খরতাপ গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে পুড়েও শ্রাবণের কালো মেঘের মতো গুমোট হয়ে ছিলাম সেদিন;
প্রতি শীতে আমার মৃত্যু নামে জানতাম, কিন্তু সেদিনের বিষাদ মেঘ ছিলো আরও ভয়ানক।
নির্মম বাস্তবতার চূড়ান্ত দেখা এই চোখে তবু নামেনি ঢল, ভেতর ফেঁটেছে আর্তনাদে, ঢল নামেনি!
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলে, আমি শুধু ঢলে পড়লাম মাথা হেলিয়ে, এক আদিম অশ্বত্থের শেকড়ে।
আমি ভাবলাম, যদি যা হবার নয়, যদি যে পাবার নয়, তবু কেনো তার প্রতি এই গভীর প্রণয়?
বিবশের পিছুটান আর নয়, যতই আসুক ব্যাথা ভয়, নিজেকে পাথর করে নেবো নিশ্চয়!
জাতিস্মর আমি নই, তবু সেদিন ভেসে এলো কিছু অমোঘ স্মৃতি, অকস্মাৎ দিব্যোদকের মতো!
ঘুমের ঘোরে, নাকি স্নায়বিক গোলোযোগে জানি না, তবে যা জেনেছি সেদিন, তা সত্যেরও অধিক;
ধূসর পান্ডুলিপির বিগত কোনো জন্মে, পেয়েছিলাম তোমায় নিজের করে, জন্মান্তরের তরে।
তুমি প্রতিদিন পঞ্চবটির বন থেকে আনতে ফুল, গাঁথতে মালা আমার নামে, খুবই সন্তর্পণে।
সে ফুলের রেণু, বাজিয়ে মত্ত বেণু, নিত্য করেছে খেলা, বেঁধেছে কিভাবে আমার হৃদয়;
নাগপাশ তার বুঝতে না পেরে, পালিয়েছি যত ডুবেছি অতলে তত, কি প্রেমময় নির্দয়!
যুগান্তরের অবসান ঘটলেও সে হোমাগ্নির শিখা জ্বলত প্রতিদিন, আমার জন্যে অনন্ত প্রতীক্ষা নিয়ে।
নিঃস্পৃহ হয়ে কেমন, সেই মায়ার প্রতি মুখ ফিরিয়েছি বারেবারে, কতটা মুর্খ আর হতভাগা ছিলাম;
তৃষ্ণায় ক্লান্ত পথিকের মত সান্নিধ্যের তীব্রতায় জেগেছো তুমি কত রজনী, দেখেও দেখিনি, বুঝেও বুঝিনি!
বিধাতাও হয়ত হতভাগ্যদের দিকে করুণায় তাকায়, আমি অবোধ ভ্রুক্ষেপও করিনি সেথায় বিন্দুমাত্র।
নির্বাক অভিমান, দ্বিধাহীন পিছুটান, জমে হয় অতলান্তের অধিক, বিসদৃশ আমার জাগেনি অনুতাপ।
বিধাতাপুরুষ তাই, সেবার আমায় ক্ষমা করে নাই, তোমার অশ্রুজলের বিনিময়ে দিয়েছেন অভিশাপ।
নির্মেঘ চোখের ভাষায় বলেছিলে হয়ত কখনও, যেভাবে তুমি বেসেছো ভালো, কিঞ্চিৎ যেন পাও ফিরে-
সজল ঘন বর্ষার মতো নিভৃতে অঝোরে ঝরেছো যত, আমারও যেন হয় কিছুটা হৃদয়ক্ষরণ।
বিধাতা শুনেছে তোমার সে কথা, সহাস্যে দিয়েছে আমায় জীবন এক, তোমায় মগ্ন আত্মভোলার;
সেদিন বুঝিনি কি অব্যর্থ অভিশাপে নিদারুণ পুড়তে হবে আমায়, বহু জন্ম পরেও রইবে যার রেশ।
জ্ঞাতসারে মাথা পেতে নিয়েছি, উপেক্ষা যত করে গিয়েছি, শোধাতে হবে তা একদা মূল্য দিয়ে ভারি;
উদ্বোধ আমার হোক, প্রবোধে নেই শোক, তুমি অমূল্য যবে জেনেছি মর্মমূলে, সে কি ভুলতে পারি?
প্রতিজ্ঞায় আবিষ্ট আমার যেন পুনর্জন্ম হলো! মোহ-মায়া বা বিস্মৃতি না, নয় কোনো কুহেলিকার আস্তরণ;
ভাগ্যলিপিতে শাশ্বত অক্ষরে তখনি ছেপে গেছে, গেঁথে আছে তোমার প্রতি আমার চির সমর্পণ।
অজস্র ঝরা পাতার মর্মর আর বিস্মৃতি ঠেলে, তোমার ঝরে পড়া অশ্রুকর্দমাক্ত বিষন্নতা নিয়ে জেগে উঠলাম।
চেতন হলাম আমি সেই আদিম অশ্বত্থের শেকড়ে, ঘনঘোর অমানিশা, চারপাশে শ্রাবণ হয়ে ঢল নামায়- বোধ!
জানলাম, আপাত মনে হয়- যা হবার নয়, তবু যদি জাগে প্রবল জোয়ার, সে নদী নীরবে বয়ে যেতে হয়।
স্রষ্টার অজ্ঞাত নিমিত্ত আছে নিশ্চয়, যে একবার হয়েছে তোমার, গেঁথে রাখতে পারলে সে তোমারই রয়!