এই রাত ফুরিয়ে গেলে পর প্রভাতের মুখ
আমাদের আরেকটা দিনের মুখোমুখি হবার।
এখন ঢের মানব নিদ্রাকে ভালোবেসে
গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে কোথাও
অগণন চিন্তার বেসামাল জগৎ ছেড়ে—
মনে হয় ঘুমের চেয়ে পৃথিবীতে
জলের মতোন স্থবিরতা আর কিছু নেই।
অঘ্রাণের পাতা চুপেচুপে ঝরিতেছে
শিশিরের ছোঁয়ায় ভিজে উঠে নিদারুণ ভাবে!

সকালের ঘুম থেকে জেগে অনেকেরই
ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হয় কর্মস্থলে,
জীবনের ঢের হিসেব মিলাতে বাহিরের পৃথিবীকে
চক্ষে বুলিয়ে নিতে গিয়ে দেখিয়েছি
কোথাও হতাশা ক্লান্ত ছাড়া শান্তি নেই।
অথবা যা আমাদের জীবন দেই প্রতিনিয়ত
তবুও সংসারে খোরাক জোগাতে খাই হিমশিম!

পৃথিবীতে যুক্তি দিয়ে কথায় তৃণ ঝরে
তবুও সকলের জন্য নয় এইসব দার্শনিক যুক্তি।
কবি তার কবিতায় লিখে যায় অনন্ত বিরহ
কেউ কেউ পরে বাকি সব অগোচরে রয়ে যায়
অনির্বচনীয় মানুষের গভীর সমুদ্র থেকে।
মানুষের সভ্যতার মর্মে পরিবর্তন হয়
তবুও জটিল দাবি সব রেখে যায় নবাপ্রজন্মের কাছে
নিজেকে অন্ধকারে ডুবিয়ে পশ্চিমের আকাশে
হেমন্তের লাল সূর্যের মতন রক্তাক্ত আভা
থেকে যায় মাটির পৃথিবীতে কতকাল ধরে!

অনেক শতাব্দীর জঞ্জাল কাটিয়ে
এই পৃথিবীর কয়েকটা মুহূর্তকে রঙিন করার
তীব্র আকাঙ্খা পুনঃপ্রবাহের মতন জাগিয়ে তুলে।
জানি মৃতদের কোনো দাম নেই আজ
ধূলো ঘাস সংগ্রাম করে চলে অধিকার আদায়ে
আমাদের জীবন এইসব ধূলো ঘাসের ন্যায়।

তারপর পড়ে থাকে কোনো এক অবলা প্রেমিকের গল্প
যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিয়েছি,
তবুও তারে আমি ধরে রাখতে পারিনি।
কোনো এক অঘ্রাণের পথে ঝরে থাকা
হলুদ পাতার মতো একদিন হৃদয়কে ছুটি দিয়ে
মৃতদের মতো দেহ থেকে বেড়িয়ে গেলো
কোন দূর অসীম আকাশের পানে
যাকে পারে নাকো পৃথিবীর কেউ ছুঁতে।
আলোহীন নিস্তব্ধতায় আমার নরম হৃদয়ের নিস্তেল।

সব কিছুর উর্ধে এক মুহূর্তের কামনা তার
আমি জানি এইসব আলুলায়িত চিন্তার থেকে
আমাদের কোনো পরিত্রাণ নেই লক্ষ্য কোটি প্রাণের।
তুমি এই পথে আসো যাও তবুও হৃদয়ের গভীরে
তোমারে আমি কোনোদিন হাতরায়ে দেখিনি,
পায়ের ছাপে পটের ছবির মতোন ভেসে রও সহাস্য
আমাদের জীবন বারবার একই ভুলের কাছে
আজীবন ধরাশায়ী এক মানুষীর সমস্ত জুড়ে।
পৃথিবীতে তবু ভুলের মাশুল দিতে হয় চারাগুণে
এইসব ছায়াপথ সংঘের আসন্নবর্তী রৌদ্রে
আমি শুনিয়েছি জীবনের রুদ্ধশ্বাস কতোবার।
কবে নিঃশব্দে সেইসব কাকপক্ষী গেলো চলে
আর কোনোদিনও ফিরে নিকো একটুও টুঁ শব্দ নিয়ে,
সময়ের এই অন্তহীন জীবনে অনেক কিছুই
প্রকৃতির ঢের নিয়মের মতনই পরিবর্তন হয়।

হৃদয়ের লাশে ঢের ব্যথা মৃত্যু পুষে
বাহিরের পৃথিবীতে মনে হয় কোথাও কেউ নেই,
তবুও আজকের মন্বন্তর মুছে ফিরে চাই
সান্ত্বনার পানে যেখানে দু’দণ্ড স্থির থেকে
ভালোবেসে আমাদের ঘুমের জগতে আহা।
তুমি ফিরে এসো এইসব মূঢ়ক্লান্ত প্রাণের স্পন্দনে
সমুদ্রের নিকট ঘাসের শরীর ঘেঁষে বিস্তীর্ণ
সে এক মুহূর্তের সত্যকে আঁচ করে জেনেছি
পৃথিবীতে তুমি আমি ওরা সভ্যতার মর্মে
আমরা কেউই ভালো নেই অসুস্থ পরিবেশে।

বিকেলের আকাশে অস্পষ্ট মেঘের ভীড়
নগরীর পথে অনেক কিছু দেখা যায়—
ফুটপাতে ভিখারির থালা নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে আছে
যার হাত নেই, পা নেই শুধুই একখানা দেহ
পৃথিবীতে বুঝি এমনই লোকের দেখা মিলে।
সকলেই সামর্থ বুঝে এক দুই পয়সা করে যাচ্ছে দান
আবার কেউ কেউ আড়চোখে দেখে চলে যাচ্ছে,
আমার হৃদয় কেঁপে উঠে চোখের অসীমে
তবুও সে আমাদেরই একজন পৃথিবীতে আজ।

প্রকৃতির নিয়মে সবই চলিতেছে তারপর হৃদয়ে
জেগে উঠে আমি যদি আজ বিশিষ্টজন হতাম
অথবা বড়ো কোনো প্লেটো, সক্রেটিসদের মতোন
সমুজ্জ্বল পৃথিবী ভরে দার্শনিক হতাম।
পৃথিবীর ক্যান্সারে মানুষ মেরেছি আমি
কাউকে ভালোবেসে কাছে পেতে চেয়েছি
তবুও সব কিছু নিয়তির পানে আমাকে ধরাশায়ীতে
দিনমান ভাবিয়েছে রক্তাক্ত নদীর স্রোতে।

জীবনের মানে আমি জেনেছি অর্থের হিসাবে
যখন তারা আমাকে হেয় করে বিপরীতে মুখ ফিরিয়ে
হেঁটে গেছে চলে গেছে পাশ থেকে হায়—
পৃথিবীকে আমি দেখেছি গোলচক্রের মতোন
শূন্যতা, নিরাশা, হতাশায় জর্জরিত এ দেহ
আমি ফিরে চাই পুরনো অঙ্কের দরকষাকষি
আজও আমি সেই দরকষাকষি মিলাতে পারিনি!

অশ্বত্থের পাতা কেবলই শুয়ে আছে
মাটির উদ্বেলিত শরীরে নিবিড় বলে তাই
মৃত মুখ সব পায়ে পায়ে চলিয়াছে দিনে আঁধারে।
কোথাকার কে-বা জানে কুয়াশার বুকে
শিশিরে ভিজে জেগেছে ভোরের আলোয়ে,
সৃষ্টির অপরিক্লান্ত জীবন থেমেছে জোয়ারের ভেগে।
আমাদের হৃদয় যা চায় আমরা তাহা পাই নাকো
যখন তবুও পাই যৌবনের ভাঁটায় দেখা যায়
সবই বৃথা জগতের কাছে অনুর অনিমেষে।

যদিও অনেক খরস্রোতা পেড়িয়ে আজ আমরা
সহসা বিকেলের সূর্যে পশ্চিমের আকাশে
উপেক্ষিত জীবনগুলোকে এরকমই মনে হয়েছে,
তীব্র লাল দহন-এ ঝলসে গেছে সেই কবে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আজ তাই ভাবি অপলকে।
হাতে সিগারেট আগুনের ধোঁয়া মিলিয়ে যায়
বিকেলের এই শূন্য কার্তিকের সিদ্ধতায়,
দূরে কাছে মাঠে মাঠে অসংখ্য মানুষের ভীড়
সকলেই হয়তো বা সেই স্বপ্ন, কাজ, কথা অখণ্ড
সবিস্তর ভাবনায় মাতিয়েছে হো হো শব্দে,
অনন্তের অন্তরের থেকে যেন ঢের কথা বলে যাচ্ছে।
তারপর আসিবে সন্ধ্যা ধীরে ধীরে নেমে
পৃথিবীর থেকে সূর্যের ক্লান্ত মুখ ডুবে যাবে,
সবাই এঁকে এঁকে এই মাঠ ছেড়ে কখন
নিজ নিজ গন্তব্য খুঁজে অন্তর্হিত হয়ে যাবে।

সভ্যতার অসুস্থ সমাজ সংস্কৃতি দূর্গম ব্যধি থেকে
আজকের এ যুগে এসে পৌঁছেছি বহুদিন কার,
তবু পুরনো বীতকাম রয়ে গেছে প্রাণে।
পরিশুদ্ধ জীবনের জন্য চাই ঢের সঞ্চয়
মানুষের ভাষা অনুভূতিতে দিয়ে যায় আঘাত
এলেমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল।
এই শতকের বিজ্ঞান নিত্য নতুন আবিষ্কার নিয়ে
মানুষের কাছে দ্বারস্থ হচ্ছে প্রতিনিয়ত,
তবু সভ্যতার অসুস্থ থেকে আমরা পারিনি বেড়িয়ে আসতে।

কোথাও প্রাণ আছে কিন্তু প্রাণের সাড়াশব্দ নেই
সুখ আছে জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই,
চোখ থেকে আলো ধীরে ধীরে নীভে
সম্মুখে নেই যাত্রিকের আনন্দ উল্লাস,
প্রাণ যেই কথা কহে শুনেনি আজ কেউ
ঢের ক্রান্তিময় জীবন পারি দিয়ে আজকের
নবপ্রস্থানে আত্মাকে জাগিয়ে তুলে
নতুন করে বেঁচে থাকবার একান্তের অন্ধকারে।

অতীতের পুরনো ভুল শুধরে কেউ কেউ
ফিরে আসে শব্দহীন মৃত্যুহীন নিভৃত আড়ালে,
অনেকেরই তবু থেকে যেতে হয় অনন্ত আসীমে মুছে।
এ জীবন ধীরে ধীরে ধসে যায়—
চারিদিকে মৃত্যুকে পরখ করে নেয়
যেন দিক চিহ্নময় পাশে তার কেউ নেই,
দূরে কাছে কয়েকটি প্রিয়কন্ঠ ভেসে আসে
তারপর আস্তে আস্তে বুঝে আসে চক্ষু মরণ ঘুমে।

এখন এই রাত স্রোতের বেগে বাড়িতেছে
বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে নক্ষত্রের নাচানাচি অনবচ্ছিন্নভাবে,
ক্লান্ত চোখ পৃথিবীর নিঃশ্বাস থেকে গভীর ঘুমে
সমস্ত চিন্তাভাবনার কাজ ফেলে অন্ধকারে,
নির্জন রাত্রি তারকা আমাকে কি ভালোবাসে?
আমিও কি তারে ঢের গুণ ভালোবাসি?
প্রশ্নের গোলকধাঁধায় জেগে উঠে কতশত কথা।
হৃদয়ের প্রেমে মৃত্যু আসে চেতনার বলয়ে
জীবন থেকে যায় আলো অন্ধকারে হাজার বছর!