তখন তার বয়েস হবে চার কি পাঁচ।
অসুখে ভুগতো বাচ্চা ছেলেটা বড্ড। ইস্কুলও কামাই হত অনেক অনেক।
এক মাথা চুলের কোঁকড়া বাহার, আর বিস্ময় ভরা গভীর দু চোখ ছিল তার পরিচিতি। অঙ্কে একদম মাথা ছিল না। তাই মায়ের কাছে
পড়তে বসে, অহরহ ছোপটি ভাঙতো ডিগডিগে শিরদাঁড়ার উপর।
আবার মা অসুখে কত রাত ঠায় জেগে কপালে দিতেন জলপট্টি।
কখোনো বা হতো সে 'বিবেচনায় উত্তীর্ণ'।  
ছেলেটি বাবার সাইকেলের কেরিয়ারের দু ধারে পা ঝুলিয়ে বসে,
মাথা দুলিয়ে আপন মনে গাইতো অবিরাম শুধু গান আর গান! বাজার ছাড়িয়ে মধুপুর স্টেশনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে।
বাবা বলতেন তার, ভালো করে ধরে বসো,এই বার কালিপুর টাউন এর রাস্তা ধরবো,খুব উঁচু নীচু!
আর অত মাথা দুলিয়ে গান গাইছ বেশ!
কিন্তু দেখো আবার মাথা না ঘুরে যায়!
মন টা তার ছিল কত যে অজস্র প্রশ্নে ভরা: বাবা স্টেশন টা কি রেলগাড়িদের বাড়ি?
দুটো ট্রেন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে:ওরা কি কথা বলে নিজেদের মধ্যে? কি কথা? ইঞ্জিন টার বুঝি খুউব রাগ! অতো জোরে 'কুউউ' করে কেন?
খালাসিরা কয়লা আর জল দেয় কেন ওকে?
কৌতুক করে বলতেন বাবা:"অনেক দূর থেকে দৌড়ে আসে! তাই তেষ্টা মেটাতে হয় বৈকি,না হলে তো আরও রেগে যাবে যে!
আর কয়লা তেই তো ছুটে চলার শক্তি পায়!"
ওরা বাথরুম করে কোথায়? "আহ তোমার প্রশ্নের শেষ নেই, এবার থাম" বাবার মৃদু বকুনি!"তুমি বরঞ্চ গান গাইতে থাক
শুনি" বাবা "বরঞ্চ" কি? হি হি হি 'বরঞ্চ !!!' হি হি হি!
"আচ্ছা আচ্ছা! খুব ফাজিল হয়েছ দেখছি" পিতা-পুত্রের বয়েস নিয়ে পাটীগণিতের সব সুত্র হার মানত :
বাবা-ছেলের এই সরল কথার রূপকথায়!
**************************************
একদিন পিতা হলেন প্রৌঢ় আর ছেলে বড়,
পিতা অবসরপ্রাপ্ত, ছেলে রোজগেরে। ক্রমে পিতা বৃদ্ধ হলেন, ছেলে সংসারী।
পিতার অনেক প্রশ্ন, কিছু পরামর্শ ছেলের আপিস নিয়েও, ছেলের জাবাব দিতে দিতে শেষে হাঁপিয়ে যাওয়া-
"এবার বরঞ্চ বিশ্রাম করো বাবা, ঢের হয়েছে " তাছাড়া এখনকার জীবনের সব কিছু তুমি যে বুঝবে না।
বাবার অভিমান আমরাও 'মার্চেন্ট আপিসে' কাজ করেছি!' 'বসের ভাবার আগে সেই কাজ করবি,
কিন্তু একদম 'খেজুর' করবি না, তাতে উন্নতি না হয় হোক! ওতে দুজনেরই চরিত্রই  নষ্ট হয়!"
**************************************
অনেক বছর পর ছেলের স্ত্রী হল সন্তান সম্ভবা। মধ্যবিত্ত পরিবারে এলো চাপা খুশির জোয়ার!
বাবা দেখেন ছেলে প্রায়শই আপিসে যায় না! বোধহয় শরীর ক্লান্ত; বুঝিবা বৌমাকে ডাক্তার দেখাতে. ..
একদিন সোমবারের দুপুরে ছেলে বসেছিল বারান্দায় উদাসীন! বাবা এসে ছেলের পিঠে হাত রাখলেন, ছেলে কিছুটা বিব্রত।
বললেন:"না রে আমি আজ কোনো প্রশ্ন করতে আসিনি! আমাদের  সামান্য যা আছে তাতে কিছু মাস চলে যাবে,
আমারও এইরকম হয়েছিল, তোর মত আপোষ করিনি আমিও। অসভ্য বসেদের ভুলতে জানতে হয় রে,বড় তেষ্টা যে ওদের!
না হলে চাকরি করা যায় না! স্বার্থ সিদ্ধি তে বাধা প্রাপ্ত হলে  ওনারা হিংস্র হয়ে যান!  চেষ্টা করো অন্য চাকরির। "জীবনের হাল শক্ত করে ধরে বসতে হয়, না হলে মাথা ঘুরে যায় হতাশায়!"
**************************************
ছেলের কেমন চমক লাগলো বাবার কথা শুনে... এ কি! এ তো সে-ই কবেকার সাইকেল যাত্রায় বাবা ছেলের কথোপকথন যেন!
কী আশ্চর্য! অতীত এরকম নিষ্ঠুর পরিহাস হয়েও ফিরে আসে বুঝি!
আর ঐ গান? ঐ গান কি তবে ছিল :
জীবনের চরাই- উতরাই পেরিয়েও যন্ত্রণা কে ভুলে থাকার গান?
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল যেন ! কী আশ্চর্য!
তার ভাবী সন্তানের বয়স ও তো তখন মাত্র মাস: চার কি পাঁচ...!!
সত্যিই, গান কিছুতেই থামানো যায় না...
...শুধু গেয়ে চলে যেতে হয় একা!
                                ***