর দূত
ছড়াবে লাল অনেক রঙ
গুলমোহরের আঁচলে তার হলুদ
রক্তখোয়াই নীল লাল আবার হলুদ
সবুজ অবজ্ঞাত দীঘি
লাল সিঁড়ি, জামরুল রঙের দালান
লাল ফুল, হলুদ বেগুনি ফুল
লাল বুকের ভিতর রক্তগতি
লাল প্রাসাদ, কালো মেঘ নীল আলো
প্রস্ফুটিত লাল আলমারি
নীল সকালবেলা রক্ত ঠোঁটের বিদ্যুত
রক্তিম সহজপাতা, পীত হিজল
রক্ত দুপুর বেলায় সর্বত্র গোলাপ
খয়েরী রঙের বাড়ি
লাল বেনারসী আর চন্দন-রঞ্জিত মুখ।
সিদ্ধান্ত
আমাদের পরমপ্রিয় প্রাণের মানুষটির আংশিক বর্ণান্ধতা ছিল কি ছিল না, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। তা নিয়ে গবেষকদের কাটাছেঁড়া চলুক!
আমরা বিস্মিত এই ভেবে....কবি ছিলেন -তবু আনন্দ জাগে--আনন্দের কবি, পূজার কবি, ঋতুর কবি, তাঁর সৃষ্টিতে রঙের প্রাচুর্য নেই কেন!
বিষাদের কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ! সারা জীবন গভীর দুঃখকে বয়ে বেরিয়েছেন পূজার ছলে! তাই বোধহয় রঙকে প্রশ্রয় দেননি!
কবির আশ্চর্য দুচোখে কি ছিল--বর্ণহীনতা? বিষাদ? মৃত্যুমুখরতা?
তথ্যসূত্র:
১। Kramnsch Stella 1963 In Lalit Kala Contemporary No 2 Published by B C Sanyal, Secretary Lalit Kala Academy Rabindra Bhavan, New Delhi
২। R. W. Pickford and J. Bose, ‘Colour Vision and Aesthetic Problems in Pictures by Rabindranath Tagore’, British Journal of Aesthetics, vol.27.1, Winter, 1987
৩। Rolland, Romain. i960. Inde 2nd Edition (Pans Albin Michel) Translated into Ben- gali, as Bharata-Barsha, by Abouti Kumar Sanyal (Calcutta: Radical Book Club, 1976), p. 143 English translation of the passage quoted by J. Bose
৪। রবীন্দ্রনাথ, ছিন্নপত্রাবলী, ১৪ ডিসেম্বর, ১৮৯৪-এ লেখা পত্র।
৫। রাণী চন্দ: ভুমিকা, আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী ১৩৯১
৬। নির্মলকুমারী মহলানবিশ, ‘আনন্দমেলায় কবির গল্প’, বাইশে শ্রাবণ, মিত্র ও ঘোষ, ১৩৯৩
৭। কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারী, রঙের রবীন্দ্রনাথ, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৭