মা চেয়েছিল বলে আমি কথা বলিনি খুব বেশি,
কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হব ভেবেছি।
বাল্যকাল কেটেছে আমার মায়ের আচল তলে,
লিখতে পারি স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ মা শিখিয়েছেন বলে।
আমার শৈশবে আমি খেলেছি কতো শান্ত নদীর সাথে
জোনাকি, ফড়িং ধরেছি শত মুঠো করে হাতে হাতে।
পৃথিবীর 'পরে শুনেছি আমি পাখির ডানার ঝাপটা,
মানুষের চোখে আমি কারো নই, পৃথিবী আমার সাপটা।

এইসব গ্রাম হতে সাপের মতো ট্রামে চড়ে এসেছি শহরে,
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হেটেছি একা ফুটপাতের 'পরে।
বেকার বসে কেটেছে সময় হেলায় ভরা জোছনা রাতে,
ভোরের আলোয় করেছি আহার কাক-আমি একসাথে।
হৃদয়ের মাঝে আগুন জ্বলেছে, দেখেনি কেউ তা,
হঠাৎ আমায় শান্তি দিয়েছে, নাটোরের বনলতা।
আমার চেয়ে একা পৃথিবীতে নেই কেউ আর,
তাই আমি তুলে নিয়েছি হাতে কবিতার ভার।

অন্ধকারের মাঝে আরও গাঢ় অন্ধকার হয়ে থেকেছি আমি,
দেখেছি অন্ধকারের পাখি হুতুম-পেঁচা; শুনেছি শব্দ বেনামি।
বিকেল বেলা করেছি খেলা জারুল, হিজল, অশ্বত্থের ছায়ায়,
বকুল নয়, গোলাপ নয় শাদা ভাঁটফুলের মালা পড়েছি গলায়।
এক সন্ধ্যায় আহত হয়েছি সর্পিল ট্রামের ধাক্কা খেয়ে;
এ জীবন থেমেছে যখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে,
তখন আমার পরিচয় কেবল: আমার বাবা সত্যানন্দ;
আর আমি অন্ধকারের, নির্জনতার কবি জীবনানন্দ।