রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হল বলতে তখন একটাই । মতিহারের মন্নুজান হল । বিশাল ৭/৮ তলা হল , চারটা ব্লক মুখোমুখী , সমচতুর্ভুজ । সাদা রঙ এর চওড়া বিল্ডিং । মাঝ খানটায় বিরাট একটা মাঠ । সবুজ ঘাসে ঢাকা । বড় বড় করিডোর , সুবিশাল ডাইনিং হল , মস্ত খোলা ছাদ ।
সারাদিন রাত হাজার খানেক মেয়ের আসা যাওয়া , হইচই আর পড়ালেখায় মত্ত থাকে মন্নুজান হল । সবাই যে এক রকম তাতো নয় । কেউ কেবলি পড়তে ভালবাসে । কেউ রাজনীতি আবার কেউ খেলাধুলা । নাচ গান কবিতা লেখা সবই চলে লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে ।
আড্ডাবাজ মেয়েদের কমতি নেই হলে । আড্ডা হলের প্রাণ । সারাদিন আড্ডার ফুসরত নেই বটে , তবে বন্দের দিনে তো আছেই ! তবে প্রতিদিন বিকে্ল হলেই আড্ডার প্রস্তুতি শুরু হতো । ছাদের রেলিং এর ধার ঘেঁষে বসে বসে আড্ডা । কিংবা হলের মাঠের ঘাসে বসে । রুমেও আড্ডা চলত । সেই সাথে তাস খেলা , ব্রে কিনবা ব্রীজ কিনবা বড় জোর পেসেন্স ! শাড়ী আর সাজ পোশাকের গপ্পো তো আছেই । তখন লেখাপড়ার কোন কথা নেই । লেখাপড়া বাদে হুসঘুস কথা , হাসাহাসি আর লাফালাফি ! চা আর মূড়ি চানাচুর দিয়ে মাখানো । লাড্ডু ।
আড্ডায় ক্লাসের ছেলেদের নিয়ে কথা হতো বেশ । তবে একই ক্লাসের ছেলেদের তেমন পাত্তা দিত না মেয়েরা । বোকাশোকা ছেলেদের সেই ক্ষাত বলার চল তখনও ছিল । তবে যেসব ছেলেরা খুব ব্রিলিয়ান্ট তাদের বেশ কদর ছিল !
কোন ডিপার্টমেন্ট এ কি কি নতুন ঘটনা ঘটছে , তা রিলে না করা পর্যন্ত কারো কোন শান্তি ছিল না । আর আড্ডায়ই সে সুযোগ ঘটতো । তাই এক সময় দেখা জেত , না দেখে না শুনেও এক ডিপার্টমেন্ট এর মেয়েরা অন্য ডিপার্টমেন্ট এর ছেলেমেয়েদের চিনছে , জানছে !
স্যার ম্যাডামদের খুব সমীহ করা হতো । কিন্ত তাদের নিয়ে জমে ওঠা মজার মজার ঘটনাগুলো কতবারই না পুঙ্খানুপুখভাবে আড্ডায় স্থান পেত ।
হলের বিশাল গেটের পাশে টিচার্স কোয়াটার সংলগ্ন রাস্তাটার নাম ছিল প্যারিস রোড । হলের ছেলেরাই এ নাম দিয়েছিল । দেয়ার কারণও ছিল । বিকেল হতে না হতেই রাশি রাশি ছেলেমেয়ের দল জোড়ায় জোড়ায় সে পথ দিয়ে ঘুড়ে বেড়াত । যে সব মেয়েরা প্রেম প্রীতির ধার ধারতো না , তাঁরা নিজেরা নিজেরাই দল বেঁধে রাস্তা ধরে হাঁটত । বিশাল লম্বা পথ । দুদিকে নানা গাছ পালার সারি । পথের শেষ একটা চিলতে নদীর বুক ছুঁয়ে রাশি রাশি ঘনসবুজ বৃক্ষরাজির মাঝে । ছাদের উঁচু সিমেন্টের রেলিং এর উপর বসে বসেও মেয়েরা গল্পো করতো নীচের পথের দকে চোখ রেখে । কেউ কেউ এসে আচমকা গুতা মেরে বলতো , কানা হয়ে যাবি রে , এত দেখিস না । তারপর মহা হাসির রোল পরে যেত ।
কোন কোন মেয়ে খুব সুন্দর গাইতে পারতো । আকাশবানীর আধুনিক গান আর রবি ঠাকুরের গান সবার প্রান ছিল যেন । এই যেমন , খোল খোল দ্বার রাখিওনা আর বাহিরে আমায় দাঁড়িয়ে । কিনবা , তুমি সন্ধ্যারও মেঘমালা , তুমি আমারও সাধেরও সাধনা , আমি আপন মনের মাধুরি মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা , তুমি আমারি , তুমি আমারি , তুমি আমারি । কিনবা , চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি । বা তোমার ওই রঙ ধনু রঙ শাড়ীর পাড়ে চোরকাটাতে বিঁধিয়ে দিলেম মন । ইত্যাদি , ইত্যাদি ।
একদিন শোনা গেল প্যারিস রোডের গেটটা যাবে চিরতরে বন্দ হয়ে । ঊল্টোদিকে নতুন গেট হবে । ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা দেখে নাকি টিচারদের ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । এই কষ্টের সংবাদ শুনে হলের মেয়েদের মন ব্যথায় কাতর হয়ে গেল । চলল এ নিয়ে দুঃখ গাথা রচনা । আলোচনা । সমালোচনা । আড্ডার বিরাট একটা বিষয় হলো বটে । হলের ভিপি জিএস কে মেয়েরা সম্মিলিত ভাবে তাদের মতামত জানলো । প্যারিস গেট বন্দ করা যাবে না । তবুও একদিন হুট কোরে সেই গেটটা বন্দ হয়ে গেল । বন্দ হল বিশাল ব্স্তিত পথ জুড়ে ছেলে মেয়েদের আনন্দ কোলাহল । অনেক অনেক দিন ধরে হলের মেয়েরা স্যার ম্যাদামদের মনে মনে এটা ওটা বললো । আড্ডায়ও সেসব বাদ পড়লো না । যেন মুখোমুখী দু পক্ষ । যুদ্ধ ।
কিন্তু তা ভেতরে ভেতরেই । টিচারদের সঙ্গে সামনা সামনি দেখা হলে মাথা একবুক নীচু করে বিনীত সালাম । কেননা আড্ডার মূলমন্ত্র হোল , নিজেরা নিজেরা অন্যের আলোচনা সমালোচনা কর , কিন্ত তা ভুলেও একতিল বাহিরে নয় । আর স্যার ম্যাদামদের হাতে তো ভাগ্যের খুঁটি । কোন নির্বোধ তাতে সাধ কোরে নাড়া দেয় ?