আমাদের ছেলেবেলায় স্কুল , কলেজ , অফিস আদালত রবিবারে বন্দ থাকতো । তাই রবিবার মানেই ভাইবোন মিলে চুটিয়ে আড্ডা দেয়ার দিন।
আড্ডা শুরু হতো সকালে নাস্তার টেবিল থেকেই । আড্ডা মানে ভাইবোনে হুটোপুটি , কথায় কথায় লুটোপুটি , ছুটোছুটি , রাগারাগি , কাঁদাকাদা ইত্যাদি ইত্যাদি !
নাস্তা খেতে খেতেই প্রথমে নাম দেয়া দেয়ি শুরু হতো । কে কতো বিদ্ঘুটে আর যথাযথভাবে একে অন্যের নাম দিতে পারে । এই যেমন যার নাক একটু বোঁচা , তার নাম দেয়া হলো বুচিঁ । যে বোনটা একটুতেই কাঁদে তাঁর নাম নেকি । যে ভাইটি খুব খাওয়া দাওয়া পছন্দ করে তার নাম খাদক এইসব আর কি । একজনের নামকরণে অন্যদের সম্মতি থাকতোই থাকতো , কিন্তু নিজের নামে নয় । দুর্বল আর ছোট ভাইবোনেরা সাধারনতঃ বড়দের কাছ থেকে নাম পেত । আর এই নাম পাওয়া নিয়েই চলতো কান্নাকাটি আর নালিশ । নালিশ যেত মায়ের কাছেই । মা ছদ্গ রাগে বড়দের বকাবকি করতেন । ব্যাস ওইটুকুই । তারপর তিনি তাঁর দৈনন্দিন কাজে মন দিতেন ।
রবিবারে মায়ের কাজের তাড়া একটু কমই থাকতো । তাড়া মানে টাইম মতো সকাল সকাল নাস্তা, ভা্ত , ভর্তা , ভাজি ইত্যাদি রেঁধে বেড়ে খাইয়ে দাইয়ে স্বামীকে অফিস পাঠানো , ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজে । তবে রবিবারে সপ্তাহের বাজার আসতো । মাছ , মাংস , তরিতরকারী , তেল আর মশলা এসবের ভাড়ে বাজারের ব্যাগগুলো যেত ভারী হয়ে । মাকে এগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে সাজিয়ে রাখতে হতো । তখন হয়তো হাতে গোনা দু একটা ঘরে ফ্রিজ ছিল । আমাদের ছিল না । তাই এতো মাছ মাংস জ্বাল টাল দেয়া নিয়ে মাকে খুব হিমশিম খেতে হতো ।
নাস্তার রুটি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রোল কোরে দুধ চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাওয়া হতো । এটা বাড়তি খাওয়া । খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে না দেখার ভান করে এর ওর গায়ে কিঞ্চিত চা ঢেলে দেয়ার রেওয়াজও ছিল । চা কাপড়ে পড়া মানেই সেখানে একটা স্থায়ী দাগ বসে যাওয়া । বিষয়টা মা কোনদিনই ভালভাবে নিতেন না । এ কারণে কানমলাও খেতে হতো সেই দোষী মানুষটিকে !
ভুল ভুল উচ্চারণ নিয়েও হাসাহাসি চলতো । বাংলা আর ইংরেজি দুটোই । পরীক্ষায় কোন বিষয়ে কে খারাপ করলো এসব নিয়ে দারুন খোটাখুটি চলতো । এরই মধ্যে সকালের খবরের কাগজ আসতো । কে আগে তা পড়বে , তাই নিয়ে চলতো টান পোড়ন । অবশ্য একটু পরেই দ্রুত হাত বদল হয়ে তা বাবার হাতে পৌছুঁতো । মারও খবরের কাগজ পড়ার দারুন ঝোঁক ছিল আর সেই সাথে সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা। মা স্থানীয় লাইব্রেরীর আজীবন মেম্বার ছিলেন। গল্পের বই পড়ার তাঁর খুব নেশা ছিল । আমরা ছোটরা কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে নভেল পড়ায় পটু ছিলাম । এখনকার মতো আগেকার ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় নিশ্চিন্ত মনে নাটক নভেল পড়তে পারতো না । নাইন টেনে উঠার পর এই বাঁধা অবশ্য কেটে যেত ।
মস্ত একটা সাদাটে ট্রানজিসটার অ্যান্ড মারফি রেডিও ছিল আমাদের । বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে তাতে রেডিও রেখে উচ্চ ভলিউম দিয়ে গান শুনা হতো রবিবারে । গানের সাথে সাথে মন নাচত , কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে শরীর দুলিয়ে নাচতোও ।
কবিতা আবৃত্তির আসর বসতো রবিবার দিন । বাবাই টিচার আবৃত্তির । রবীন্দ্রনাথ , নজরুল , জীবনানন্দ দাস প্রাধান্য পেত সব সময় । স্কুল কলেজের ফাংশনে আবৃত্তিতে নাম দেয়ার রেওয়াজ ছিল । পুরস্কারও পাওয়া হতো ।ডিবেটেও নাম দিতাম আমরা । কেবল মাত্র গান শেখাতেই বাবার কাপণ্য ছিল । তাই এখনও কেন গান গাইতে পারি না ভেবে আফসোস হয় । তবে গান শুনতে কোন মানা ছিল না ।
ভানুমতি নামে এক কম বয়সী আধ পাগল ভিখারিনী আসতো ভিক্ষা চাইতে রবিবারে । সে এমন সুন্দর আর করুন সুরে গান গাইতো যে , তা না শুনে কারও কোন উপায় ছিল না ।একের পর এক আমরা নানা গানের ফরমাস করতাম । আর সে বানিয়ে বানিয়ে সুরে সুরে ফরমাসি গান গাইত। আহা, সে কি সুন্দর তাঁর গলা আর কি সুন্দর ভঙ্গি । এসব দেখতে দেখতে আর শুনতে শুনতে রবিবারে দিনটা দারুন আনন্দময় হয়ে ঊঠতো ।
এভাবে ছোট্ট ছোট্ট আনন্দেই জমে উঠতো আমাদের রবিবারের আড্ডা আর চট কোরে কেটে যেত রবিবারের দিন । এই দিনটা ফিরে পেতে আবার অপেক্ষা কোরতে হতো ছয় ছয়টা দিন !