তালপাতার বাঁশীর সুরে উদাস মনে কখন যে সময় পেরিয়ে গেছে টের পেলনা সায়েম। স্টেশনের মাইকের শব্দে হন্তদন্ত মানুষের আনাগোনায় নিজেকে মিশিয়ে নিলো ট্রেন ধরার জন্য। হাতে দু’টো টিকিট একটা বন্ধুর জন্য আরেকটা তার নিজের জন্য। অনেক কষ্ট করে সিলেট যাওয়ার জন্য টিকিট দু’টো ম্যানেজ করে দিয়েছে স্টেশনের পাশের কলনীতে থাকা এক দূসম্পর্কের চাচাতো ভাই। কারণ সে যেখানে থাকে সেখান থেকে এসে জ্যামের কারণে তার টিকিট কাটা হয়ে উঠতো না তাছাড়া বর্তমানে স্বজন প্রীতি ছাড়া কোন সুযোগ ভোগ করা যেন রীতিমত স্বপ্ন। যাক কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বিমানবন্দর স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা পারাবত এক্সপ্রেস এ বগীটা খোঁজে পেল। ভেতরে প্রবেশ করে মানুষের ভীড় ঠেলে টিকিটে থাকা নাম্বার মিলিয়ে সিট খোঁজতে লাগলো সায়েম। এক সময় পেয়েও গেল কিন্তু কপাল আকাশে উঠে গেল। রীতিমত দখল দারিত্ব কায়েম করে দু’জন বসে আছে একজন মেয়ে আরেকজন ছেলে। সায়েম তাদের বলল- প্লিজ এই সিট দু’টো আমার কেনা আমাকে বসতে দিবেন? কি আর করা ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে গেল। সায়েমের দিকে মেয়েটি করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। সায়েম কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। এদিকে তার বন্ধু তারেকও ফোনটা ধরছে না। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে, ঠিক এ সময় একটা ম্যাসেজ আসলো তারেকের নাম্বার থেকে। তাতে লেখা বন্ধু একটা সমস্যা হয়ে গেছে তুই চলে যা আমি পরের ট্রেনে আসছি। এবার মেয়েটি কথা বলল- ভাইয়া উঠে পড়বো? সায়েম বলল- না, ঠিক আছে, বসুন। আমার যে বন্ধুটি আসার কথা সে আসতে পারছে না, পরের ট্রেনে আসবে। মেয়েটি এবার স্বস্তির একটা নিঃশ^াস ছাড়লো। একই সাথে ধন্যবাদ জানাতেও ভুল করলো না।
ট্রেন চলতে শুরু করলো। তার সীটে বসে থাকা ছেলেটি কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আর এতেই সায়েম বুঝতে পারলো ছেলেটি মেয়েটির কেউ নয়। মেয়েটি এবার তাকে খুব ভালো করে দেখতে লাগলো। সায়েম শুধু খেয়াল করছে কিন্তু কিছুই বলছে না। এভাবে কিছুটা সময় চলে গেল। এবার সেও মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালো। একটা সময় তার চোখ যেন মেয়েটির চোখে আটকে গেল। মায়া ভরা চোখের চাহনী তাকে কথা বলতে যেন বাধ্য করলো। পকেট থেকে টিকিটটা বের করে মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল- এটা আপনার কাছে রাখুন কাজে লাগবে। মেয়েটি বলল- আমার কাছে টিকিট আছে, লাগবে না। সায়েম বলল- আপনার টিকেটে সিট নেই আর আর এই টিকিটে সিট আছে সুতরাং এখানে বসতে হলে এটা আপনার লাগবে। মেয়েটি এবার লজ্জা পেয়ে হাত বাড়িয়ে টিকিটটা নিল। এ সময় হাতে হাত লেগে দু’জনেই যেন একটু কেঁপে ওঠলো। এবার মেয়েটি বলল- আমার নাম লতা, সিলেট শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ি। টিকিট কাটতে দেরি হওয়ায় সিট পাইনি তাই খালি টিকিট কাটি। ট্রেনে উঠার পর এই সিট খালি পেয়ে বসেছিলাম, অনুমতি না নিয়ে বসার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। না না ঠিক আছে বলেই হেসে দিলো সায়েম। তার হাসিতেও যেন একটা অন্য রকম মায়া আছে। লতা তার নাম জানতে চাওয়ার আগেই সায়েম বলল- আমি সায়েম একটা ব্যবসায়ীক কাজে দুই বন্ধুর সিলেট যাওয়ার কথা ছিল। আমার বন্ধু তারেক সময় মতো আসতে পারেনি। ও পরের ট্রেনে আসবে। এভাবেই কথা আদান প্রদান হতে লাগল। ট্রেন চলার সাথে সাথে যেন কথাও জমে উঠছে। একটা সময় দু’জন দু’জনের ব্যাক্তিগত আর পারিবারিক সব কিছুই জেনে নিল। দু’জনের কথার ভেতরেই যেন যাদু কাজ করছে। তাই ট্রেনে থাকা পুরো সময় জুড়ে কথার আদান প্রদান হয়েছে। একটা সময় সিলেটের পাহাড়ী বৈচিত্রময় চা বাগান ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন যে দু’জন দু’জনের খুব কাছাকাছি চলে গেছে তা কেউই টের পেলনা। বিকেলের রক্তিম সূর্যের তীব্রতা কমে লতার চেহারাটা যেন আরও আকর্ষনীয় হয়ে উঠলো। একটা সময় ট্রেন গন্তব্যস্থলে এসে পৌছে গেল। একই সাথে দু’জন নামলো। ক্ষুধা পেয়েছে খুব বেশি তাই আগে তারা হোটেলে উঠলো খাওয়ার জন্য। এবার খাওয়ার বিলটা লতা দিতে চাইলো কিন্তু সায়েম তাকে থামিয়ে দিলো। দু’জনের সম্পর্ক যেন আরও গভীর হয়ে গেল। লতা মনের অজান্তে সায়েমকে যেন ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছে না। হোটেল থেকে বের হয়ে লতা তার হাতে থাকা ছোট্ট একটা কাগজ সায়েমের হাতে দিয়ে বলল- আমি অপেক্ষায় থাকবো। এরপর বিদায় নিয়ে চলে গেল লতা। সায়েম লতার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে নিজেও পা বাড়ালো, পকেটে পুরে রাখলো সেই কাগজটা। ব্যস্ততার ভেতরে বিকেলের বাকি অংশটা কেটে গেল।
চাঁদনী রাতের আলোয় হোটেলের ছাদে সেই কাগজের কথা মনে হতেই পকেট থেকে তা বের করেই দেখতে পেল তাতে লেখা মানুষ এতো ভালো হতে পারে! আরাধ্য ভালোবাসা হতে মন চায়, যোগ্যতা নেই তবুও অপেক্ষায় থাকবো শুধু তোমার। একটা ডিজিট না লিখেই নাম্বারটা দিলাম যদি ঠিক কল দিতে পারো তবে ভালোবাসবো আরও। কথাগুলো পড়ে আরও অবাক হলো সায়েম। মোবাইলের স্কীনে একটা নাম্বার তুলে কল দিতেই অপর প্রান্ত হতে উত্তর এলো- আমি অপেক্ষায় ছিলাম সন্ধ্যা হতেই। মনের মিল না থাকলে কি এমন হয়! ভালোবাসি খুব ভালোবাসি হৃদয়ের অজান্তেই ভালোবাসি। দেখা হবে কাল ক্যাম্পাসে অপেক্ষায় থাকবো। রাতের স্বপ্ন বিভোর ঘুম শেষে সকাল সকাল ফ্রেস হয়ে সায়েম বেরিয়ে পড়লো। ক্যাম্পাসে ঠিকই দেখা হলো। এ যেন অন্য এক লতা। খুব সুন্দর করে সেজেছে সে। অনেক অনেক সুন্দর লাগছে। চোখ ফেরাতে পারছে না সায়েম। হাত বাড়িয়ে দিলো লতা সায়েমের দিকে সায়েমও হাত ধরলো। খুব আনন্দেই ক্যাম্পাসে দু’জন গল্প করে অনেক সময় কাটালো। দুপুরে একটা হোটেলে লাঞ্চ করে সায়েম বিদায় নিলো। এর কেটে গেল বেশ কিছু দিন। কথা হয় মোবাইলে। রাতের পর রাত কেটে যায় জীবনের গল্পের যেন শেষ হয় না। এভাবে ছ’মাস কেটে গেল।
মাঝখানে সায়েম যেন একটু কেমন কেমন হয়ে গেল। ব্যবসাটা ভালো যাচ্ছে না। অনেক টাকা ঋন হয়ে গেছে। এ বিষয়গুলো অনেকবার সায়েম লতাকে বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। একটা সময় লতার বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বললে সায়েমকে লতা বিষয়টি জানায়। সায়েম লতাকে তার বর্তমান ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরলে বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখে লতা। তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে সায়েমকে বলে আমাকে বিয়ে করতে পারবে কিনা সেটা জানতে চাই। সায়েম তার বর্তমান দূরবস্থার কথা চিন্তা করে সময় চায় যে আমার ব্যবসার অবস্থা ভালো হলেই আমি তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো কিন্তু এই মূহুর্তে আমার বিয়ে করা সম্ভাব হচ্ছে না। দু’জনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। লতার বিয়ে হয়ে গেল অন্য এক জায়গায়। তিন মাস পরেই সায়েমের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়ালো। অনেক অনেক লাভ হলো কিন্তু তার ভালোবাসা আর ভালোলাাগার মানসী হারিয়ে গেল। লতার দেয়া সেই ছোট্ট কাগজটি আজও তার পকেটে থাকে। সে কাজটির সাথেই মাঝে মাঝে ভালোবাসার কথা কয়। লতার কাছে সময়ের চেয়ে অর্থের মূল্য বেশী ছিল বলেই তাকে ছেড়ে গেছে। আজ যখন তার কাছে অর্থ এসেছে কিন্তু ভালোবাসার লতা তার কাছে নেই। তাই সায়েমের ভাবনায় এক পলকের ভালো লাগা ভালোবাসার প্রেয়সী যেন ভালো থাকে সময়, সময় সব সময়।
তারিখ- ২৬-০১-২০১৯