রেখে দুটি পরিষ্কৃত দর্পণ পাশাপাশি,
মিলে দেখা প্রতিবিম্বের রাশিরাশি!
দূরতম বিন্দুটি কোথায় রয়?
যেথা হতে অবাস্তব প্রতিবিম্বটি গঠিত হয়!
সৃষ্ট সকল বস্তুর আসল সুরত গোলাকৃতির,*
সেই বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুটিই হয় অভীষ্ট মকসুদ।*
ভুল বুঝোনা, এটা শুধুমাত্র ব্যাখ্যার স্বার্থে,
প্রভুর পবিত্র একক অস্তিত্ব রহস্যময়তায় প্রকৃতই নিরাকার।
শাশ্বত সেই সত্তা অতুলনীয় (যেন অদৃশ্য পরিধিবিহীন বৃত্তের কেন্দ্রের; আকার-আকৃতি বা, আয়তন, অবস্থান, সময় ও বস্তু-সংশ্লিষ্টতা, সাধারণ উপলব্ধি, ধারণা ও কল্পনার উর্ধ্বে, তুলনাহীন) অদৃশ্য নিরাকার বিন্দুর মতই*; নয় তবু সাকার।
*হৃদয় দর্পণে পতিত আলোক ও এর প্রতিফলনে*,
*আয়নাটির পারা রূপে বিরাজমান স্রষ্টার ধ্রুবসত্য তাওহীদ।*
না করেন কিছুতে প্রবেশ, না হন বাহির; স্থান, কাল ও পাত্রের উর্ধ্বে তিনি,
শুরু ও শেষ নেই যার, অনন্ত ও অসীম জ্ঞানের ধারক ও বাহক যিনি।

[প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বিশ্বজগতসমূহকেও অতি দূর থেকে লক্ষ্য করলে বিন্দুবৎ মনে হয়; আবার নিকটে গেলে আসল রূপ ধীরে ধীরে ফুটে উঠে। আর, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা এ সমস্ত সৃষ্টি ও সৃষ্ট সকল আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য হতে পবিত্র; কারণ, তা স্থান দখল করে নিচ্ছে, সময় মাত্রার অধীন এবং বস্তু সংশ্লিষ্টতা থেকে মুক্ত নয়; অথচ, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু স্থান, কাল ও পাত্র (সৃষ্টির যাবতীয় বৈশিষ্ট্য) হতে পবিত্র। সৃষ্ট সব কিছুই আপেক্ষিক; কিন্তু, আল্লাহ্ পাক আপেক্ষিকতা থেকে পবিত্র।
এ সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা বলেন,
"কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়।"
(সূরা আশ শূরা, আয়াত ১১)
"আল্লাহ্ পাক যেমন, তেমনি।"

আহলে সুন্নাহ্ ওয়াল জামা'আতের এই ফয়সালা সত্য, বাস্তবের অনুরূপ... আর উহা এই যে, সিফাত আলাদাভাবে মওজুদ এবং উহা যাতের উপর অতিরিক্ত।
-মাআরিফে লাদুন্নিয়া, পৃষ্ঠা ৫৯।

মুশাহিদাঃ মাশায়েখগণ বলেছেন, বেলায়েতের দরজায় পৌঁছানোর পর আহলুল্লাহ্দের দর্শন নফসের মধ্যে হয়ে থাকে। স্বীয় নফসের বাইরের দর্শন, যা 'সায়ের ইলাল্লাহ্' বা, আল্লাহর দিকে সায়েরের সময় পথিমধ্যে প্রকাশিত হয়, সে অবস্থা ধর্তব্য নয়। এই দরবেশের উপর যা প্রকাশিত হয়েছে, তা হচ্ছেঃ স্বীয় নফসের মুশাহিদা বা, দর্শন, নফসের বাইরের মুশাহিদার ন্যায় বিশ্বাসযোগ্য নয়, এই জন্য যে, উক্ত মুশাহিদা, প্রকৃতপক্ষে হক সুবহানুহুর মুশাহিদা নয়। কেননা, হক সুবহানুহু তাআ'লা যখন তুলনাহীন এবং রূপ ও বর্ণনাহীন, তখন তিনি কীরূপে তুলনারূপ দর্পণে সীমিত হতে পারেন? যদিও উক্ত দর্পণ নফসের মধ্যে অথবা, বাইরে থাকে। হক সুবহানুহু তা'আলা না দুনিয়ার মধ্যে এবং না তার বাইরে; না দুনিয়ার সঙ্গে মিলিত এবং না দুনিয়া থেকে আলাদা। আল্লাহ্ তা'আলার দর্শন, না এই দুনিয়ার মধ্যে সম্ভব এবং না এর বাইরে। আর, ঐ দর্শন, না দুনিয়ার সঙ্গে মিলিত এবং না দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। এই জন্য ঐ দর্শন, যা আখেরাতে হবে; জ্ঞানীগণ সে সম্পর্কে বলেছেন যে, ঐ দর্শন বেলা কায়েফ বা, প্রকারহীন হবে; যা জ্ঞানবুদ্ধির সীমার বাইরে। আল্লাহ্ তা'আলা এই গোপন রহস্যকে তাঁর একান্ত প্রিয় বান্দাদের নিকট এই দুনিয়াতে প্রকাশ করেছেন। যদিও তা দর্শন নয়, তথাপিও তা দর্শনের অনুরূপ। এটা সেই মহাসম্পদ, যা সাহাবায়ে কেরামদের (রিদওয়ানুল্লাহু তা'আলা 'আলাইহিম আজমাঈন) যামানার পর খুব অল্পসংখ্যক লোকেরই নসীব হয়েছে। আজও অনেকে একথা অবাস্তব বলে ধারণা করে এবং অধিকাংশ লোকই একথা গ্রহণ করবে না; তবুও এই ফকীর একথা প্রকাশ করছে। চাই অপরিণামদর্শী লোকেরা একথা কবুল করুক, আর নাই-ই করুক। এই পবিত্র নেসবতটি, এই বিশেষত্বের সাথে, আগামীতে হজরত মাহদী ('আলাইহি রিদওয়ানের) সময় প্রকাশিত হবে, ইনশাআল্লাহু তা'আলা। যারা হেদায়েতের অনুসারী এবং মোস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ প্রতিপালনকারী, তাদের প্রতি সালাম এবং তাঁর (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিবার পরিজন ও সাহাবীদের উপর সালাম ও রহমত নাযিল হোক ।
-মাবদা ওয়া মা'আদ, পৃষ্ঠা ২৩।
(লেখকঃ শায়খ আহমাদ ফারুক সিরহিন্দ মুজাদ্দেদে আলফে সানী রাহমাতুল্লাহি 'আলাইহি।)

নফীয়ে কুলঃ তালেবের জন্য এটা জরুরী যে, সে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত প্রকার বাতিল মা'বুদসমূহকে নফী বা, ধ্বংস করবে এবং প্রকৃত মা'বুদের স্থিতির জন্য তার স্মৃতিপটে যা কিছু উদয় হয়, সে সমস্তকেও বিদূরিত করে কেবলমাত্র হক তাআ'লার মওজুদ থাকাকে যথেষ্ট মনে করবে। এই মাকামে অজুদ বা, অস্তিত্বের কোনো সম্ভাবনাই নেই, কাজেই হক তায়া'লার যাতকে অজুদ ব্যতীতই তালাশ করা দরকার।

আহলে সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআ'তের আলেমগণ কী সুন্দরই না বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা'আলার অজুদ, তাঁর 'যাত' সুবহানুহু ওয়া তা'আলার উপর অতিরিক্ত। অজুদকে প্রকৃত যাত বলা এবং অজুদের উপর অন্য কোনো বিষয় স্থির না করা, দৃষ্টির সংকীর্ণতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। শায়েখ আলাউদ্দৌলা (রাহমাতুল্লাহি 'আলাইহি) বলেছেন, হক জাল্লা শানুহুর দুনিয়া অস্তিত্বের জগতেরও উর্ধ্বে; এই ফকীরকে যখন অস্তিত্বের জগতের উপর নেয়া হয়, তখন হালের আধিক্যের মধ্যে থাকাবস্থায়ও আমি নিজেকে অনুসরণ জ্ঞানের দ্বারা মুসলিম হিসাবে গণ্য করতে থাকি। মোদ্দাকথা, সম্ভাব্যের ধারণায় যা কিছু আসে, তা সম্ভাবনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। সুতরাং, অতি পবিত্র ঐ যাত, যিনি মাখলুকের জন্য- স্বকীয় পরিচিতি প্রদানের লক্ষ্যে অক্ষমতা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি।
- মাবদা ওয়া মা'আদ, পৃষ্ঠা ২৭।]


*তথ্যসূত্রঃ
*
*মাআরিফে লাদুন্নিয়া, পৃষ্ঠা-১৮; লেখকঃ শাইখ আহমাদ ফারুক সিরহিন্দ মুজাদ্দেদে আলফে সানী। (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)
*আনিছুত্তালেবীন- ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২০০; লেখকঃ হাফিজ হযরত আবদুর রহমান হানাফী। (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)
*সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ৪১; লেখকঃ বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী। (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)