অত্যন্ত প্রচলিত একটা কথা "অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর"; আমার অবস্থা এই কথাটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও বিষয়টি শোকের নয়, বিস্ময়ের আর ভাল লাগার। ভাল লাগার মাত্রা এত বেশী যে সেটি বিস্ময়ে রূপ নেয় আর তা প্রকাশে তাই ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সবার উচ্ছাসভরা লেখা দেখে মনে হলো দেখি না চেষ্টা করে!
আলোচনা বিভাগে ঈদ পুনর্মিলনীর ঘোষণা দেখেই ভাল লেগেছিল। নিজে লেখক বা কবি হিসেবে নয় অন্যান্য অনেক সম্মৃদ্ধ কবির সান্নিধ্য আর একটা ঈদের আমেজ ভরা অনুষ্ঠানের লোভটাই ছিল মূখ্য। আমার আবার অনুষ্ঠান পার্বন বেশ ভাল লাগে।
কবিতার সুবাদে পাওয়া আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন আর প্রিয় দাদাভাই কবীর হূমায়ূনের গৃহবন্ধুর সঙ্গা বুঝতে না পেরে উচ্ছাসের সাথে ঘোষণা দেই দুই কন্যাসহ হাজির হওয়ার। এরপর দাদাভাইয়ের পাল্টা উত্তরে উচ্ছাসের বেলুন মুহুর্তে হাওয়া বেরিয়ে চুপসে গেল। আমি আসলে তখনো এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাই বলে ফেললাম টোকেন এর মাধ্যমে হলেও কন্যাসহ হাজির হওয়ার অনুমতি দেয়া হোক। কারণ আমি দাদাভাই, শ্রদ্ধেয় কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল, মিষ্টি আর মেধাবী কবি রুনা লায়লা, মনিরুজ্জামান ভাই সহ চাঁছাছোলা আর ডালপালা ভরা সব মেধাবী কবিদের জমজমাট আসরকে মিস করতে চাচ্ছিলাম না।
পরবর্তীতে দাদাভাইয়ের আশ্বস্তের ভিত্তিতে দুই কন্যাসহ হাজির হওয়ার ঘোষণা দিলাম। এরপর কবি অনিরুদ্ধ বুলবুলের কাছে জানলাম শ্রদ্ধেয় কবি খলিলুর রহমান এই অনুষ্ঠানের নেপথ্য নায়ক। তখন তো আমার অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। ব্যক্তি উদ্যোগের অনুষ্ঠানে কিভাবে আমি কন্যাসহ হাজির হওয়ার জোর দাবী জানালাম! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম অনুষ্ঠানে যাবো না।
ফোনে মাঝে মাঝে শ্রদ্ধেয় কবি অনিরুদ্ধ বুলবুলের সাথে কথোপকথনের সূত্রে অনুষ্ঠানের টুকিটাকি অনেক কিছুই জেনে ফেললাম। অনুষ্ঠানের অল্প কিছুদিন বাকী। শ্রদ্ধেয় কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল ফোনে আমার দুই মেয়েসহ হাজির থাকার জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানালেন। তার আন্তরিকতার কাছে আমার মনের সিদ্ধান্ত হার মানলো।
কবিতার আসরের বাইরে আমার আরেকটি জগত আছে আর সেটা হলো কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। এই জগতের সদস্যদের সাথে ১৮ তারিখ রাতে রাজশাহী ভ্রমণে বের হই, এটা আমাদের একটা রুটিন ভ্রমণ। আমি তাদের জানালাম আমাকে ২২ তারিখে ঢাকায় থাকতেই হবে। সে অনুযায়ী ২১ তারিখ রাত ৯টা নাগাদ ঢাকা পৌছে যাই।
২২ তারিখ দুপুর ১২ টার দিকে দাদাভাইয়ের ফোন; ধরতেই তিনি জানালেন আমি যেন মেয়েদের নিয়ে যথাসময়ে পৌছে যাই, অতিথিকে ফুলের শুভেচ্ছা জানানোর দায়িত্ব আমার। আমি সম্মতি জানালাম।
পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে কিছুটা বিলম্বে হোটেলে গ্র্যান্ড প্রিন্স এ উপস্থিত হই। তখন দাদাভাই মাইক্রোফোন হাতে সঞ্চালনায় ব্যস্ত, আসর কবি আর আসরের সভাপতি উপবিষ্ট।
কবি খলিলুর রহমানের লেখা আসরে পড়েছি বহুবার, সুন্দর লিখেন তিনি। তার প্রোফাইল দেখে আমি তাকে স্যার সম্বোধন করি আমার কোন একটি কবিতার মন্তব্যের প্রতিউত্তরে। পাল্টা জবাবে তিনি লিখেছিলেন, তিনি এ আসরে স্যার হতে চান না। কারণ দেশে থাকতে সবাই তাকে স্যার বলতো। ব্যস এখানেই শেষ।
অনুষ্ঠান চলছে, আসর কবির কবিতা আবৃত্তির পালা। তিনি তার আত্মপরিচয় নামক কবিতা দিয়ে শুরু করলেন, তার আগে সামান্য ভূমিকা বক্তব্য দিলেন যার মধ্য দিয়ে একজন প্রশান্ত মানুষের পরিচয় যেন উঁকি দিয়ে গেল। "আত্মপরিচয়" আবৃত্তি করছেন কবি। তার শৈশব থেকে শুরু করে একের পর এক অধ্যায় পার করছেন। আমি অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছি এত উচ্চ ডিগ্রীধারী সূদূর অস্ট্রেলিয়ার আলো ঝলমলে এক নগরীতে বাস করা মানুষের পুরো অস্তিত্বে এ দেশের মা মাটির গন্ধ। মানুষ কত অবলীলায় নিজেকে মেলে ধরতে পারে যেখানে নেই কোন অহমিকা, নেই কোন বাহুল্যতা!
কবি খলিলুর রহমানের বাইরে এক আলোকিত মানুষ আমার সামনে উপবিষ্ট। আমার ভেতর আন্দোলিত হচ্ছে কবি খলিলুর রহমানের ভেতরের আলোকিত মানুষটাকে দেখে। আমার শুধু মনে হচ্ছিল শুধু এই আসরের নয়, আরো অনেক অনেক মানুষের উচিত তার সান্নিধ্যে আসা, তার এই আলোয় আলোকিত হওয়া। এই মানুষকে স্যার ছাড়া কি সম্বোধন করা মানায়?
তার আবৃত্তির মধ্য দিয়ে আমি তার পুরো গ্রামটা দেখতে পাচ্ছি, তার শৈশব কৈশোরের প্রত্যেকটা ঘটনা যেন আমার চোখের সামনে! এতটাই আন্তরিক আর সাবলীল উপস্থাপনা ছিল তার।
"আত্মপরিচয়" শেষে তিনি তার মাকে নিয়ে একটি কবিতার শেষ কিছু অংশ আবৃত্তি শুরু করলেন। ঢেকিতে পা রেখে তিনি পরীক্ষার ফি নিয়ে যখন চিন্তিত তখন আমার দু চোখ ভরা জল উপচে পড়তে চাইছে। মনে হলো কবি আর তার মায়ের পা ছুঁয়ে আমার অন্তরের অভিব্যক্তিটুকু প্রকাশ করি। মা যে সন্তানের মনের কত কাছে থাকে! কবির জীবনের নির্মম সত্যের সরল স্বীকারোক্তি কবির অবস্থানকে আমার কাছে অন্য এক উচ্চ স্তরে নিয়ে গেল। গোপনে চোখের জল বর্ডার লাইনেই আটকে রাখলাম।
এক এক করে কবির বন্ধুরা আসছেন, তারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন, কবির সম্পর্কে বলছেন আর কবি প্রশান্ত চিত্তে তার আসনে উপবিষ্ট। এত এত আলোচনা তার ভেতরে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তার মুখের কোণে শিশুর সরল এক চিলতে হাসি ঝুলছে।
আসর চলাকালে উপস্থিত হলেন কবির আরেক বন্ধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব ড. সুলতান আহমেদ। ঘোষণা দেয়া হলো কবি না হয়েও তিনি কবিতা এবং সাহিত্যের উপর অগাধ জ্ঞান রাখেন। শুরু হলো তার বক্তব্য। আলোচনা শুনে বুঝলাম মানিকে মানিক চেনে, রতনে রতন! অত্যন্ত সরস আর শ্রুতিমধুর আলোচনায় পুরো আসরকে ধরে রাখলেন বেশ কিছু সময়। তার চখাচখীর গল্প দিয়ে আলোচনা শেষ করার মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন তিনি কতটা বোদ্ধা।
কবি খলিলুর রহমান স্যারকে আমার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু রাজশাহীর তীব্র গরমে আমার কণ্ঠস্বর প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছিল। তাই এমন বাজে কণ্ঠে কথা বলতে আর ইচ্ছে হলো না। আমার প্রিয় দাদাভাই আমার হয়ে আমার লেখা "ডুব সাঁতার" কবিতাটি আবৃত্তি করে দিলেন।
অতিথিদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর পর্বে আসর কবিকে ফুল দেয়ার জন্য ডাকা হলো আমাকে। পুরো আসরে কথা না বলার দুঃখ অনেকটাই দূর হয়ে গেল এ সুযোগটি পেয়ে। এমন একজন আলোকিত আর সুন্দর মনের মানুষের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিতে পেরে নিজেকে খুব সুখী সুখী লাগছিল।
কবি মনিরুজ্জামান ভাইয়ের কণ্ঠে স্বরচিত গীতিকবিতাটি আসরে কিছুটা সময় নিস্তব্ধতা নিয়ে আসে। আবার চাঁছাছোলা কবি সোহাগ আহমেদ এর "আমি নই কবি"র মধ্য দিয়ে তার বিদ্রোহ প্রকাশের সাথে জোর করতালি যেন একাত্মতা ঘোষণা করলো।
কবিবন্ধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব ড. সুলতান আহমেদ স্যারকে ক্রেস্ট প্রদানের পর কবির হাতে ক্রেস্ট তুলে দিলেন কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল। ক্লিক ক্লিক ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলছে আর মুর্হুমুর্হু করতালির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল কবিপত্নীর উদ্দেশ্যে একটি উপহার কবির হাতে তুলে দিলেন। কবির হাতে তুলে দেয়ার আগে প্যাকেট খুলে দেখানো হলো। কবির পুরো পরিবারের অসাধারণ ছবি সম্বলিত একটি মগ। এই না হলে কবি! কবি অনিরুদ্ধ বুলবুলের এই পরিকল্পনাটি সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।
এই রকম সুন্দর মুহুর্তের মধ্যেই আমার মনের কোণে কিছুটা আহাজারির অস্তিত্ব অনুভব করলাম যখন আসর সভাপতির আসনে বসা মিষ্টি আর মেধাবী কবি রুনা লায়লার হাতে তার ছবি সম্বলিত মগটি তুলে দিলেন কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল! জাতীয় যাদুঘরে অনুষ্ঠিত বাঙলা কবিতার আসরে আবৃত্তিরত কবি রুনার ছবিটা মগের গায়ে যেন অসাধারণ এক রুপ পেয়েছে।
মনের ভেতর গুড়গুড় করছিল, আহারে যদি বসতে পারতাম ঐ চেয়ারটায়! মগটা তাহলে আমার হতো! আবার নিজেকেই নিজে বোঝাই রুনা তার যোগ্যতায় ওখানে বসেছে।
প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘোষণার পরে গ্রুপ ফটোসেশন। এবার রাতের খাবারের পালা। কাচ্চি বিরিয়ানী, রোস্ট, টিকিয়া, বোরহানী আর ফিরনী দিয়ে হলো রাতের খাবার অর্থাৎ অনুষ্ঠানের শেষ অধ্যায়।
পুরো অনুষ্ঠানে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। ছিল না তেমন হৈ চৈ কিংবা এলোমেলো ভাব। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল আর সাজানো একটা সুন্দর অনুষ্ঠানের আমেজ নিয়ে বেরিয়ে এলাম রাত ৯টার দিকে।
একটা বিষয় একটু উল্লেখ না করলেই নয়, সেটি হলো অনুষ্ঠান চলাকালে দু একজনের নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের বিষয়। আমরা এখানে সবাই প্রাপ্ত বয়স্ক, শিক্ষিত এবং সৃজনশীলতায় বসবাসকারী মানুষ। একটা অনুষ্ঠানের আবৃত্তি কিংবা আলোচনার মাঝে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না বলেই প্রতীয়মান। এই বিষয়টির প্রতি আমরা সচেতন হলে অনুষ্ঠানের স্বার্থকতায় ষোলকলা পূর্ণ হয়। একটা অনুষ্ঠানকে স্বার্থক করার জন্য যারা নিঃস্বার্থভাবে নিরলস প্রচেষ্টা চালান তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা দেখানো হয়।