সাহিত্যের সর্বপ্রাচীন শাখাই হলো কবিতা বা সাহিত্যের কাব্যিক শাখা । প্রাচীন কাব্য সাহিত্যের মধ্যে পরে - মহাভারত , রামায়ণ , হোমারের ওডিসি , ইলিয়াড , এমনকি চর্যাপদও । ধীরে ধীরে মানুষ এই মহাব্যিক ধারা থেকে বের হয়ে (তাও মহাকাব্য প্রচুর লেখা হয়েছিল) গীতিকবিতা লেখায় হাত দেয় । এর ফলে ব্রিটেনে (বর্তমান যুক্তরাজ্যে) আমরা পাই জন কিটস , উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ , স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ , পার্সি বিশী শেলী , লর্ড বাইরনদের মতো রোমান্টিক ধারার কবিদের । আমেরিকায় আমরা দেখতে পাই রবার্ট ফ্রস্ট , এমিলি ডিকিন্সন , টি এস এলিয়ট , ই ই কামিংস , রাফ ওয়াল্ডো এমারসন এবং এডগার অ্যালেন পো (যিনি মূলত একজন ছোট গল্পকার) এর মতো কবিদের । আর আমাদের ভারতবর্ষে আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে , বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে (বাংলা কথাসাহিত্যের পিতা) , মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ('মেঘনাদবধ কাব্যের' জন্য জনপ্রিয় হলেও তিনি প্রচুর সনেট লিখেছেন) , জীবনানন্দ দাশকে , কাজী নজরুল ইসলামকে , কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে । স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গ দেখতে পেয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে , জয় গোস্বামীকে এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে (উপন্যাস লেখার জন্যই তিনি মূলত জনপ্রিয়) । স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ পেয়েছে শামসুর রাহমানকে , সৈয়দ শামসুল হককে , রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে , এবং নির্মলেন্দু গুণের কথা ভুলবার নয় ! তাঁরা সকলে মিলে আমাদের কাব্যচর্চার মাধ্যমে আনন্দ দিয়ে এসেছেন যুগ যুগ ধরে । একেকটা আন্দোলন সৃষ্টির অনেক বড়ো হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে তাঁদের কবিতা ! ভুলে গেলে চলবে না বঙ্কিমের "বন্দে মা'তরম" এবং আলাউদ্দিন আল আজাদের "স্মৃতির মিনার" ! ভুলে গেলে তো চলবে না কাজী নজরুল ইসলামের কারাবরণ !

তবু তাঁদের সবার কবিতার সাধারণ বিশিষ্টতা হলো - রাইমিং , মিটার , টাইমিং ! ভুল বুঝবেন না ! আমি কারোর সমালোচনাও করছি না বা কারোর ভুল ধরছি না । ভুল করার মতো কেউ এরা নন ! এরা অনেকেই আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে !

আমি যা বলতে চাইছি তা হচ্ছে যে তাঁরা সবাই একই রকমের কবিতা লেখেন (আমি বলছি না যে তাঁরা একই বিষয়ে কবিতা লেখেন) । সব পঙক্তির একটা সীমা তাঁরা রাখেন , বেশি লম্বা পঙক্তি তাঁরা এড়িয়ে চলেন । তাঁদের বেশিরভাগ কবিতাই ছন্দে আবদ্ধ (তা অবশ্যই কোনো ভুল না) । আরো বড়ো কথা হলো - বাংলা কাব্যে আপত্তিকর শব্দ এড়িয়ে চলা হয় । আপত্তিকর শব্দ বা সহজ ভাষায় অশ্লীল শব্দের ব্যবহাএ দেখা গেলেই পাঠক সেই কবিতাকে কোনো বড় ধরণের জোক হিসেবে দেখে ! তারা ধরেই নেয় যে লেখক হয়তো জীবনে একটা কবিতাও আবৃত্তি করেননি ! বাংলা প্রচলিত ধারার কবিতা পাঠ করতে করতে পাঠক আরো কিছু জিনিস একটা কবিতায় খুঁজে বেড়ায় - রাইমিং , মিটার , টাইমিং ! এগুলো খুঁজে পাওয়া না গেলে তা নাকি কবিতা হয়ই না ! একবার যদি তারা ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা পড়তো !

আপত্তিকর শব্দ থাকলেও তা নাকি কবিতা হয় না ! পাঠকসমাজ , একবার অ্যালেন গিন্সবার্গের "হাউল" আর "ফুটনোট টু হাউল" কবিতা দুটো পড়ে দেখুন ।

আমি এই ওয়েবসাইটে ঢুকে প্রথমেই যে কবিতাটি প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছি তার নাম হলো "আমি তোমায় খুঁজছি বাংলাদেশ ! আমি তোমায় খুঁজছি ... " । দু'দিন পর ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখতে পেলাম আমার কবিতা ব্যান করা হয়েছে । কারন - গঠনগতভাবে আমার কবিতাটি "কবিতা" নয় , আর আমার কবিতায় যথেষ্ট আপত্তিকর শব্দের ব্যবহার রয়েছে ।

কয়েকদিন পরই আমি ওয়েবসাইট থেকে নিজের দ্বিতীয় কবিতা প্রকাশ করার চেষ্টা করি - যা একটি সস্তা প্রেমের কবিতা । এই কবিতাটা হলো আমার জীবনে লেখা সবচাইতে নীচুমানের বস্তু । তবে তা ঠিকই প্রকাশিত হলো !

আমার বয়স বেশি নয় - মাত্র ১৭ বছর হলো । আমার বয়েসী , বা আমার থেকে সামান্য বড়দের এই ওয়েবসাইটে শুধু ঐ প্রচলিত ধারাতেই প্রেমের কবিতা প্রকাশ করতে দেখি । কাউকে তেমন একটা ক্যাপিটালিস্ট মূর্খদের বিরূদ্ধে কবিতার মাধ্যমে কথা বলতে দেখিনি । আমি আমার কবিতার মাধ্যমে তা করতে চেয়েছিলাম , পারিনি । যা হওয়ার দরকার আরো বেশি , তা হচ্ছে ব্যান ! আর যার কোনো সীমা নেই , একটার পর একটা প্রকাশিত হতে থাকে , তা আরো প্রণোদিত করা হয় !

এই হলো গিয়ে এখনকার বাংলা সাহিত্য ! প্রেমের উপন্যাস যা বেস্টসেলার হয় , প্রেমের কবিতা যা শুধুই নারীর হৃদয় কাড়ার জন্যে , আর প্রেম নিয়ে মোটিভেশনাল প্রবন্ধ !

বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো ঝড় আমরা তুলতে পারছি না কেন তা হয়তো এখন আমাদের জানা হয়ে গেছে । তার কারণ হলো - সাহিত্যের প্রচলিত ধারা থেকে আমরা নিজেদের এখনো বের করে আনতে পারিনি !

আমি বলছি না যে আমাদের পদ্যসাহিত্যকে গদ্যসাহিত্যে রূপ দিতে হবে । আমি কী বোঝাতে চাইছি তা ওয়াল্ট হুইটম্যান আর অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা আবৃত্তি করলেই বুঝবেন ।

আমার প্রথম এবং শেষ কথা - প্রচলিত ধারার কাব্যচর্চা থেকে আমাদের বেরিয়ে আস্তে হবেই !

পৃথিবী এখন সংকটাপন্ন ! এই সংকটের সুযোগ নিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টায় আছে আমাদের মূর্খ রাজনীতিবিদরা । ক্ষমতার আসনে তারা তাদের ক্যাপিটালিস্ট-পাছা বসিয়ে রাখার জন্য এই জনপ্রিয়তা কাজে লাগাবে ! গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটবে ! এসবের বিপরীতে আছি আমরা - সাহিত্যিক সমাজ ! আমরাই সমাজের আলোকশিখা নিয়ে আসি , আমরাই পথ দেখাই ! তা অবশ্যই কোনো রাজনীতিবিদ নয় , মিলিটারী তো নয়ই ! তা আমরা ! আর আমরাই যদি আটকে থাকি , তাহলে সমজ আটকে থাকবে ।

তাই আবার বলছি - প্রচলিত ধারার কাব্যচর্চা থেকে আমাদের বেরিয়ে আস্তেই হবে !

আমেরিকায় কবি আর ঔপন্যাসিকরা প্রচলিত ধারার সাহিত্য থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৫০ আর ১৯৬০ এর দশকে একটি আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিল - বিট জেনারেশন , যা পরে সঙ্গীতের ছোঁয়ায় হিপি জেনারেশনে রূপ নেয় । এই আন্দোলনই আমেরিকাকে চিরকালের জন্য বদলে দিয়েছে !

আমি আবার বলবো - প্রচলিত ধারার সাহিত্য থেকে আমাদের বেরোতেই হবে !



২০ এপ্রিল , ২০২০
লাভলেইন , চট্টগ্রাম