সৃষ্ট সকল বস্তুর আসল সুরত গোলাকৃতির,*
সেই বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুটিই হয় অভীষ্ট মকসুদ।*
প্রভুর পবিত্র একক সত্তা মহাপবিত্র।
অবিনশ্বর সেই সত্তা অতুলনীয়, উনার অজুদ (অস্তিত্ব) উনার যাতের (সত্তার) অনুরূপ বাসিতে হাকীকী (প্রকৃত অবিমিশ্র); আর, তা বিন্দুর মতই (বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুর ন্যায়)*; (তন্মধ্যে কোনরূপ ভাগ-বন্টন হয় না। কিন্তু, অসংখ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে তা বিস্তৃত এবং প্রশস্ত বলে মনে হয়।)
*হৃদয় দর্পণে পতিত আলোক ও এর প্রতিফলনে*,
*আয়নাটির পারা রূপে বিরাজমান স্রষ্টার ধ্রুবসত্য তাওহীদ।*

আল্লাহ্‌ তা'আলা নিরাকার;
- আনিছুত্তালেবীন। (৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৫৬)

(ছিফাতে ছালবিয়াঃ
আল্লাহ্‌ তা'আলা স্থানে ও কালে আবদ্ধ নন, কোন বস্তুতে মিলিত নন, কোন দিকে নন, উনার তুল্য কোন বস্তু নেই।)
- আনিছুত্তালেবীন। (৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৬৪)

হক সুবহানুহু তা'আলার অস্তিত্ব, যাহা তাঁহার যাতের অনুরূপ বাসিতে হাকীকী (প্রকৃত অবিমিশ্র) এবং বিন্দুর মত; তন্মধ্যে কোনরূপ ভাগ বণ্টন হয় না। কিন্তু, অসংখ্য বিষয়ের সহিত সম্পর্ক রাখার কারণে উহা বিস্তৃত এবং প্রশস্ত বলিয়া মনে হয়।

এইস্থানে এইরূপ প্রশ্ন করা অবান্তর, যখন এই জ্ঞানগত অবস্থা এ কারণে যে, উহার সহিত যাতের সম্পর্ক স্থায়ী হইয়া যায়, তখন এইরূপ মনে হয়, যেন উহা যাতের আয়নায় বিদ্যমান। একইরূপে, এই জ্ঞানগত অবস্থা আসমা ও সিফাতের (নাম ও গুণাবলীর) আয়নায়ও বিদ্যমান। আর, এই আসমা ও সিফাত, যাহা উহাদের প্রত্যেকের আয়নায় প্রকাশ পায়, উহা ঐ বিষয়ের একটি বিশেষ রূপ। কাজেই, ইহার দ্বারা অবশ্যম্ভাবী যে, যাতের মধ্যে বস্তুকে, অবস্তু হিসাবে ধরিতে হইবে এবং ভাগ বণ্টনের অর্থও এইরূপ। এমতাবস্থায়, আমাদের বক্তব্য এই যে, এই প্রশ্নের জবাব কয়েকটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত।

প্রথম ব্যাপার হইলোঃ বিন্দু মওজুদ থাকে এবং উহা কোনভাবেই ভাগ বণ্টনযোগ্য নয়। যেমন, ইহা জ্ঞানী ও অন্যান্যদের অভিমত।

দ্বিতীয় ব্যাপার হইলোঃ গণিত শাস্ত্রের নিয়মে ইহা নির্ধারিত সত্য যে, বৃত্তের কেন্দ্র সব সময় বিন্দুই হইয়া থাকে। যাহা কখনই ভাগ বণ্টনকে স্বীকার করে না।

তৃতীয় ব্যাপার হইলোঃ গণিত শাস্ত্রের নিয়মে এই কথাও প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বৃত্তের কেন্দ্র হইতে এমন রেখা নির্গত হওয়া সম্ভব, যাহা বৃত্তের শেষ প্রান্তে যাইয়া শেষ হয়। বরং, কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, উহা বৃত্তের বিন্দুসমূহের উপরে গিয়া শেষ হয়। কেননা, রেখার শুরু যেমন বিন্দুতে হয়, তদ্রূপ, উহার সমাপ্তিও ঘটে বিন্দুতে।

কাজেই, উপর্যুক্ত ব্যাপার তিনটির আলোকে বলা যায় যে, যখন বিন্দু হইতে অসংখ্য রেখার উৎপত্তিতে এবং প্রকৃত-অধিক বিষয়, সৃষ্টির উৎস হওয়া সত্ত্বেও বিন্দুর একক এবং মিশ্রিত হওয়ার কোন অসুবিধা হয় না এবং উহা একইরূপে অবিভক্তরূপে বিদ্যমান থাকে। এমতাবস্থায়, যদি হক-সুবহানুহুর ওজুদ (অস্তিত্ব), কাছরাতে আহমী (ধারণায় অনুমিত) এর উৎস হয় এবং উহার অবিমিশ্র হওয়াতে কোনরূপ ক্ষতির কারণ হয় না। বরং, ইহার দ্বারা তিনি আরো উত্তমভাবে স্বীয় এককত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকেন। ঐ যাত অতি পবিত্র, যিনি স্বীয় যাত, সিফাত এবং আসমার দ্বারা সৃষ্টিজগতের নশ্বরতা সত্ত্বেও কোনরূপ পরিবর্তনকে কবুল করেন না।

শায়েখ আকরব স্বীয় গ্রন্থ ফতুহাতে মক্কীয়ায় বর্ণনা করিয়াছেন যে, ঐ প্রত্যেক রেখা, যাহা বিন্দু হইতে বৃত্তের শেষের দিকে সম্প্রসারিত হয়, উহা এক সময় বৃত্তের শেষ বিন্দুতে গিয়া মিলিত হয়। আর, ঐ কেন্দ্রবিন্দু, যাহা হইতে সমস্ত রেখার উৎপত্তি ঘটে এবং বৃত্তের শেষ প্রান্তের দিকে সম্প্রসারিত হয়; উহা স্বীয় যাতের মধ্যে আধিক্যতাকে কবুল করে না। কাজেই, ইহার দ্বারা জানা গেল যে, এমন একটি জিনিস যাহা নির্ধারিত একক সদৃশ্য, উহা হইতে আধিক্যতা প্রকাশ পাইতে পারে। এতদসত্ত্বেও ঐ একক নির্ধারিত বস্তুটি স্বীয় যাতের মধ্যে আধিক্যতাকে কবুল করে না। কাজেই যিনি এইরূপ উক্তি করেন, একটি বস্তু হইতে একটি বস্তুই প্রকাশ পাইয়া থাকে, ইহা সঠিক নয়।
- মাআরিফে লাদুন্নিয়া। (পৃষ্ঠা ১৮, ১৯)

মুশাহিদাঃ মাশায়েখগণ বলেছেন, বেলায়েতের দরজায় পৌঁছানোর পর আহলুল্লাহদের দর্শন নফসের মধ্যে হয়ে থাকে। স্বীয় নফসের বাইরের দর্শন, যা 'সায়ের ইলাল্লাহ্' বা, আল্লাহর দিকে সায়েরের সময় পথিমধ্যে প্রকাশিত হয়, সে অবস্থা ধর্তব্য নয়। এই দরবেশের উপর যা প্রকাশিত হয়েছে, তা হচ্ছেঃ স্বীয় নফসের মুশাহিদা বা, দর্শন, নফসের বাইরের মুশাহিদার ন্যায় বিশ্বাসযোগ্য নয়, এই জন্য যে, উক্ত মুশাহিদা, প্রকৃতপক্ষে হক সুবহানুহুর মুশাহিদা নয়। কেননা, হক সুবহানুহু তাআ'লা যখন তুলনাহীন এবং রূপ ও বর্ণনাহীন, তখন তিনি কীরূপে তুলনারূপ দর্পণে সীমিত হতে পারেন? যদিও উক্ত দর্পণ নফসের মধ্যে অথবা, বাইরে থাকে। হক সুবহানুহু তা'আলা না দুনিয়ার মধ্যে এবং না তার বাইরে; না দুনিয়ার সঙ্গে মিলিত এবং না দুনিয়া থেকে আলাদা। আল্লাহ্ তা'আলার দর্শন, না এই দুনিয়ার মধ্যে সম্ভব এবং না এর বাইরে। আর, ঐ দর্শন, না দুনিয়ার সঙ্গে মিলিত এবং না দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। এই জন্য ঐ দর্শন, যা আখেরাতে হবে; জ্ঞানীগণ সে সম্পর্কে বলেছেন যে, ঐ দর্শন বেলা কায়েফ বা, প্রকারহীন হবে; যা জ্ঞানবুদ্ধির সীমার বাইরে। আল্লাহ্ তা'আলা এই গোপন রহস্যকে তাঁর একান্ত প্রিয় বান্দাদের নিকট এই দুনিয়াতে প্রকাশ করেছেন। যদিও তা দর্শন নয়, তথাপিও তা দর্শনের অনুরূপ। এটা সেই মহাসম্পদ, যা সাহাবায়ে কেরামদের (রিদওয়ানুল্লাহু তা'আলা 'আলাইহিম আজমাঈন) যামানার পর খুব অল্পসংখ্যক লোকেরই নসীব হয়েছে। আজও অনেকে একথা অবাস্তব বলে ধারণা করে এবং অধিকাংশ লোকই একথা গ্রহণ করবে না; তবুও এই ফকীর একথা প্রকাশ করছে। চাই অপরিণামদর্শী লোকেরা একথা কবুল করুক, আর নাই-ই করুক। এই পবিত্র নেসবতটি, এই বিশেষত্বের সাথে, আগামীতে হজরত মাহদী ('আলাইহি রিদওয়ানের) সময় প্রকাশিত হবে, ইনশাআল্লাহু তা'আলা। যারা হেদায়েতের অনুসারী এবং মোস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ প্রতিপালনকারী, তাদের প্রতি সালাম এবং তাঁর (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিবার পরিজন ও সাহাবীদের উপর সালাম ও রহমত নাযিল হোক ।
-মাবদা ওয়া মা'আদ, পৃষ্ঠা ২৩।
(লেখকঃ শায়খ আহমাদ ফারুক সিরহিন্দ মুজাদ্দেদে আলফে সানী রাহমাতুল্লাহি 'আলাইহি।)

নফীয়ে কুলঃ তালেবের জন্য এটা জরুরী যে, সে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত প্রকার বাতিল মা'বুদসমূহকে নফী বা, ধ্বংস করবে এবং প্রকৃত মা'বুদের স্থিতির জন্য তার স্মৃতিপটে যা কিছু উদয় হয়, সে সমস্তকেও বিদূরিত করে কেবলমাত্র হক তাআ'লার মওজুদ থাকাকে যথেষ্ট মনে করবে। এই মাকামে অজুদ বা, অস্তিত্বের কোনো সম্ভাবনাই নেই, কাজেই হক তায়া'লার যাতকে অজুদ ব্যতীতই তালাশ করা দরকার।

আহলে সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআ'তের আলেমগণ কী সুন্দরই না বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা'আলার অজুদ, তাঁর 'যাত' সুবহানুহু ওয়া তা'আলার উপর অতিরিক্ত। অজুদকে প্রকৃত যাত বলা এবং অজুদের উপর অন্য কোনো বিষয় স্থির না করা, দৃষ্টির সংকীর্ণতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। শায়েখ আলাউদ্দৌলা (রাহমাতুল্লাহি 'আলাইহি) বলেছেন, হক জাল্লা শানুহুর দুনিয়া অস্তিত্বের জগতেরও উর্ধ্বে; এই ফকীরকে যখন অস্তিত্বের জগতের উপর নেয়া হয়, তখন হালের আধিক্যের মধ্যে থাকাবস্থায়ও আমি নিজেকে অনুসরণ জ্ঞানের দ্বারা মুসলিম হিসাবে গণ্য করতে থাকি। মোদ্দাকথা, সম্ভাব্যের ধারণায় যা কিছু আসে, তা সম্ভাবনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। সুতরাং, অতি পবিত্র ঐ যাত, যিনি মাখলুকের জন্য- স্বকীয় পরিচিতি প্রদানের লক্ষ্যে অক্ষমতা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি।
- মাবদা ওয়া মা'আদ, পৃষ্ঠা ২৭।

*তথ্যসূত্রঃ
*
*মাআরিফে লাদুন্নিয়া, পৃষ্ঠা-১৮; লেখকঃ শাইখ আহমাদ ফারুক সিরহিন্দ মুজাদ্দেদে আলফে সানী। (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)
*আনিছুত্তালেবীন- ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২০০; লেখকঃ হাফিজ হযরত আবদুর রহমান হানাফী। (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)
*সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ৪১; লেখকঃ বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী। (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)

হজরত মুজাদ্দিদে আলফে সানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর জযবা ও সুলুক সম্পর্কেঃ
জানা কর্তব্য যে, ইনায়েতে ইলাহী জাল্লা-সুলতানুহু সর্বপ্রথম আমাকে তাঁহার প্রতি আকর্ষিত করেন, যেমন- মুরাদের মাকামে উপনীত ব্যক্তিদেরকে আকর্ষিত করা হয়। অতঃপর, দ্বিতীয় পর্যায়ে, আমার জন্য এই জযবা, সুলুকের মঞ্জিল অতিক্রমণ সহজ করিয়া দেয়। বস্তুতঃ, প্রথমাবস্থায় আমি হক তা'আলার যাতকে, বস্তুর অনুরূপ প্রাপ্ত হই; যেমন- পরবর্তীকালের সুফিয়ায়ে কেরাম (তওহীদে-ওজুদীর মাকামে উপনীত ব্যক্তিগণ) এরশাদ করিয়াছেন। অতঃপর, আমি হক তা'আলাকে সমস্ত বস্তুর মধ্যে প্রাপ্ত হই, এমতাবস্থায় যে, তিনি উহাদের মধ্যে হলুল বা, প্রবেশ করেন নাই। পরে আমি হক তা'আলাকে মায়ীয়াতে যাতিয়া হিসাবে, সমস্ত বস্তুর সাথে অনুভব করি। অতঃপর, আমি হক তা'আলাকে সমস্ত বস্তুর পরে প্রাপ্ত হই। পরে সব বস্তুর প্রথমে পাই।

অতঃপর, আমি হক তা'আলা সুবহানুহুকে অবলোকন করি; আর, সেখানে কোনকিছুই আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই। ইহাই হইল তওহীদে শুহুদীর অর্থ-  যাহাকে ফানা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। বেলায়েতের রাস্তায় ইহাই প্রথম পদক্ষেপের স্থান। আর, ইহাই ইল কামালাতের সর্বশেষ স্তর, যাহা প্রথমে হাসিল হইয়া থাকে। আর, এই দর্শন, যাহা আলোচিত স্তরসমূহের যে কোন স্তরেই প্রকাশ পাইতে পারে, প্রথমে ইহা বহির্জগতে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্তর্জগতে প্রকাশ পায়।

অতঃপর, আমি বাকার স্তরে উন্নীত হই, যাহা বেলায়েতের রাস্তায় দ্বিতীয় পদক্ষেপস্বরূপ। পরে আমি সমস্ত বস্তুকে দ্বিতীয়বার অবলোকন করি এবং আমি হক তা'আলা সুবহানুহুকে এই সমস্ত বস্তুর অনুরূপ প্রাপ্ত হই; বরং, আমার নিজের মতই পাই। অতঃপর, আমি আল্লাহ্‌ তা'আলাকে সমস্ত বস্তুর মধ্যে দেখি; বরং, স্বয়ং আমার নাফসের মধ্যে অবলোকন করি। পরে বস্তুর সাথে; বরং, আমার নিজের সাথেই দেখি; অতঃপর, বস্তুর প্রথমে; বরং, নিজেরও প্রথমে অবলোকন করি। পরে আমি হক তা'আলাকে বস্তুর পশ্চাতে দেখি; বরং, আমি আমাকে পরে অবলোকন করি। অতঃপর, আমি বস্তুই দেখিতে পাই এবং আল্লাহ্ তা'আলাকে আদৌ দেখিতে পাই নাই। আর, ইহাই ছিল সর্বশেষ পদক্ষেপ, যেখান হইতে প্রথম পদক্ষেপের দিকে প্রত্যাবর্তন করিতে হয়। আর, এই মাকাম হইল মাখলুককে হক সুবহানুহুর দিকে দাওয়াত দেওয়ার এবং আহবান করিবার জন্য পরিপূর্ণ মাকাম। আর, এই মঞ্জিলই পূর্ণরূপে হাসিল হয়। কেননা, পূর্ণ দরজার ফায়দা পৌঁছানো এবং ফায়দা হাসিল করিবার জন্য ইহাই প্রয়োজন। আর, ইহাই আল্লাহর ফযল; তিনি যাহাকে ইচ্ছা- ইহা প্রদান করেন। আর, আল্লাহ্ বড়ই ফযলওয়ালা। আর, আলোচিত সমস্ত অবস্থা এবং লিখিত সমস্ত কামালাত আমার হাসিল হয়। বরং, ইহা ঐ সমস্ত ব্যক্তিরই হাসিল হইয়া থাকে, যাঁহারা সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও পরিপূর্ণ মানব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তোফায়েলের সহিত সম্পৃক্ত। ইয়া আল্লাহ্! আমাদিগকে আপনার অনুসরণের উপর সুদৃঢ় রাখুন এবং আমাদের হাশর, আপনার-ই দলের সাথে করুন। (তাঁহাদের উপর সালাম ও শান্তি বর্ষিত হউক)। ইয়া আল্লাহ্‌! আপনি ঐ বান্দার প্রতি রহম করুন, যে আমার এই দোয়ার প্রতি আমীন বলে। তাঁহাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হউক- যাঁহারা হিদায়েতের অনুসরণ করেন।
- মাআরিফে লাদুন্নিয়া। [মারেফত আটত্রিশ] (পৃষ্ঠা ৭৮,৭৯)

হক তা'আলার মিছাল হয় না, মিছাল হতে পারেঃ হক সুবহানুহু ওয়া তাআ'লা 'মিছাল' বা, সাদৃশ্য থেকে পবিত্র। যেমন, আল্লাহর বাণীঃ 'তাঁর সদৃশ কিছুই নাই।' (সূরা শূরা, আয়াত ১১)
কিন্তু, উলামারা 'মিছাল' বা, 'মাছাল' কে জায়েয বলেছেন। যেমন, আল্লাহর বাণীঃ 'আল্লাহ্‌ তাআ'লার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট উপমা আছে, অথবা, আল্লাহর জন্যই তো সর্বোকৃষ্ট শান বা, মর্যাদা'। (সূরা নাহল, আয়াত ৬০)
সুলুকের পথে ভ্রমণকারীগণ এবং কাশফের অধিকারীরা উপমার দ্বারাই শান্তিপ্রাপ্ত হন এবং ধ্যানের মাধ্যমে তৃপ্তি লাভ করেন। তারা বর্ণনাহীনকে বর্ণনাযুক্ত দেখতে থাকেন- যাতে ওয়াজেবকে সম্ভাবনার আকৃতিতে পান। বেচারা সালেক, দৃষ্টান্তকে দৃষ্টান্তের মালিকের অনুরূপ মনে করে এবং সুরত বা, আকৃতিকে- আকৃতির মালিকের অনুরূপ ধারণা করে থাকে। এর কারণ এই যে, সালেক হক্ সুবহানুহু ওয়া তাআ'লার পরিবেষ্টনকারী আকৃতিকে, সমস্ত বস্তুর মধ্যে পরিদর্শন করে এবং ঐ পরিবেষ্টনের উপমাকে সমস্ত দুনিয়ার মধ্যে মুশাহিদা করে এবং সে মনে করে যে, যা কিছু দৃষ্টিগোচর হয়, তার সবই হক সুবহা-নুহুর আবেষ্টনীর হাকীকত। কিন্তু, প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। কেননা, হক তাআ'লার বেষ্টনী তো দৃষ্টান্ত ও তুলনাহীন এবং তিনি শুহুদ বা, দর্শন এবং 'প্রকাশ পাওয়া' অবস্থা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। আমরা এই কথার উপর ঈমান রাখি যে, আল্লাহ্‌ তাআ'লা সব বস্তুর পরিবেষ্টনকারী; কিন্তু, আমরা তাঁর এই পরিবেষ্টনের স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত নই? আমরা যা কিছু জানি, তা হলো এই পরিবেষ্টনের তুল্য অবস্থা। হক্ তাআ'লার কুরব বা, নৈকট্য এবং মা'য়ীআত বা, সঙ্গতাকে এর উপর কিয়াস বা, ধারণা করতে হবে। যা কিছু কাশফ ও মুশাহিদার মধ্যে আসে, তা তো আনুরূপ্য মাত্র, হাকীকত বা, আসলরূপ নয়। বরং, এই সমস্ত কথার বাস্তবরূপও অজ্ঞাত। আমরা এর উপর ঈমান রাখি যে, হক তাআ'লা আমাদের নিকটে এবং সঙ্গে; কিন্তু, আমরা এটা জানি না যে, এই নৈকট্য ও সঙ্গতার হাকীকত কি? এ সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ আছেঃ 'আমাদের রব হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় প্রকাশিত হবেন।' এই বাক্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিছালী আকৃতি বর্ণনা করেছেন। কারণ, পূর্ণ রেজা (সন্তুষ্টি) অর্জনের দৃষ্টান্ত হাস্যোজ্জ্বল আকৃতিই হওয়া উচিত। একইভাবে হাত, চেহারা, পা, অঙ্গুলী ইত্যাদির দৃষ্টান্তও অনুমান করা যেতে পারে।
[মাবদা ওয়া মা'আদ, মিনহা ৬০, পৃষ্ঠা ৯৮]

সতর্কবাণীঃ হাল, জযবা, ইলম ও মা'রেফাতসমূহ বর্ণনার কালে, যদি এই লেখকের (হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির) বক্তব্যের মধ্যে কোনোরূপ বৈসাদৃশ্য ও বৈপরিত্য পরিলক্ষিত হয়, তবে তা সময়ের বিভিন্নতা এবং হাল ও অবস্থার পার্থক্যের কারণে হয়েছে মনে করতে হবে। কেননা, প্রত্যেক সময়ের হাল ও জযবাসমূহ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে এবং প্রত্যেক অবস্থার জ্ঞান ও মা'রেফাতসমূহ স্বতন্ত্র হয়। সুতরাং, প্রকৃতপক্ষে এটা কোনো বৈসাদৃশ্য ও বৈপরিত্য নয়। এর উদাহরণ শরীয়তের হুকুম-আহকামের মতো। যেমন, তা মানসুখ বা, পরিবর্তনের পর, বিপরীত হুকুম বলে মনে হয়। কিন্তু, যখন সময় ও অবস্থার বিভিন্নতাকে সম্মুখে রাখা হয়, তখন এ মতানৈক্য ও বৈপরিত্য আর থাকে না। এর মধ্যে আল্লাহ্ সুবহা-নুহু ওয়া তাআ'লার হিকমত এবং কল্যাণ নিহিত আছে। কাজেই, তোমরা কেউই সন্দেহবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
আমাদের নেতা ও সরদার হজরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং উনার পরিবার-পরিজনদের উপর দরূদ, সালাম ও বরকত নাযিল হোক।
- মাবদা ওয়া মা'আদ (মিনহা একষট্টি, পৃষ্ঠা ৯৯)

তাওহিদের সারমর্মঃ

তাওহিদ সাধারণতঃ দুই প্রকার। যথাঃ- অজুদি ও শহুদি।

(১) অজুদি- উহা এক খোদা তা'আলাকেই একমাত্র موجود (মাওজুদ- বিদ্যমান) মনে করা এবং সৃষ্ট পদার্থসমূহকে তাহারই জহুর (প্রকাশ) ব্যতীত আর কিছুই না বলিয়া মনে করা। এই তাওহিদে অজুদির মধ্যে علم اليقين -এলমূল ইয়াকিন; অর্থাৎ, জ্ঞান বা, বিবেকের বিশ্বাস হাছিল হয়। কারণ, ইহাতে জ্ঞান ও অনুভবের কার্য্য বর্তমান থাকে।

(২) শহুদি- উহা সকল সৃষ্টি বর্তমান থাকা সত্ত্বেও ছালেকের চক্ষে এক খোদা তা'আলা ব্যতীত অন্য বস্তু দৃষ্টিগোচর না হওয়া; তাওহিদে শহুদিতে عين اليقين -আইনুল ইয়াকিন (চক্ষুদর্শনে যে বিশ্বাস জন্মে) হাছিল হয়। চিন্তাশক্তি ব্যতীতই এক খোদা ভিন্ন অন্য কোন বস্তু দর্শকের দৃষ্টি পথে পতিত হয় না। কারণ, একের প্রেমাধিক্য যেমন অন্য সমস্ত পদার্থকে অদৃশ্য করে, সূর্যোদয় হইলে যেরূপ নক্ষত্র সকল দেখা যায় না, তদ্রুপ প্রেমসূর্য প্রকাশ হইলে এক খোদা তা'আলা ভিন্ন অন্য কোন পদার্থই দৃষ্টিপথে পতিত হয় না। এই তাওহীদে শহুদী ছালেকদিগের জন্য নিতান্ত আবশ্যকীয় বস্তু; কারণ, ইহা ব্যতীত পূর্ণ ফানা লাভ হয় না। পূর্ব বর্ণিত তাওহিদে অজুদি হাছিল হইলে খোদা ব্যতীত কোন অজুদই দেখা যায় না; কারণ, ইহাতে দ্বিতীয়ত্ব জ্ঞান রহিত হইয়া একত্ব জ্ঞান জন্মে, আর এই জ্ঞান জন্মিলে 'হুয়াজ্জাহেরো' বাক্যের মর্মানুসারে সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর মধ্যেই খোদা তা'আলার অজুদ (অস্তিত্ব) স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।

তাওহিদে অজুদীঃ

বেলায়েতে ছোগরাতে কালবের ছায়ের করার সময় তাওহিদের নিছবাত অধিক হইয়া পড়িলে, ছালেকগণ আত্মহারা হইয়া সৃষ্ট বস্তু ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যে প্রভেদ করিতে সক্ষম নাও হইতে পারে এবং এই ধারণা এরূপ প্রবল হইয়া পড়িতে পারে যে, নিজ অজুদ (অস্তিত্ব) ও জগতের অস্তিত্বকে ভুলিয়া গিয়া শরীয়ত বিরোধী আনাল হক ইত্যাদি শব্দ বলিতে পারে; যদি ইহা আত্মহারা অবস্থায় বলিয়া থাকে, তবে ক্ষমা পাইতে পারে; আর যদি ফানা বাকা হাছিল হওয়ার পূর্বে বলিয়া থাকে, তবে উহা খাঁটি কুফুরী।

তাওহিদে শহুদিঃ

বেলায়েতে কোবরা পয়গম্বরগণের বেলায়েত। ইহাতে জ্ঞান ও চেতনা শক্তি পূর্ণ মাত্রায় থাকে; এই হেতু তাওহিদ ও প্রেমের আধিক্যবশতঃ স্পষ্ট বুঝিতে পারে যে, সৃষ্টি, খোদা তা'আলার আছমা ও ছিফাতের ছায়া বা, প্রতিবিম্ব ব্যতীত আর কিছুই নহে। বেলায়েতে ছোগরাতে আত্মহারা অবস্থায় যে, সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তাকে একই ধারণা করিয়াছিল, বেলায়েতে কোবরাতে উক্ত ধারণা দূরীভূত হইয়া যায়, এই পার্থক্য ভাবকেই তাওহিদে শহুদি বলিয়া থাকে। এই দায়েরাতে দায়েরায়ে এমকান ও দায়েরায়ে জেলালের তাজাল্লি অপেক্ষা অধিক রৌশনি প্রকাশিত হইয়া থাকে।

- আনিছুত্তালেবীন। (৫ম খন্ড, ২৬৫-২৬৬ পৃষ্ঠা)
লেখকঃ হাফিজ মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান হানাফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।

"কাশফ দ্বারা ছুরাতে মিছালিতে অদর্শনীয় বস্তুর দর্শন লাভ হইয়া থাকে; تمثل অর্থাৎ, নিজের ব্যক্তিত্ব ও গুণাবলী বজায় রাখিয়া অন্য আকার ধারণ করা। আর, দ্বিতীয় আকৃতিকেই ছুরাতে মিছালি বলে। যেরূপ হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম মানুষের আকার ধারণ করিতেন, কিন্তু তাঁহার ফিরিশতাত্ব নষ্ট হইত না; তদ্রুপ আল্লাহু তা'আলা নিরাকার, তাঁহাকে কাশফ দ্বারা বা, স্বপ্নে ছুরাতে মিছালিতে দেখা যাইতে পারে, যেরূপ হযরত মুছা আলাইহিস সালাম তূর পর্বতে দর্শন করিয়াছিলেন। কিন্তু, যদি কেহ খোদা তা'আলাকে ছুরাতে মিছালিতে দেখিয়া আকার ধারণা করে তবে সে কাফের হইবে।"
- আনিছুত্তালেবীন। (৫ম খন্ড, ২৫৬ পৃষ্ঠা)

আল্লাহ্ দর্শনঃ

আল্লাহ্ তা'আলার দীদার বা, দর্শনের দু'টি পদ্ধতি রয়েছে।

১. আখিরাতে কোন প্রকার মধ্যস্থতা ব্যতীত হৃদয় দর্পনে আল্লাহর জামাল (সৌন্দর্য) অবলোকন করা।
২. পৃথিবীতে কোন মধ্যস্থতা দ্বারা অন্তরদর্পনে আল্লাহর গুণাবলীর দর্শন লাভ করা।

দুনিয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার সৌন্দর্যের প্রতিবিম্ব অন্তরদৃষ্টি দ্বারা দেখা যায়।

আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করেন-
مَا کَذَبَ الۡفُؤَادُ مَا رَاٰی

'যা তিনি দেখেছেন, উনার অন্তঃকরণ তা অস্বীকার করেনি।'

[সূরা নাজম, ৫৩/১১]

অর্থাৎ, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে, পবিত্র অন্তঃকরণে আল্লাহর দর্শন লাভ করেছেন, তা মিথ্যা নয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন-

الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ ،

'মুমিন মুমিনের দর্পণস্বরূপ।'

এখানে প্রথম 'মুমিন' দ্বারা বান্দার অন্তর ও দ্বিতীয় 'মুমিন' দ্বারা আল্লাহর মহান সত্তাকে বুঝানো হয়েছে। অতএব, যে ব্যক্তি এ পৃথিবীতে আল্লাহর সিফাতসমূহ দর্শন করেছে, সে পরজগতে স্বয়ং আল্লাহর যাতকে আকারহীনভাবে দর্শন করবে। আউলিয়ায়ে কেরাম আল্লাহর সৌন্দর্যের গুণাবলী দর্শনের ব্যাপারে ওইরূপ বিভিন্ন দাবী করেছেন। যেমন, হযরত সায়্যিদুনা ফারুকে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন-

رَاَي قَلْبِي رَبِّي بِنُوْرِ رَبِّي ،

'আমার অন্তর আমার রবকে উনার জ্যোতি দ্বারা দর্শন করেছে।'

হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর বাণী-

لَمْ أَعْبُدْ رَبَّا لَمْ أَرَاهُ ،

'আমি এমন রবের ইবাদত করি না, যাকে আমি দেখিনা; কিংবা, 'আমি আমার রবের ইবাদত তাকে দেখে দেখে করি।'
এসব দর্শন মূলত আল্লাহর গুণাবলী অবলোকন প্রসঙ্গে। যেমন, কেউ আলোক রশ্মি কিংবা, জানালা দিয়ে সূর্যের আলোকচ্ছটা দেখে বলে 'আমি সূর্য দেখেছি।' আল্লাহ্ তা'আলা কুরআন মজীদে উনার গুণাবলীকে নূর বা, জ্যোতি দ্বারা পরিচয় দিয়েছেন। যেমন এরশাদ করেছেন-

اَللّٰہُ نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَالۡاَرۡضِ ؕ  مَثَلُ نُوۡرِہٖ کَمِشۡکٰوۃٍ فِیۡہَا مِصۡبَاحٌ ؕ  اَلۡمِصۡبَاحُ فِیۡ زُجَاجَۃٍ ؕ  اَلزُّجَاجَۃُ کَاَنَّہَا کَوۡکَبٌ دُرِّیٌّ یُّوۡقَدُ مِنۡ شَجَرَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ زَیۡتُوۡنَۃٍ لَّا شَرۡقِیَّۃٍ وَّلَا غَرۡبِیَّۃٍ ۙ  یَّکَادُ زَیۡتُہَا یُضِیۡٓءُ وَلَوۡ لَمۡ تَمۡسَسۡہُ نَارٌ ؕ  نُوۡرٌ عَلٰی نُوۡرٍ ؕ  یَہۡدِی اللّٰہُ لِنُوۡرِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ  وَیَضۡرِبُ اللّٰہُ الۡاَمۡثَالَ لِلنَّاسِ ؕ  وَاللّٰہُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ۙ

'আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীনের আলো। উনার আলোর উপমা এমনই যেমন একটা দীপাধার, যার মধ্যে রয়েছে প্রদীপ। ঐ প্রদীপ একটা ফানুসের মধ্যে স্থাপিত। ঐ ফানুস যেন একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, তা প্রজ্জ্বলিত হয় বরকতময় বৃক্ষ যায়তুন দ্বারা।'

[সূরা নূর, ২৪/৩৫]

ওলামায়ে কেরাম বলেন, এ আয়াতে 'দীপাধার' (مشكوة) মানে ঈমানদারের কলব (অন্তঃকরণ), 'প্রদীপ' (مصباح) মানে রহস্যধারী অন্তর যাকে রূহে-সুলতানী বলা হয় ও 'ফানুস' (زجاجة) মানে জ্যোতির্ময় বাতিনী অন্তর। যেটাকে অতি উজ্জ্বল্যের কারণে আলোক ও চমকদার মুক্ত দ্বারা উপমা দেয়া হয়েছে। তারপর জ্যোতির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আর সেটাকে জ্যোতির উৎস ও কেন্দ্র বলা হয়েছে।
মা'দান (معدن) বা, খনি এমন স্থানকে বলা হয় যেখান থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উদগত হয়। আর, এ জ্যোতি যায়তুন বৃক্ষ দ্বারা প্রজ্জ্বলিত হয়। যা দ্বারা তালকীন (দীক্ষা) বৃক্ষ ও অকৃত্রিম তাওহীদ উদ্দেশ্য। যেটার উৎসস্থল অংশীদারীত্বহীন গাইরে-কুদসী সিফাতের রসনা। যেমন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন মজীদ স্বয়ং আল্লাহ্ তা'আলার নিকট শিক্ষা লাভ করেছেন। কিন্তু, এরপরও হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের অবতরণ তো হেকমত ও মুসলেহাতের নিরিখে ছিল, যেন কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকদের উপর দলীল ও প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দাবী প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলার এ বাণী ইঙ্গিতবহ-

وَاِنَّکَ لَتُلَقَّی الۡقُرۡاٰنَ مِنۡ لَّدُنۡ حَکِیۡمٍ عَلِیۡمٍ

'নিশ্চয় আপনি প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞাতার পক্ষ থেকে কুরআনের জ্ঞান প্রাপ্ত।'

[সূরা নমল, ২৭/৬]

এ কারণে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আগমনের পূর্বেও হুযূর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময় সাহাবায়ে কেরামদেরকে আয়াতে কারীমা শিক্ষা দিতেন। এমন কি আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করলেন, 'হে হাবীব!(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি কুরআন পাঠে তাড়াতাড়ি করবেন না, যতক্ষণ না ওহী আগমন করে।' ঠিক একই কারণই নিহিত ছিল যে, মি'রাজ রজনীতে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম পেছনে রইলেন, আর তিনি সিদরাতুল মুনতাহারও ঊর্ধ্বালোকে পরিভ্রমণ করে আসলেন। অতঃপর, আল্লাহ্ তা'আলা কুরআন মাজীদে ঐ বরকতময় (যায়তুন) বৃক্ষের বর্ণনা দিয়েছেন-

لَّا شَرۡقِیَّۃٍ وَّلَا غَرۡبِیَّۃٍ ۙ

'সেটা না প্রাচ্যের, না পাশ্চাত্যের।'

[সূরা নূর, ২৪/৩৫]

আর, সেটার পরিসীমা ও অস্তিত্বের সাথে না কোনরূপ উদয় ও অস্তের সম্বন্ধ রয়েছে; বরং, তা অনাদি, অনন্ত ও অবিনশ্বর। যেভাবে আল্লাহ্ তা'আলা অনাদি, স্থায়ী। উনার সত্তা আদি ও অন্ত এবং ধ্বংস হওয়া থেকে যেমন পবিত্র, তেমনি উনার সিফাত বা, গুণাবলীও অবিনশ্বর। কারণ, উনার জ্যোতি (نور) ও যাবতীয় গুণ উনার সত্তার সাথে অস্তিত্বময়। অতএব, যতক্ষণ হৃদয়দর্পন থেকে আবরণ উন্মোচিত ও অপসারিত না হবে, ততক্ষণ উনার এ জ্যোতির বিকাশ ও তত্ত্বজ্ঞান (معرفة) লাভ করা অসম্ভব। আবরণসমূহ উন্মোচিত হওয়া ও আল্লাহর নূরে অন্তঃকরণ আলোকিত হওয়া আল্লাহ্ তা'আলার গুণাবলীর সৌন্দর্য দর্শনের মাধ্যম। আর, তখন এ গুঢ় রহস্যও উন্মোচিত হয়ে যায় যে, বিশ্বজগত সৃষ্টিতে এ হিকমতই নিহীত আছে যে, তা দ্বারা উনার গুপ্ত ভাণ্ডার প্রকাশ ও পর্যবেক্ষণ করানো। হাদীসে কুদসীতে রয়েছে-

'আমি এক গুপ্ত রহস্যের আধার ছিলাম। অতঃপর, ইচ্ছা করলাম যেন আমি পরিচিত হই, তখন আমি জগৎ সৃষ্টি করলাম, যেন তারা আমার পরিচয় লাভ করে।'

[নিশাপুরী, তাফসীরে নিশাপুরী, ১/২০৩; মোল্লা আলী কারী: মিরকাতুল মাফাতীহ, ১/৩৫৬]

[উল্লেখ্য, আল্লাহ্ তা'আলা সর্বপ্রথম স্বীয় মাহবুব আহমাদ মুজতাবা মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করেছেন। যেভাবে অবিচ্ছেদ্য সূত্রে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহর দীদার তো ইনশাআল্লাহ আখিরাতে কপালের চক্ষু দ্বারা হবে। যেটাকে তিফলুল মা'আনী বলা হয়। মহান রবের বাণী-

'কিছু মুখ সেদিন সজীব হবে, যারা আপন রবের দর্শন লাভ করবে।'

[সূরা কিয়ামাহ্, ৭৫/২২-২৩]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন-

'আমি আমার রবকে শ্মশ্রুহীন যুবকের আকৃতিতে দেখেছি।'

অর্থাৎ, মহান রবের নূর ও তাজাল্লী হৃদয় দর্পনে অবলোকন করেছি। কারণ, ঐ আকৃতি হল রূহানী দর্পণ, যা জ্যোতি ও জ্যোতি-অবলোকনকারীর মধ্যে একটি মাধ্যম মাত্র। যখন আল্লাহ্ তা'আলা আকৃতি-প্রকৃতি, পানাহার ও অস্তিত্বের বৈশিষ্ট্যাবলী ও প্রভাব থেকে পূতঃপবিত্র। সুতরাং, তাঁর আকৃতি একটি দর্পণ মাত্র। (আর, এ 'দর্পণ' শব্দটিও শুধুমাত্র বুঝানোর জন্য; অন্যথায়, তিনি তা থেকেও অনেক অনেক উর্ধ্বে।) 'দর্পণ' ও 'দর্শক' উভয়টিই মহান আল্লাহর সত্তার সাথে সম্বন্ধহীন। সুতরাং, এ বিষয়টি উত্তমরূপে উপলব্ধি করা উচিত যে, যা দৃষ্ট হচ্ছে তা তো উনার রহস্যের মগজ বা, সারবস্তু। আর, এ দর্শক আল্লাহর সিফাতের জগতে। যেহেতু তিনি (আল্লাহ্) নিজ কুদরতী সত্তার জগতে (عالم ذات), যেখানে মধ্যস্থতা, মাধ্যম ও উপকরণ জ্বলে ভস্মীভূত হয়ে যায়, সেখানে আল্লাহ্ তা'আলা ব্যতীত অন্য কোন সৃষ্টির নাম ও চিহ্নের অস্তিত্বও নেই। যেমন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন-

عَرَفْتُ رَبِّيْ بِرَبِّيْ ،

'আমি আমার রবকে উনার সত্তার মাধ্যমে চিনেছি।'

অর্থাৎ, উনার জ্যোতি লাভে সম্মানিত হয়েছি। মূলতঃ প্রকৃত মানুষই ঐ পবিত্র নূর লাভের মাধ্যমে মর্যাদাবান হয়। হাদীসে কুদসীতে রয়েছে,

الْإِنْسَانُ سِرِّيْ وَأَنَا سِرُّهُ ،

'মানবজাতি আমার গুপ্তরহস্য এবং আমি তাদের গুপ্তভেদ।'

নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী-

أَنَا مِنَ اللّٰهِ وَالْمُؤْمِنُوْنَ مِنِّيْ ،

'আমি আল্লাহ্ থেকে আর, মুমিনগণ আমার থেকে।'

যেমন, হাদীসে কুদসীতে রয়েছে-

خَلَقْتُ مُحَمَّدًا مِّنْ نُوْرِ وَجْهِيْ ،

'আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমার (কুদরতী) মুখমণ্ডলের বরকতময় নূর থেকে সৃষ্টি করেছি।'

এখানে মুখমণ্ডল মানে আল্লাহ্ তা'আলার মহান সত্তা। যিনি রাহমানুর রাহীমের মহান গুণে গুণান্বিত। যেন সর্বক্ষমতার অধিকারী রব উনাকে আপন যাতী নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন। আপন 'রহমত'-এর গুণ দান করেছেন এবং 'রাহমাতুল্লীল আলামীন' অভিধায় ভূষিত ও বিশেষিত করেছেন। হাদীসে কুদসীতে মহান রবের বাণী-

إِنَّ رَحْمَتِيْ سَبَقَتْ عَلي غَضَبِيْ ،

'নিশ্চয়ই আমার অনুগ্রহ আমার ক্রোধের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছে।'

[কুশায়রীঃ তাফসীর-ই কুশায়রী, ১/১০; হক্কী তাফসীর-ই হক্কী, ৭/১৫৮; বোখারীঃ আস্ সহীহ, ২২/৪৩২; তাবরিযীঃ মিশকাত باب صفة النا واهلها, ইবনে মাযাহ্ঃ আস্ সুনান, ১/২২১]

আর, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র নূরের মহত্ত্ব বর্ণনা করে এরশাদ করেছেন-

وَمَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ اِلَّا رَحۡمَۃً لِّلۡعٰلَمِیۡنَ

'আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।'
[সূরা আম্বিয়া, ২১/১০৭]

আরো এরশাদ করেছেন-

قَدۡ جَآءَکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ نُوۡرٌ وَّکِتٰبٌ مُّبِیۡنٌ ۙ

'নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে।'

[সূরা মায়েদা, ৫/১৫]

এখানে 'নূর' মানে হুযুর পাকের পবিত্র সত্তা আর, 'স্পষ্ট কিতাব' মানে কুরআন মাজীদ। হাদীসে কুদসীতে রয়েছে-

'হে হাবীব!(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি এ বিশ্বজগত সৃষ্টি করতাম না।'

- সির্‌রুল আসরার, পৃষ্ঠা ৬০-৬৫।

লেখকঃ বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।

অনুবাদকঃ মুহাম্মদ আবদুল মজিদ।

প্রকাশনীঃ সন্‌জরী পাবলিকেশন।

"হে পাঠক ও শ্রোতা! তুমি একথা উত্তমরূপে উপলব্ধি করো। আর, আল্লাহ্‌ তা'আলা তোমাকে ঐসব কিছুর সামর্থ্য দান করুন, যা তিনি পছন্দ করেন এবং যা দ্বারা উনার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।

জগত সৃষ্টির পটভূমিঃ
সর্বপ্রথম আল্লাহ্‌ তা'আলা উনার প্রিয় হাবীব নবী কারীম মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বীয় সৌন্দর্যের জ্যোতি থেকে সৃষ্টি করেছেন। যেমনিভাবে, হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্‌ তা'আলা বলেনঃ

'আমি সর্বপ্রথম আমার সত্তার নূর দ্বারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামের রূহ্‌ মুবারাক সৃজন করেছি।' যেমন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, 'সর্বপ্রথম আল্লাহ্‌ তা'আলা আমার রূহ বা, আত্মাকে সৃষ্টি করেছেন। সর্বাগ্রে আল্লাহ্‌ তা'আলা আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। সবকিছুর পূর্বে আল্লাহ্‌ তা'আলা কলম সৃষ্টি করেছেন। সর্বপ্রথম আল্লাহ্‌ তা'আলা আকল সৃষ্টি করেছেন। আর, এসবগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য হল হাকীকতে মুহাম্মাদী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম।'
[নিশাপুরীঃ তাফসীর-ই নিশাপুরী, ৫/১৪২]

নূরঃ
অগণিত গুণাবলীর আধার হুযুর নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্তাকে 'নূর' নামে এ জন্য আখ্যায়িত করা হয়েছে যে, তিনি আল্লাহর মহিমার অন্ধকার থেকে পূত-পবিত্র।
যেমন, আল্লাহ্‌ তা'আলা বলেন,

"নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব আবির্ভূত হয়েছে।”
[সূরা মায়িদা, আয়াত ১৫]

[এখানে, 'নূর' দ্বারা হুযুর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র সত্তা ও 'কিতাব' দ্বারা কুরআন মজীদ উদ্দেশ্য। -অনুবাদক।]

আকলঃ
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকতময় সত্তাকে 'আকল' (জ্ঞান) দ্বারা ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্য হলো, যে, উনাকে সকল বিষয়ের সন্তুষ্টিগত জ্ঞান দান করা হয়েছে।

কলমঃ
আর, 'কলম' দ্বারা এজন্য নামকরণ করা হয়েছে, যে, কলম হচ্ছে জ্ঞান প্রসারের মাধ্যম। যেমনি লিপির জগতে এটা জ্ঞানের মূল মাধ্যম ও উপকরণ, তেমনি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র সৃষ্টির মূল, জগত সৃষ্টির সূচনা ও আসল। তাই, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,

"আমি আল্লাহ্‌ থেকে আর, সকল ঈমানদার আমার থেকে।"
[হক্কি, তাফসীর-ই হক্কি, ৩/২১৭; সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানাহ, ১/৫৫]

আল্লাহ্‌ তা'আলা মানবজাতির রূহ্‌গুলোকে আলমে-লাহুতে হুযুর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্তা থেকে সুন্দরতম গঠনে প্রকৃত আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। এটা ওই জগতের মানবজাতির ঘর। আর, ওটাই আসল জগত। যখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রূহ্‌ মোবারক সৃষ্টির পর চার হাজার বছর অতিবাহিত হলো, তখন আল্লাহ্‌ তা'আলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামের চক্ষু মোবারক (এর নূর) থেকে আরশ সৃষ্টি করলেন। আর, অবশিষ্ট জগতসমূহ আরশ থেকে সৃষ্টি করলেন। অতঃপর, সৃষ্ট রূহ্‌গুলোকে (দেহ ও কায়ায় পরিবর্তন করে) সর্বাধিক নিম্নস্তরে স্থানান্তরিত করে দেয়া হলো। যেমন, আল্লাহ্‌ তা'আলা এরশাদ করেন,

"অতঃপর, আমি তাকে নিম্ন থেকে নিম্নতর স্তরে প্রত্যাবর্তিত করেছি।"
[সূরা ত্বীন, ৯৫/৫]

অর্থাৎ, আলমে-লাহুত থেকে আলমে-জাবারুতে রেখেছেন। এরপর, আল্লাহ্‌ তা'আলা ঐ রূহ্‌গুলোকে দু'হেরমের মধ্যখানে জাবারুতের নূরের পোশাক পরিধান করিয়েছেন। আর, এটাই হচ্ছে রূহে-সুলতানী। অতঃপর, তাদেরকে ঐ পোশাকে আলমে মালাকুতে প্রেরণ করলেন এবং মালাকুতের নূরের পোশাক দ্বারা সুসজ্জ্বিত করলেন। এটাকে রূহে সুলতানী বলা হয়। অতঃপর, আলমে মুলকে (এ নশ্বর জগতে) প্রেরণ করে তাদেরকে নূরের আচ্ছাদন দান করলেন।
আর, এটা হল রূহে জিসমানী (কায়িক আত্মা)। অতঃপর, আলমে-মুলক থেকে দেহ ও কায়ার জগত সৃষ্টি করেছেন। যেমন, আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেন,

"আমি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, সেটার মধ্যেই তোমাদেরকে নিয়ে যাব এবং পুনরায় সেটা থেকে তোমাদেরকে বের করবো।"
[সূরা ত্বহা, ২০/৫৫]

অতঃপর, আল্লাহ্‌ তা'আলা রূহ্‌গুলোকে কায়ায় প্রবেশের নির্দেশ দিলেন। আর, সেগুলো নির্দেশ পেতেই কায়াসমূহে প্রবিষ্ট হয়ে গেল। যেমন, মহামহিম রবের বাণী,

"এবং আমি তাতে রুহ্‌ সঞ্চার করেছি।"
[সূরা সোয়াদ, ৩৮/৭২]

যখন আত্মা ও দেহের সম্বন্ধ সুদৃঢ় হলো, আত্মা ও দেহের মধ্যে প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠলো, তখন সেগুলো দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা ভুলে গেলো। আর অঙ্গীকার ছিলঃ

"আমি কি তোমাদের রব নই? সবাই সমস্বরে বলেছিল, হ্যাঁ, আপনিই আমাদের একমাত্র প্রতিপালক।"
[সূরা আরাফ, ৭/১৭২]

মানুষ যাতে প্রতিশ্রুতির কথা বিস্মৃত হয়ে আসল জগতে প্রত্যাবর্তন করতে না পারে, সেজন্য দয়াময় আল্লাহ্‌ আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করে অবিনশ্বর মূল ঠিকানার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। এরশাদ করলেনঃ

"আর, (হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি তাদেরকে আল্লাহ্‌ তা'আলার (সাথে প্রতিশ্রুতির) দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দিন।"
[সূরা ইবরাহীম, ১৪/৫]

অর্থাৎ, আল্লাহর সাথে মিলনের ঐসব দিন স্মরণ করিয়ে দিলেন, যেগুলো রূহসমূহ দর্শন করেছে। আর, সকল রাসূল ও নবীগণ (আলাইহিস সালাম) তাদেরকে ওই দিনসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ধরাধামে আগমন করেছেন। অতঃপর, পরজগতে পাড়ি জমান। কিন্তু, খুব অল্পসংখ্যক লোকই তাঁদের উপদেশের উপর আমল করেছে এবং তাতে আগ্রহী হয়েছে। (অধিকন্তু, যে সব লোক তাদের প্রতি নিবিষ্ট হলো) তাদের হৃদয় আসল জগতের প্রেমে উদ্দোলিত হলো এবং তারা সফলভাবে লক্ষ্যস্থলে উপনীত হয়ে গেল। এভাবে শেষ পর্যন্ত নবুয়তের এ মিশন মহান, নবুয়ত ও রিসালাতের ধারা সমাপ্তকারী, সঠিক পথনির্দেশক রাসূল মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করলো।"
[সির্‌রুল আসরার, পৃষ্ঠা ৪-৭]
- বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
অনুবাদকঃ মুহাম্মদ আবদুল মজিদ।
প্রকাশনীঃ সন্‌জরী পাবলিকেশন।

মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার, হাজ্জাজ ইবনু শাইর (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ..... আবদুল্লাহ্‌ ইবনু শাকীক (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আমি আবূ যার (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) কে বললাম, যদি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দেখা পেতাম, তবে অবশ্যই তাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতাম। আবূ যার (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) বললেন, কী জিজ্ঞেস করতে? তিনি বলেন, আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম যে, আপনি কি আপনার প্রতিপালককে দেখেছেন? আবূ যার (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) বললেন, এ কথা তো আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বলেছেন, আমি নূর দেখেছি। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৪১, ইসলামিক সেন্টারঃ ৩৫২।)
আবু যার (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি (মি’রাজের রাত্রে) আপনার প্রভুকে দেখেছেন? জবাবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তিনি তো এক বিরাট জ্যোতি বা, আলো; অতএব আমি তাকে কিভাবে দেখতে পারি? (মুসলিম)

"সমগ্র জগৎ একই সত্তা, যে ব্যক্তি উহাকে দুই দেখিতে পায়, সে ব্যক্তি টেরা চক্ষু বিশিষ্ট।"
- হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ জালালুদ্দীন রূমী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
[তায্‌কেরাতুল আওলিয়াঃ ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৫]
প্রিয় নাবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
"আমি আল্লাহ্‌ থেকে আর, মুমিনগণ আমার থেকে।"
- সিররুল আসরার। লেখকঃ বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। [পৃষ্ঠা ৫,৬৪]
"আল্লাহ্‌ আসমান ও যমীনের আলো।"
[সূরা নূর, আয়াত ৩৫]