তুমি বলেছিলে—  
এই শহরের অন্ধকার গলি, চায়ের দোকান,  
আর নিঃসঙ্গতার ভেতরেও আলো থাকে,  
যেন মোমবাতির নরম শিখা।  
কিন্তু আলো নিভে যায়,  
যখন কেউ হঠাৎ ছুরি চালায় পিঠে,  
নিঃশব্দে।  

আমি ভেবেছিলাম—  
শব্দহীন এই আঘাতগুলো শুধুই বইয়ের পাতায় থাকে।  
তুমি বলেছিলে,  
বন্ধুরা কখনও শত্রু হয় না,  
প্রেমিকের হাতে ধরা গোলাপের কাঁটা  
কেবল ভুলে গিয়ে বিঁধে যায় আঙুলে।  

তবু কি ভুলে থাকা যায় সেই আঙুলের ক্ষত?  
তুমি চুপ করে গেলে,  
আর আমি দেখলাম তোমার চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক  
এই শহরে আর কেউ নেই।  

এ শহর জানে কীরকম ছুরি চলে—  
শব্দ ছাড়াই।  
বন্ধু কি প্রেমিকা? দুজনেই একসাথে,  
নীরবে চুরি করে বিশ্বাস।  

এখানে নদীও প্রতারণা করে,  
সে দুপাড়ে জল ঢেলে বলে— আমি তো বয়ে চলেছি,  
কিন্তু তুমি জানো, তার বুকেও পলি জমে।  

আজ যখন আকাশে বৃষ্টি নামছে,  
আমি তোমার মুখটা মনে পড়ে তাকিয়ে আছি  
শহরের ফাঁকা ফুটপাথে।  
এতটুকু জল জমেছে জুতোয়,  
এতটুকু কাদা,  
আর এতটুকু বিশ্বাসভঙ্গের দাগ—  
যা কেউই মুছতে পারবে না।

শহরের নীরবতায় কিছু প্রশ্ন জন্ম নেয়—  
তুমি কি সত্যিই ভুলেছিলে সেই শপথ,  
যা তুলসীতলায় সন্ধ্যায় আমরা কেটেছিলাম,  
যেখানে প্রেম ছিল পবিত্র,  
আর বিশ্বাস ছিল ধ্রুবতারা?  
নাকি তুমি শিখে গিয়েছিলে শহরের কৌশল—  
বিনিময়ে বিশ্বাস দিয়ে হিমশীতল এক মুদ্রার মত?  

সন্ধ্যার বাতাসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে  
যখন আমি হাত রাখি,  
তখনও তোমার ছোঁয়া টের পাই  
তবু সেই নরম আঙুলের ভিতর লুকিয়ে ছিল  
একটি বিষাক্ত ছুরি।  

আমি ভুলে যেতে চাই—  
এই শহর, এই গলি, তোমার মুখ,  
কিন্তু তুমি জানো, ভুলে যাওয়া  
শুধু বইয়ের কবিতায় সম্ভব।  
বাস্তবে, প্রতিটি বিশ্বাসঘাতকতা ফিরে আসে  
বৃষ্টির দিনে, চায়ের দোকানে, ফাঁকা রাস্তায়,  
আর হঠাৎ, এক নিঃশব্দ চিৎকারে।

তুমি কি জানো?  
আমাদের ছেঁড়া স্বপ্নগুলোও কাঁদে একা,  
যেখানে মোমবাতির শিখা আর জ্বলে না,  
শুধু অন্ধকারের হাসি শুনতে পাওয়া যায়।

তুমি চলে গিয়েছিলে, নিঃশব্দে—  
ফেরার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলে ঝরা পাতার মতো।  
সে প্রতিশ্রুতিগুলোও আজ ঘুরে বেড়ায়  
আমার খোলা জানালার পাশে।  
রাতের বৃষ্টি ভেজা বাতাসে আমি শুনি  
তোমার কণ্ঠস্বর, সেই পুরোনো কথাগুলো।  
কিন্তু তুমি তো জানো, বাতাস কখনও ফিরিয়ে আনে না  
হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসের চিঠিগুলো।

শহরের ট্র্যাফিক লাইটও আজ ভুলে যায় রঙ বদলাতে,  
এতটাই ক্লান্ত এই ইট-কাঠের নগরী।  
আমি হাঁটি, নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে—  
কোনটা ছায়া, আর কোনটা বিশ্বাসঘাতকতা,  
তা আর আলাদা করতে পারি না।

তুমি কি জানো, ছায়ারাও ভাঙে?  
আলো চলে গেলে, তারা নির্জীব হয়ে পড়ে।  
তুমি চলে যাওয়ার পর, আমারও ছায়া ভেঙেছে  
এ শহরের দেয়ালে দেয়ালে।

কখনও কখনও মনে হয়,  
বিশ্বাস ছিল একটুকরো কাঁচের মতো—  
যা তুমি ছুঁয়ে দেখেছিলে অবহেলায়।  
আর এখন সেই কাঁচের টুকরোয় আমি পা রেখে  
রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছি  
শহরের এক কোনায়।

তুমি কি সুখী?  
এই প্রশ্নটাই তোমাকে আর করব না।  
কারণ বিশ্বাসঘাতকতার পর প্রশ্নও হয় ভ্রান্ত।  
শুধু জানিয়ে রাখি—  
এই শহরটা তোমার মতোই নিঃশব্দ আর বেখেয়াল।  
এখানে সব আলো নিভে যায় একদিন,  
শুধু অন্ধকারই জানে  
বিশ্বাসঘাতকদের মুখ কতটা চেনা।