আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব
                     অচিন্ত্য সরকার


            ‘’ বলেছিলে,’নাই বা মনে রাখলে’
              সে কথা যে মিথ্যে তা’ও জানতে
              মনে কেন মর্মে আছো,
              গহন গভীর উৎস হতে
              ছড়িয়ে আছো শেষ চেতনার প্রান্তে।‘’[প্রেমেন্দ্র মিত্র]

     সত্যি,রবীন্দ্রনাথ কে বাদ দিয়ে জীবন কে ভাবা যায় না।বাঙালী তথা আপামর মানুষের সমস্ত অনুভূতি,চিন্তা,চেতনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন।তাঁকে বাদ দিয়ে আমাদের শোক, দুঃখ,প্রেম,আনন্দ,বেদনা,বিরহ কোন কিছু প্রকাশের ভাষা নেই।তাঁকে বাদ দিয়ে আমাদের মনন ও চিন্তন দিশেহারা,সম্পদে-বিপদে তিনিই আমাদের মহত্তম দিশারী।

               শৈশবে রবিঠাকুরঃ
সহজ পাঠের ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’আজও প্রত্যেক বাঙালী শিশুর প্রথম বোল।অক্ষর জ্ঞান হবার আগেই রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যান শিশুর হৃদয় রাজ্যে।তার আধো আধো কণ্ঠে ছন্দের দোলায় দোলায় রবীন্দ্রনাথ- ‘’ রবি মামা দেয় হামা/গায়ে রাঙা জামা ঐ/দারোয়ান গায় গান/শোন ঐ রামা হৈ।‘’  শিশুকে খাওয়াতে রবীন্দ্রনাথ,ঘুম পাড়াতেও রবীন্দ্রনাথ।ছড়ায়-গল্পে,কথায়-গানে রবিঠাকুর ই বাঙালী শিশুর ভাষা।

              শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথঃ
জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে,নানা মত পথের তর্ক বিতর্কে দিশেহারা হলে রবীন্দ্রনাথ আমাদের পথের দিশা।আজ যখন পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে শিক্ষা নিয়ে নানা বিতর্ক-শিক্ষার মাধ্যম কি হওয়া উচিৎ?আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরাজীর স্থান?শিক্ষার পদ্ধতি কি রকম হওয়া দরকার?-এই সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পাই,আমরা সেই স্কুল পালানো ছেলেটির কাছে।তিনি আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন- ‘’শিক্ষাকে বহন করিলে চলিবে না,তাকে বাহন করিতে হইবে।‘’ শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে সব বিতর্কের অবসান ঘটানো তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি- ‘’শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’’ কে না জানে?তবে সাথে সাথে তিনি একথাও বলেছেন, ’’বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও বাংলা ভাষার ধারা যদি গঙ্গা যমুনার মত মিলিয়া যায় তবে বাঙালী শিক্ষার্থীর পক্ষে এটা একটা তীর্থস্থান হইবে...’’  কলেজের ছাত্রদের তিনি বলেছে –‘’কলেজের বাইরে দেশ পড়িয়া আছে,তাহার মহত্ব একেবারে ভুলিলে চলিবে না।কলেজের শিক্ষার সঙ্গে দেশের একটা স্বাভাবিক যোগ সাধন করিতে হহবে।‘’বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করেছেন এবং তাঁর স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছেন।

                         ধর্ম ভাবনায় রবীন্দ্রনাথঃ
            পৃথিবী জুড়ে যখন ধর্মে ধর্মে এত হানাহানি এত বিদ্বেষ,তখন কে আমাদের পথ দেখায়?অবশ্যই গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ।সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি আর ধর্মের ভেকধারী ভন্ডামীর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভাষায় তিনি বলেছেন- ‘’ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।‘’ জগতের দীন-হীন-দরিদ্র অসহায় খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে তিনি ঈশ্বরের পদধ্বনি শুনেছেন- ‘’যেথায় থাকে সবার অধম দীনের চেয়ে দীন/সেই খানে যে চরণ তোমার বাজে।‘’হয়ত সেই কারণেই তিনি আমাদের ডেকে বলেছেন-‘’ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক পড়ে/রুদ্ধ দারে দেবালয়ে কেন আছিস ওরে।‘’ কি ভাবে তাঁরে পাওয়া যায় সে উত্তরও তিনি দিয়েছেন।গীতা,উপনিষদের সেই নিঃস্বার্থ ত্যাগের মহিমাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি আক্ষেপের সুরে বলেছেন-‘’......if I had had the heart to give Thee my all’’তাঁর সহজ ও উচ্চাঙ্গের ধর্ম ভাবনা আজও কোটি কোটি মানুষের চিন্তার জগতে আলোড়ন তোলে।

                      প্রেমে রবীন্দ্রনাথঃ
বাঙালীর প্রেমে তো রবীন্দ্রনাথের অবাধ বিচরণ।প্রেমে কষ্ট পেয়ে কোন্ বাঙালী গুনগুনিয়ে বলে না?- ‘’সখি,ভালোবাসা কারে কয়/সেকি কেবলি যাতনাময়...’’ আবার প্রেমে পরিপূর্ণ তৃপ্তির যে বাসনা তাও আমরা কবিগুরুর ভাষাতেই ব্যক্ত করি- ‘’ভালোবেসে সখি,নিভৃতে নীরবে,আমার নামটি লিখ হৃদয়ে তোমার।‘’ রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান আর কবিতা নানা ভাবে,নানা রঙে আমাদের সমস্ত প্রেম অনুভুতিকে প্রকাশ করে।কি জাগতিক প্রেম,কি আধ্যাত্মিক প্রেম,কি প্রকৃ্তি প্রেম-সব ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের অবাধ বিচরণ।ব্যর্থ প্রেমিক,তৃপ্ত প্রেমিক সকলেই তাঁর ভাষায় আর সুরে আপন আপন প্রেম অনুভুতি প্রকাশ করে।

                 অন্যান্য ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথঃ
একমাত্র রবির কিরণে যেমন বিশ্ব ব্রহ্মান্ড আলোকিত হয়,তেমনি এক রবীন্দ্র সৃষ্টির প্রভাবে আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রই আলোকিত।তাঁর জীবন এবং সৃষ্টি আমাদের সকল কর্ম,সকল চেতনায় মিশে আছে।কোন রকম অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ তিনি কোন দিন করেননি।তাই তো ‘’নৈবেদ্য’’ কবিতায় তাঁর দীপ্ত কণ্ঠ প্রার্থনা –‘’অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।‘’ আত্মপ্রত্যয়ী পরিশ্রমী মানুষ তাঁর ভাষাতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা জানায়, ’’বিপদে মোরে রক্ষা করো,এ নহে মোর প্রার্থণা/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।‘’ আবার সভ্যতার রথচক্র কে টেনে নিয়ে যাওয়া সৈনিক গায়- ‘’যদি তোর ডাক শুনে কেও না আসে,তবে একলা চল রে।‘’
সমাজের সকল সমস্যা নিয়ে গভীর ভাবনা চিন্তা করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অমূল্য বিশ্লেষণী মতামত রেখে গেছেন যা আমাদের কে নানা ভাবে প্রভাবিত করে।নানা সামাজিক বঞ্চনা,শোষণ আর অসাম্যের বিরুদ্ধে তিনি আমাদের সাবধান করে বলেছেন- ‘’অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে/তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।‘’ এক কথায় রবীন্দ্র সৃষ্টি আমাদের প্রকৃত পাথেয় আর তিনি আমাদের যথার্থ গুরুদেব।

যদি প্রশ্ন করা হয় আমাদের জীবনের কোন ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব নেই,তবে উত্তর হবে আমাদের জীবনে তাঁর প্রভাবমুক্ত কোন ক্ষেত্রই নেই।আমরা তাঁর হাস্যরসে হাসি,তাঁর ভাষাতে কাঁদি,তাঁর ভাবে ভালোবাসি,তাঁর সঙ্গীতে আরাধ্য দেবতাকে ভজনা করি,তাঁর ভাষায় প্রতিবাদ জানাই আবার তাঁর কথায় ‘হিংসা উন্মত্ত পৃথিবীতে’ও মানুষের উপর বিশ্বাস রাখি তাঁর বানী- ‘’মানুষের উপর বিশ্বাস হারান পাপ’’-এ কথা ভেবে।তাই তো পরিশেষে বলি,আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলার বা লেখার বিষয় নয় বিষয়,নিয়ত অনুভবের-
              ‘’তোমার আমার নিবিড় অনুভব
                               জলধির তরঙ্গায়িত নীল......’’[অচিন্ত্য সরকার]