অনুভূতি যখন তীব্র, প্রকাশ তখন দুর্বল, এই হলো আমার চরিত্র; তাতে আবার আমার আবেগ বেশী। এটা আমার কথা নয়, আমার আশপাশে যারা থাকে তাদের মূল্যায়ণ!! আমার বাবা আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সতর্ক করতেন এই বলে, আমার আবেগ বেশী আর আবেগীরা নাকি বোকা হয়, তাই বুঝেশুনে পা ফেলতে!!!
৭ই এপ্রিলের এপার বাঙলা ওপার বাঙলার প্রাণের মেলায় নিশ্চিতভাবেই আমি একা আবেগে ভাসি নি, প্রত্যেকেই ভেসেছে তা আলোচনার পাতা থেকেই বুঝতে পারছি। সেই আবেগের জোয়ারে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।
আলোচনার পাতায় সৌমেন বন্দোপাধ্যায়ের আলোচনায় ৭ই এপ্রিলের ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী কবি সম্মেলন সম্পর্কে জানতে পারি। যাওয়ার জন্য মনটা কেমন আকুলি বিকুলি করে উঠলো। মেয়েদের সাথে শেয়ার করলাম ইচ্ছেটা। মেয়েরাও সায় দিল। যোগাযোগ করলাম কবি অনিরুদ্ধ বুলবুলের সাথে, আমার ইচ্ছের কথা জানালাম। এবার যোগাযোগ করলাম কবি সোহাগ আহমেদের সাথে। তিনিও আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কিন্তু তার পাসপোর্টের মেয়াদ নাই। দ্রুত পাসপোর্ট ঠিক করে ভিসার জন্য আমি তাকে রীতিমতো তাড়া দিতে শুরু করলাম। অফিসে যেয়ে সাততাড়াতাড়ি জি/ও এবং ছুটির ব্যবস্থা করে ভিসা প্রক্রিয়ায় নেমে গেলাম। রীতিমতো যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় ভিসাসহ পাসপোর্ট হাতে নিয়েও হাফ ছাড়তে পারলাম না। কারণ তখনো সোহাগ আহমেদ (কবি চাঁছাছোলা) পাসপোর্টই হাতে পান নি। ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দেই আর তাঁকে তাগাদা দিতে থাকি দ্রুত পাসপোর্ট নিয়ে ভিসার জন্য জমা দেয়ার লক্ষ্যে। বেচারা আমার যন্ত্রণায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে প্রায় পাসপোর্ট যোগাড় করে ভিসার জন্য জমা দেন। কবি চাঁছাছোলার ভিসা প্রাপ্তির খবর পেয়ে স্বস্তি পেলাম। এবার উড়াল দেবার পালা। আমি রীতিমতো উত্তেজিত। অনেকবারই দেশের বাইরে গিয়েছি কিন্ত এবারের এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রে যাওয়ার (উল্লেখ্য এটাই আমার প্রথম কলকাতা ভ্রমণ) অনুভূতিটা একদম অন্য রকম।
নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু বিমান বন্দরে নেমেই ইমিগ্রেশনের মুখোমুখি। কেন এসেছেন কলকাতা? আমি উচ্ছসিত হয়ে জবাব দেই একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। কীসের অনুষ্ঠান? এবার আমার ভাবটা যেন আরো বেড়ে যায়। সমঝদারের মতো বললাম, সাহিত্য সম্মেলন। এরপরের প্রশ্ন কোথায় লিখেন, কী লিখেন, অনুষ্ঠান কোথায়? আমিও খুব আনন্দচিত্তে তার জবাব দেই। আমার সাথে থাকা আমার ছোট মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে, সেও লিখে কিনা।
ইমিগ্রেশন পার হয়ে যোগাযোগের একটা হ্যাপা শেষ করে বেরিয়ে দেখা পাই প্রবীর দে দাদার। জীবনে এই প্রথম কলকাতায় পা দিলাম, তাও আবার কবি পরিচয়ে! আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন আরেকজন কবি। প্রবীর দে তার লেখা একটি কাব্যগ্রন্থ দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। এই জীবনে কোনদিন এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এমন ভালবাসা সম্মান আর আনন্দ আমার হয় নি। জীবনে প্রথম দেখছি মানুষটিকে অথচ মনে হচ্ছে কত জন্ম জন্মান্তরের চেনা। একেই বুঝি বলে আত্মার যোগাযোগ। এ জন্যই কী আমরা কবি!
প্রবীর দাদা ট্যাক্সি ঠিক করে খুব যত্ন করে মুকুন্দপুর যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। গেস্ট হাউজে পৌঁছেই পেয়ে গেলাম আমাদের অভিভাবকতুল্য কবি অনিরুদ্ধ বুলবুলকে। আসরের শুরু থেকেই তিনি অভিভাকের মতোই বিভিন্ন সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। একে একে দেখা হলো কবি অনন্ত গোস্বামী, বিভূতি দাসের সাথে।
বিভূতি দাস হয়ে গেলেন আমার বিভূতি দাদা। দাদার সাথে যাদবপুর চৈত্রের সেল দেয়া বাজারে ঘোরা, ঝুম বৃষ্টির মধ্যে স্টেশনে বসে মাটির ভাড়ে চা খাওয়া, মাটির ভাড় কিনে দেয়া এবং সবশেষে কালবৈশাখীর ঝড় বাতাসের মধ্যে ট্যাক্সির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার সময়টুকুতে বিভূতি দার আমাদের জন্য অবর্ণনীয় কষ্ট হাসিমুখে সয়ে যাওয়া স্মৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
৭ই এপ্রিল সকাল দশটায় কবি পলক রহমান, অনিরুদ্ধ বুলবুল, সোহাগ আহমেদ (চাঁছাছোলা) এবং ফরিদ আহমেদসহ আমি পৌঁছে যাই যাদবপুরের "শহীদ সূর্য সেন" ভবনে। চমৎকার গোছানো আর পরিপাটি আয়োজন। প্রবেশমুখেই ব্যাজ পরিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ওপার বাংলার কবি রিনা বিশ্বাস (হাসি) দিদি। উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন কবি মল্লিকা দিদি, জয়শ্রী কর, জয়শ্রী রায় মৈত্র, পারমিতা ব্যানার্জীসহ অনেকেই। এরপর ফুলেল শুভেচ্ছার মধ্য দিয়ে পরিচিত হলাম কবি যাদব চৌধুরী, স্বপন বিশ্বাস, সোমদেব চ্যাটার্জীসহ সব আলোকিত মানুষগুলোর সাথে। সব কিছু স্বপ্নের মতো লাগছিল। আন্তরিকতার উষ্ণতায় কাঁটাতারের বেড়া নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নিমিষেই।
শ্রদ্ধেয় কবি তমাল ব্যানার্জী ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছুটে এসেছেন আমাদের দেখবেন বলে। এর চেয়ে বড় পাওয়া এই জীবনে আর কী আছে?
মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন আর শাঁখ বাজিয়ে শুরু হয় প্রাণের মেলা। ধনধান্যে পুষ্প ভরা সমবেত সংগীতের মূর্ছনায় পুরো হলে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া আমাদের পাঁচ জনাকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে উত্তরীয় পরিয়ে মোমেন্টো দেয়ার পরে রিনা দিদির হাতে বানানো ফুলের সাজি উপহার ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কবি পলক রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাঙলা পরিবেশনের পরিকল্পনা ছিল সত্যিই অতুলনীয়।
আসরের আরেক কবি মৌটুসী মিত্র গুহ (কেতকী) যাকে আমি মিষ্টি দিদি বলে ডাকি চোখ তাঁকে খুঁজে ফিরছিল। হঠাৎ দেখি সে তার মিষ্টি দুটো মেয়ে নিয়ে আমার সামনে। বুকে জড়িয়ে ধরতেই সে টুপ করে প্রণাম করে বসে। প্রতিটি মুহুর্ত মনে করিয়ে দেয় এপার ওপার বলে কিছু নেই, যা আছে তা হলো এক প্রাণ এক সুর।
শ্রুতি নাটকে বিভূতি দাস আর পূর্ণপ্রভা ঘোষ এর পারফরম্যান্স ছিল অনবদ্য। চমৎকার সব কবিতা আবৃত্তির ছন্দে ছন্দায়িত হচ্ছিল সবাই। কবি শাসমলের কবিতার শেষ লাইনে "পাগল আমি"তে হাসির রোল পড়ে যায় সবার মাঝে।
দুপুরের খাবারের মেন্যুতেও ছিল চমক। খাবার গ্রহণের সময় জয়শ্রী করের ব্যতিব্যস্ত আন্তরিকতা, আহা কত যুগের আপন হলে এমন হতে পারে! ঘোরের মধ্য দিয়ে কেটে যায় সময়। কখন যে বিকেল ৫টা বেজে যায় বুঝতেই পারি নি। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ায় হল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়। প্রাণের কথা তবু ফুরোতে আর চায় না। আবার জড়িয়ে ধরি কবি পারমিতা ব্যানার্জী দিদিকে। কথা হয় বিভূতি দাদার সাথে। অনন্ত গোস্বামীর চমৎকার সঞ্চালনার কথা বলতেই তার সে কী বিনয়! কবি সৌমেন বন্দোপাধ্যায়ের আবৃত্তি এখনো কানে বাজে। সরবাণী চ্যাটার্জীর দৃপ্ত কণ্ঠের আবৃত্তি সে কী ভোলার!
লেখনী দিয়ে পুরো অনুষ্ঠানের চিত্র আর তার অনুভূতি প্রকাশ রীতিমতো দুঃসাধ্যের বিষয়। এ কেবল অনুভবের। কৃতজ্ঞ বাঙলা কবিতার আসরের প্রতি, কৃতজ্ঞ কবি অনিরুদ্ধ বুলবুলের প্রতি, কৃতজ্ঞ পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজনে থাকা টীমের প্রতি।
কবিতার দুটি লাইন দিয়ে শেষ করি শেষ হইয়াও হইলো না শেষের এই লেখাটি-
প্রাণে প্রাণে বাজে মধুর এক সুর
এপার ওপারের বাঁধা জানি
একদিন চলে যাবে দূর বহু দূর।