মাইকেল মধুসুদন দত্তের সাথে আমার পরিচয় হয় স্কুলে, দুজন একই বেঞ্চে বসেছিলাম। দু'জন দুজনের দিকে তাকিয়ে অনেক ভেবেছিলাম, আমি সংকিত ছিলাম তাকে নিয়ে আর তিনি আমাকে।
স্কুল বইয়ের পাতা থেকে এভাবেই চেনা আমার এই মহাননায়ককে।
যতই তার কাজ আর তার প্রয়াস শুনেছি ততই মুগ্ধ হয়েছি।তার এমনই একটি কাজ হচ্ছে "অমিত্রাক্ষর ছন্দ", যে ছন্দে লেখা হয়েছে বাংলাভাষার প্রথম সার্থক মহাকাব্য।
যদিও এ ছন্দ বুঝতে তৎকালীন সময়ে অনেককেই মাথা ঘামাতে হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি অবশ্য পরবর্তীতে এই ছন্দে অনেক কবিতা লিখেছেন।
ছন্দটা খুব সোজা, পুরোপুরি অক্ষরবৃত্তের মত শুধু অন্ত্যমিলটা হবে না । আর পর্ব বিচারে বিন্যাস আসবে (৮+৬) মোট ১৪ অক্ষর। এভাবেই এই ছন্দের চরন এগিয়ে যায় যতক্ষন পর্যন্ত ভাবের প্রবাহমানতা থাকে। সাধারন অবস্থায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ এই (৮+৬)১৪ তেই হয়ে থাকে, তবে এর ব্যতিক্রমও বাংলাভাষায় লক্ষণীয়।
প্রথমবারের মত অমিত্রাক্ষর লিখতে গিয়ে চরম পরিমানে হিমসিম খেতে হয়েছে। কবিতাটার নাম "অমিত্রাক্ষর সে গাঁয়ে (http://www.bangla-kobita.com/786/poem20140503125832/)। খুব ভাল করে খেয়াল করলে দেখবেন কবিতাতে মাত্রা আছে ১৭, অমিত্রাক্ষরীয় ভাবের প্রবাহমানতাও আছে, কিন্তু পর্ব বিচারে কোনরকমের মিমাংসা নেই।
এরপর দীর্ঘদিন এছন্দের দিকে আর তাকানের মত সাহস পাইনি, হঠাৎ একদিন মনে হলো আমি না "বিষ পিঁপড়ে"। তাই আর না কামড়ে থাকতে পারলাম না। শুরু করে দিলাম কাব্যহত্যার মত করে "অমিত্রাক্ষর বধ" । ঠিক এভাবেই জন্ম নিলো "বাংলার....." সিরিজ। এ সিরিজে চিরাচরিত অমিত্রাক্ষর থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসার এক ব্যর্থ প্রয়াস চালানো হয়েছে মাত্র, কিন্তু অমিত্রাক্ষর কবিতা হবার সকল গুণ পাবেন এই "দ্বিস্তবক"এর দ্বারা গঠিত সিরিজ কবিতাতে, আশা করি। নিচে সেই "অমিত্রাক্ষর বধ"-এর কিছুটা আভাস তুলে ধরা হলোঃ
১.বাংলার পাঁচঃ
এই কবিতায় পর্ব বিচার (৫+৫), মাত্রা মোট ১০ অক্ষর করে, এবং স্তবকে চরন সংখ্যাও ৫ করে ।
২.বাংলার ছক্কাঃ
এই কবিতায় পর্ব বিচার (৬+৬), মাত্রা মোট ১২ অক্ষর করে, এবং স্তবকে চরন সংখ্যাও ৬ করে ।
৩.বাংলার দত্তঃ
এই কবিতায় পর্ব বিচার (৮+৬), মাত্রা মোট ১৪ অক্ষর করে, এবং প্রথম স্তবকে চরন সংখ্যা ৮ ও দ্বিতীয় স্তবকে ৬ করে।
সকল বিচারে মূলধারা অনুসারী এ কবিতাটিতে স্তবক সনেটের মত করে রাখা,তাই একটু আধটু সনেট মনে হতে পারে যদিও তা নয়।
৪.বাংলার সপ্তকঃ
এই কবিতায় পর্ব বিচার (৭+৭), মাত্রা মোট ১৪ অক্ষর করে, এবং স্তবকে চরন সংখ্যাও ৭ করে ।
৫.বাংলার অষ্টকঃ
এই কবিতায় পর্ব বিচার (৮+৮), মাত্রা মোট ১৬ অক্ষর করে, এবং স্তবকে চরন সংখ্যাও ৮ করে ।
৬.বাংলার নয়ঃ
এই কবিতায় পর্ব বিচার (৯+৯), মাত্রা মোট ১৮ অক্ষর করে, এবং স্তবকে চরন সংখ্যাও ৯ করে ।
৭.বাংলার সাগরঃ
এই কবিতায় পর্ব বিচার (৭+৭), মাত্রা মোট ১৪ অক্ষর করে, এবং স্তবকে চরন সংখ্যাও ৭ করে ।
অর্থাৎ, প্রতিটি কবিতাতেই একরকমের ভীমরতি আছে, যেখানে ৮+৬ = ১৪ হওয়ার কথা সেখানে অনেকাংশে ৭+৭=১৪।
আর বাকি গুলা তো আমার মতই হবে, স্বাভাবিক।
প্রতিটি কবিতার স্তবক দুটি করে এবং প্রায় প্রতিটি চরনেও পর্ব বিচার দুটি করে। আবার তাদের সংখ্যাতত্ত্ব খেয়াল করলে দেখা যাবে এক বিশেষ সমতা রক্ষা করা হয়েছে, যেমনঃ ৬,৭,৮,৯ প্রভৃতি বজায় রেখে। মানে কিছুটা বর্গাকৃতির ছাঁচে ঢালা হয়েছে মাত্র।
দুঃখের কথা হলেও সত্যি অমিত্রাক্ষর নিয়ে বাংলাভাষায় খুবই কম কাজ করা হয়েছে। তাই একটু একটু করে এই "বিষ পিঁপড়ে"-র আজ কামড়িয়ে দেখার বড় স্বাদ জাগে এই মধুময় বাংলায় আর কী কী আছে!!