বাংলাঃ ১৩৪৮ সাল ২২ শ্রাবণ, ১৯৪১ সাল ৭ আগস্ট,বৃহস্পতিবার
বাঙালী তথা বিশ্বাসীর কাছে এক বিষাদঘন দিন। চলে যান চির বিদায় নিয়ে দিগন্তের সীমানা পেরিয়ে অজানা দেশে। রয়ে যান বিশ্বাসীর হৃদয়ের অন্তরে। গানে কবিতায়, ছন্দে সাহিত্যে ইতিহাসে, শ্রাবণের বাদলের ধারায়, বসন্তের সুমধুর গানে, শরতের কাশফুলের মাঝে। থাকবে চিরকাল গ্রীষ্মের কৃষ্ণ চুড়ায় সৌরভে।
চির শ্রদ্ধেয় কবিগুরুর জীবনের শেষ দিন গুলো কিভাবে কেটেছিল। সুচনার শুরু মোটামটি বলা যেতে পারে ১৯৪০ সালের আগষ্ট মাসের শেষের দিকের দিকে তিনি শান্তিনিকেতনে তাঁর সাধের তীর্থ স্থানে ছিলেন। বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের অধ্যক্ষ ও সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায় তথ্য থেকে জানা যায় --- "শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৪০সালের ১৯ শে সেপ্টেম্বর পূত্রবধূ প্রতিমা দেবীর কাছে গিয়েছিলেন দার্জিলিং পাহাড়ের কালিম্পং-এ। সেখানেই ২৬ শে সেপ্টেম্বর তারিখ রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। দার্জিলিংয়ের এক সিভিল সার্জন বলেছিলেন তখনই অপারেশন না করলে কবিকে বাঁচানো যাবে না। প্রতিমা দেবী এবং মৈত্রেয়ী দেবী তখনই অপারেশন না করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারন হিসাবে বলা তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি। কবি গুরু একটু সুস্থ হওয়ার পর উনাকে পাহাড় থেকে কলকাতায় আনা হয়। তারপরে তিনি ফিরে যান শান্তিনিকেতনে। সেই সময় কবির চিকিৎসা করেছিলেন কিংবদন্তী ডাক্তার নীলরতন সরকার।ডা. সরকার তখন স্ত্রী বিয়োগের পরে গিরিডিতে চলে গেছেন, সেই সময়ে আরেক বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায় শান্তিনিকেতনে গিয়ে চিকিৎসা করেন। তিনি নিজে অস্ত্রোপচারের পক্ষে ছিলেন না।
চলে যায় কাব্য চর্চা । কাব্য যে তাঁর ধ্যান জ্ঞান লিখে চলেন এর মাঝে অবনীন্দ্রনাথ বেশ কিছু গল্প লিখেছেন। পড়ে দারুণ আনন্দ পেলেন কবি। বললেন, আরও আরও লিখতে। অবন ঠাকুর রানী চন্দকে গল্প বলে যান, রানী চন্দ সে গল্প শুনে লিখে ফেলেন। দেওয়া হলো রবীন্দ্রনাথকে। তিনি পড়লেন, হাসলেন এবং কাঁদলেন। রানী চন্দ এই প্রথম এমন করে রবিঠাকুরের চোখ থেকে জল পড়তে দেখলেন। কারণ জানা ছিলনা। আজও অজানা। শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী ও চিত্রশিল্পী এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের স্ত্রীর নাম রানী চন্দ, ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ভাজন। চিকিৎসকের বারবার বলেন অস্ত্রোপচারের জন্য কিন্তু না। তিনি বললেন, ‘মানুষকে তো মরতেই হবে একদিন। একভাবে না একভাবে এই শরীরের শেষ হতে হবে তো, তা এমনি করেই হোক না শেষ। মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছেঁড়ি করার কি প্রয়োজন?’ তিনি বেদনায় কাতর।উপশমের জন্য দেহে অস্ত্রোপচার করতেই হবে—এই হলো চিকিৎসকদের মত। ফিরে আসতে হবে কলকাতায়।তাই তিনি ফিরে এলেন। বিদায় দিলেন শান্তিনিকেতনকে কিন্তু তিনি জানতেন কিনা জানি এটিই ছিল শেষ বিদায়। শান্তিনিকেতন ছাড়লেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ২৫ জুলাই বেলা তিনটা ১৫ মিনিটে রবীন্দ্রনাথ এলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। খবরটা গোপ্ন রাখা হয়েছিল কারণ যাতে ভিড় না জমে।পুরোনো বাড়ির দোতলায় ‘পাথরের ঘর’-এ তিনি উঠলেন। স্ট্রেচারে করে দোতলায় নিতে হলো তাঁকে। ২৬ জুলাই রবিঠাকুর ছিলেন প্রফুল্ল। ৮০ বছরের খুড়ো রবীন্দ্রনাথ আর ৭০ বছর বয়সী ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ অতীত দিনের নানা কথা স্মরণ করলেন। হাসলেন প্রাণখুলে। ২৭ জুলাই সকালে রবীন্দ্রনাথ মুখে মুখে বললেন একটি কবিতা,লিখে নিলেন রানী চন্দ। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তি হলো:
‘প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্ত্বার নতুন আবির্ভাবে, কে তুমি, মেলে নি উত্তর।’
৩০ জুলাই ঠিক হয়েছিল তাঁর দেহে অস্ত্রোপচার হবে। কিন্তু কবি গুরু সে কথা জানতে দেওয়া হয়নি। তিনি ছেলে রথীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেছিলেন কাল না হয় পরের দিন। আবার কি মনে হল তিনি ডাকলেন রানী চন্দ, কিছু লিখার জন্য বললেন তিনি লিখলেন-
‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি,
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।’
ডা. ললিত এলেন এবং অস্ত্রোপচারের কথা বলায় তিনি চমকে গিয়ে বললেন “আজই , ভালো এরকম হওয়ায় ভালো”।
বেলা ঠিক ১১টায় স্ট্রেচারে করে অপারেশন-টেবিলে আনা হলো কবিকে। লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অপারেশন করা হচ্ছে। ১১টা ২০ মিনিটের দিকে শেষ হলো অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচারের সময় শরীরে যথেষ্ট যন্ত্রণা হয়েছিল । কিন্তু তা বুঝতে দেননি কবি। আজ একটু ঘুমালেন। পরের দিন ৩০ শে খুব খুব জন্ত্রনা বেড়ে গেল। গায়ের তাপ বেড়ে চলতে থাকল। শরীর নিঃসাড় হয়ে আছে। কবি কোন কথা বললেন না ১ আগস্ট । অল্প পানি অল্প ফলের রস খাওয়ানো হচ্ছে। চিকিৎসকেরা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ২ আগস্ট কিছুই তিনি খেতে চাইলেন না,বারবার বলায় তিনি বললেন, ‘আহ! আমাকে জ্বালাসনে তোরা।’ পরের দিন ২ আগস্ট শরীরের কোন উন্নতি নেই। পরের দিন একটু কফি খেলেন। বাড়ছে শরীরের তাপমাত্রা শরীর ক্লান্ত। পরের দিন ৫ আগস্ট ডা. নীলরতন বাবু এলেন ডা.বিধান রায় মহাশয়কে নিয়ে । রাতে দেওয়া হল সেলাইন, অক্সিজেন ও রাখা হল। কবি অসুস্থ বাহিরে অসংখ্য মানুষের ভিড়- সেদিন ছিল ৬আগস্ট। মাঝে মাঝে কবির হিচকি(হিক্কা) হচ্ছিল। খুবই কাছেই ছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ।ডাকছিলেন, ‘বাবা মশায়! ‘বাবা মশায়!’ একটু সাড়া দিলেন কবি। শরীর আরও অবনতির দিকে। রাত্রি ১২ টার দিকে আরও অবনতি।
সকাল ৯ টার সময় অক্সিজেন দেওয়া হলো। নিঃশ্বাস বায়ু ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হতে লাগল। দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে তা একেবারে থেমে গেল। দিনটি ৭ আগস্ট ছিল ২২ শ্রাবণ।
এক মুহূর্তে জন সমুদ্রে পরিণত হল তখন ঠাকুরবাড়ি। কবিকে বেনারসি-জোড় পড়ানো হলো। কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, চাদর, কপালে চন্দন, গলায় মালা দিয়ে সাজানো হলো। রানী চন্দ কবির বুকের ওপরে রাখা হাতে ধরিয়ে দিলেন পদ্মকোরক। কবি চললেন চিরবিদায়ের পথে। অনন্তকাল ধরে রয়ে গেলেন প্রতিটি হৃদয়ে।
কবিগুরু স্মরণ
- মহঃ সানারুল মোমিন
চেয়ে দেখো ঐ আকাশ পানে,
আছে কেমন বিষাদ মনে।
জমেছে মেঘের উপর মেঘ,
ব্যকুল সুরে-ডাকছে দেখ ভেক।
কাঁদছে আকাশ,কাঁদছে বাতাস,
ঝরে দুঃখের বাদল ধারা।
ব্যথায় ব্যথায় আজও কাঁদে
আমার সবুজ ভুবন ধরা।
ঝরে গেছে আজ শ্রাবণ দিনে,
আমার প্রাণের সাধের রবি।
দুরে ঐ নদীর জলে, কেয়া ফুলে
আঁকে বিষাদ মনের ছবি।
তপ্ত খরার বৈশাখ শীতল হল
উজ্জ্বল রবির আগমনে।
২২ শে শ্রাবণ, বিষাদ করে মন।
চলে গেলেন আনমনে।
কাঁদে আজও আমার হৃদয়,
বিষাদ ২২ শে শ্রাবণ।
তুমি যে রত্ন, স্বর্ণ মানিক
বিশ্ব করে আজও স্মরণ।
--------------সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা । আজ এই পর্যন্ত। সকলে ভালো থাকুন- এই কামনা রইল।
[তথ্য সংগ্রহ--
রানী চন্দ রচিত গুরুদেব অবলম্বনে।]