"ফারহাত আহমেদ" আসরের এক নিভৃতচারী কবি। সবার অগোচরে আসরে আসেন, কবিতা পোস্ট দেন, সন্তর্পণে এর ওর পাতায় ঘোরেন, দ্যাখেন আবার সন্তর্পণেই ফিরে যান। সাথে অবশ্যই কিছু নিয়ে ফেরেন, কি নিয়ে ফেরেন তা জানার সৌভাগ্য আমার হয় নি। তবে তিনি যে অনেকের পাতাতেই চোখ রাখেন এটা আমি বিশ্বস্ত সূত্রেই জানতে পেরেছি।
সেই বিশ্বস্ত সূত্রেই জানতে পারি এবার ২১শে বইমেলায় কবির "ক্যানভাস" নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আসরের আলোচনা বিভাগের অলিগলি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সত্যতাকে মেলাতে না পেরে কিছুটা হতাশ হই, কিন্তু বিশ্বাস হারাই না কারণ আমার সূত্র মিথ্যা হতে পারে না; এতটুকু আস্থা সূত্রের উপর আমার আছে।
তারপরও হতাশ হয়েছি এই ভেবে এ কেমন নিভৃতচারী! তিনি কি চান না তাঁর এই কাব্যগ্রন্থের কথা আসরের সবাই জানুক? তবে কি আসর নিয়ে কোন অভিমান কাজ করছে কবির মনের ভেতরে? যদি তাই হয় তবে তার উত্তর একমাত্র কবিই দিতে পারবেন।
বইমেলায় যেয়ে "এক রঙ্গা এক ঘুড়ি" প্রকাশনার ৬৫৪ নং স্টলে জানতে চাই কবি ফারহাত আহমেদের "ক্যানভাস" এর খবর। সেলস গার্ল স্মিত হেসে বের করে দেন নান্দনিক প্রচ্ছদ আঁকা "ক্যানভাস"। চোখ আটকে থাকা সুন্দর প্রচ্ছদের "ক্যানভাস" হাতে নিয়ে এ পিঠ ও পিঠ উল্টে-পাল্টে দেখি আর অজানা এক ভাললাগায় আপ্লূত হই।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি কবি "ফারহাত আহমেদ" আমার কবিতার গুরু, আমার শিক্ষক; আমি তাঁর ছাত্র। কবিতার স্লেটে চক ধরা থেকে শুরু করে পেন্সিল অধ্যায় পার হয়ে কলম হাতে তুলে কাব্যাঙ্গনে প্রবেশের প্রতিটি ধাপে তিনি ছিলেন এক আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকায়। শুধু ছিলেন বললে ভুল হবে এখনও তিনি প্রতিনিয়ত আমার অনুপ্রেরণার সহায়ক শক্তি হিসেবেই কাজ করছেন। সেই শিক্ষকের বই হাতে নিয়ে আমি যেন তাঁর আশীর্বাদের ছোঁয়াকেই অনুভব করছিলাম।
পাতা খুলে পড়তে শুরু করলাম "ক্যানভাস"। ভূমিকাতে তিনি লিখেছেন- "অক্ষর জুড়ে চেষ্টা করেছি দৃশ্য ধরতে, ধরে তা চোখের সামনে ভাসাতে"। তাঁর এই কথার প্রতিফলন দেখতে পাই প্রতিটা কবিতার লাইনে লাইনে, পরতে পরতে। "ক্যানভাস" এর অক্ষর জুড়ে ছবি আঁকার কাজ শুরু হয়েছে "টিকটিকি" দিয়ে আর শেষ হয়েছে "বিশ্বাস" দিয়ে।
তাল, ছন্দ, শব্দ চয়ন, বিন্যাস আর বিষয় নির্ধারণে তিনি রেখেছেন তাঁর নিজস্ব "বিশেষ বৈশিষ্ট্যের" ছাপ, যা যে কাউকে বুঝিয়ে দেবে এটা "ফারহাত আহমেদ" এর রচনা। এক কথায় এটাকে প্রকাশ করতে হলে বলতেই হবে তিনি কবিতায় একটা "ব্র্যান্ড" তৈরী করেছেন।
"ক্যানভাস" এর একটা কবিতা "চাওয়া" বারবার পড়ি, কখনো মনে হয় কবি তাঁর সাধারণ কোন প্রেমের গল্পের ছবি এঁকেছেন, কখনো মনে হচ্ছে এখানে যেন জীবনের কোন নিগূঢ় অর্থ প্রকাশের প্রয়াস নিয়েছেন। "এলিমেন্টারী"তে নিত্য দেখা আমাদের ঘরের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার নিখুঁত ছবি আঁকতে আঁকতে শেষে যেন কিসের একটা খোঁচা দিয়ে পাঠককে ভাবতে বলে বিদায় নিলেন।
আবার "বেলা দশটা" পড়তে যেয়ে মনে হলো এ যেন কোন কবিতা নয়, কোন একটা সাদাকালো ছবি আমার চোখের সামনে। এমন সাদামাটা বিষয়ও যে কবিতার উপজীব্য হতে পারে এত সুন্দরভাবে এ বোধ করি "ফারহাত আহমেদ" এর পক্ষেই সম্ভব।
"অসভ্যতার বর্ণমালা" আর "জয় বাংলা" পড়তে যেয়ে থমকে দাঁড়াই, কবির সাথে আমিও জাতিগতভাবেই লজ্জায় মিইয়ে যাই আবার ক্ষোভের আগুন দানা বেঁধে ওঠে বুকের গহীনে। লজ্জা আর ক্ষোভের রেশ মিলতে না মিলতেই "পোড়ামুখী" নিয়ে যায় বাংলার শ্বাশ্বত প্রেমের ভুবনে। চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে পোড়ামুখীর মিষ্টি মুখের ছবি।
"ঈদ মোবারক" কবিতায় রাজনের সেই অসহায় মুখটাকে স্মরণে বাধ্য করেন কবি। কষ্ট যখন বুকের খাঁচায় বড় বেসাইজ লাগে, তখনই তিনি আশার বাণী শোনান-"কষ্টের ভিতে সুখের আশায় নতুন আবাস গড়বো, সবকিছু ভুলে আজকে সকালে ঈদের নামজ পড়বো"।
আসলে "ক্যানভাস" এর প্রতিটা কবিতা যেন এক একটা জীবন্ত ছবি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বইটি আমার যেমন ভাল লেগেছে অন্যদের কাছেও একইভাবে সমাদৃত হবে, আর তাই এ রকম একটা কাব্যগ্রন্থের রস আস্বাদন থেকে কোন কাব্যপ্রেমিকই যেন বঞ্চিত না হন সে কারণেই নিজস্ব তাগিদেই আমাদের প্রিয় এই আসরে "ক্যানভাস" এর আবরণটি খুলে দিলাম।
পরিশেষে শ্রদ্ধেয় কবি আমার কবিতার গুরু, আমার শিক্ষক "ফারহাত আহমেদ"এর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। তিনি যেন তাঁর এই কাব্যের ধারা অব্যাহত রাখেন, বাঙলা কবিতায় নতুন ধারার সূচনার মধ্য দিয়ে বাঙলা কবিতাকে সম্মৃদ্ধ করেন এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।