- শ.ম. শহীদ
কটর কটর কাঁটছে- ঘুণ
মাঝির মেয়ে চাটছে নুন
নুন আনতে পানতা শেষ
রক্তে কেনা- বাংলাদেশ!
‘উদয়-অস্ত’ ঝরছে ঘাম
বরগা রাখি- গায়ের চাম
চামবাদুরের বেজায় সুখ-
করছে উজার মায়ের বুক!
ঝুট-ঝামেলা সইছি নানা
দেখা’ শোনা’ বলায় মানা
মানা ভাঙলে মারবে ল্যাঙ
থাক রে হয়ে- কুনোব্যাঙ!
=============
ছড়াটির জন্মকথা : কিছুদিন আগে লালমনিরহাট থেকে রংপুর যাচ্ছিলাম ট্রেনে। একজন অপরিচিত লোক কাউনিয়া জংশন থেকে আমার সহযাত্রী হলো। তাঁর বয়স আনুমানিক সত্তর বছর। চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছেন। কথায় কথা অনেক কথা হলো তার সাথে। তিনি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু তাঁর কোন একাডিমিক সনদ নেই। কাজেই সে কোন সরকারী সুযোগ সুবিধা পান না।
বর্তমানে সেই দেশপ্রেমিক জনৈক মুক্তিযোদ্ধা চরম দারিদ্রতা এবং রোগে-শোকে আক্রান্ত হয়ে দুর্দশাগ্রস্থ জীবন যাপন করছেন। তিনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতির উপর চরম হতাশ। এত কথা যার সাথে আমি তার নাম ঠিকানা কিছুই জানি না। তিনি এখন কেমন আছেন তাও জানি না।
এবার আসি ছড়াটির ভাব প্রসংগে।
কট্টর কট্টর কাটছে ঘুন : ঘুনপোকা কাঠ কাঁটার সময়ে কটর কটর শব্দ হয়। তেমনি একজন দেশপ্রেমিক যিনি বিগত স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে নিজের দেশকে শত্রুমুক্ত করতে খেয়ে না-খেয়ে প্রাণপণ লড়েছেন। তাঁর কোন একাডেমিক সনদ নেই কেননা সে যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেননি বা দেশের অভ্যান্তরে কোন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাছে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও নেননি। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি কোন বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম নেই। অথচ সেই সময়ে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধ না করে অথবা যুদ্ধের বিরোধীতা করেও এখন দিব্যি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে।
মাঝির মেয়ে চাটছে নুন: এই বাক্যটিতে সেই দেশ প্রেমিকের মেয়েকে মাঝির মেয়ে হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একজন মাঝি ঝড়-ঝঞ্ছা, বৈরী আবহাওয়া, নদীর প্রতিকুল স্রোতধারার ধ্বংসলীলা থেকে যাত্রীদের নিরাপদে পারে পৌঁছে দেয়ার যেমন দায়িত্ব নেন তেমনি একজন মুক্তিসেনা পদে পদে জীবন বিপন্নের ঝুকি নিয়ে স্বাধীনতার নিরাপদ কুলে দেশ বাসীকে পৌঁছে দিয়েছেন। অথচ তিনি এখন চরম দারিদ্রতার সাথে লড়াই করছের। ক্ষুধার্থ মানুষ কত কিছু খেয়েই তো ক্ষুধা নিবারণ করতে চেষ্টা করে। ঘরে ভাত নেই দেশপ্রেমিকের মেয়ে লবন চেটে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করছে।
নুন আনতে পান্তা শেষ: দেশপ্রেমিক মাঝির বর্তমান অবস্থার খুবই সংগীন। দারিদ্রতার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর সংসারে অনটনের শেষ নেই। তার যা রোজগার তা দিয়ে বর্তমানে লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বাজারে নিত্য প্রয়োজন মিটে না। একটা যোগার করতে করতে অন্যটা শেষ হয়ে যায়।
রক্তে কেনা এ বাংলাদেশ: এই দেশ এবং এই স্বাধীনতা রক্তসাগর পাড়ি দিয়ে অর্জিত হয়েছে। প্রতিটি সংগ্রাম বা যুদ্ধ চালিত হয় একটি সুন্দর এবং নির্মল স্বপ্নকে সামনে রেখে। দেশপ্রেমিকেরও একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু জীবনের প্রান্তসীমায় পৌছেও তিনি তার সেই লালিত স্বপ্নের বাংলাদেশ না পেয়ে চরমভাবে হতাশ।
উদয়-অস্ত ঝরছে ঘাম: দেশপ্রেমিক এখন জীবন যুদ্ধের একজন পরাজিত সৈনিক। সকাল থেকে রাত অব্দি হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও তাঁর সংসার সামরাতে পারছেন না। তাঁর জীবনে কোন অবসর নেই। নিত্যদিন কাজ না করলে উপাস অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
বরগা রাখি গায়ের চাম: দায়িত্ববোধ তাঁকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। স্বীয় উপার্জনের কর্মে কোন অবহেলা করার সুযোগ নেই তাঁর। এ তো গায়ের চামড়া বন্দক রাখার মতই অবস্থা। স্বাধীনতার এত বছর পরে দেশপ্রেমিকের বার্ধক্য বয়সেও দারিদ্রতার বোঝা কাঁধে তুলে ছুটতে হচ্ছে।
চামবাদুড়ের বেজায় সুখ: অথচ এই স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধীরাই তুলনামুলক ভাবে সুখে দিন কাটাচ্ছে। কেউ কেউ বীরদর্পে রাষ্টীয়ভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করছে। তাদের চরিত্রটা মুলতঃ তরল পদার্থের মত পাত্র অনুযায়ী আকার ধারণ করে। কাজেই সরকার বদল হলেও তাদের কোন সমস্যা হয় না।
করছে উজার মায়ের বুক: তারা নিজেদের স্বার্থে হেন কাজ নাই করতে পারে না। তারা স্বদেশ কল্যাণের তোয়াক্কা করে না। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ যাই হোক তার আড়ালে একটা বিকৃত মানসিকতা লুকিয়ে থাকে। লাখো লোকের সামনে যদিও উচ্চ কণ্ঠে গায়- “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” ভেতরে কিন্তু তখন “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” ঢেউ খেলে। তারা সুযোগ পেলেই দেশকে রক্তাক্ত ও লুণ্ঠন করে।
ঝুট-ঝামেলা সইছি নানা: দেশের যারা সাধারণ নিরিহ মানুষ তাদের সমস্যারও শেষ নেই। দুর্নীতিবাজ এবং স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা এসব সমস্যার অধিকাংশ সৃষ্ট। তাদের নানা রকম দুষ্কর্ম নিরবে সইতে হচ্ছে।
দেখা, শোনা, বলায় মানা: অসৎ এবং দুর্নীতিবাজ লোকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বা তাদের অমতে চলতে গেলে সমস্যা আরও বিস্তার লাভ করে। কাজেই অন্যায় দেখেও তা নিরবে মেনে নিতে হচ্ছে। তাদের অপকর্ম দেখা যাবে না, শোনা যাবে না এবং কাউকে বলাও যাবে না।
মানা ভাঙ্গলে মারবে ল্যাঙ: এইসব দুর্নীতিবাজ স্বার্থান্বেষী শোষক শ্রেণির মানুষ বর্তমান সমাজে নেতৃত্বও দেয়। তারা তাদের সুবিধার্থে নানা প্রকার নিয়মনীতির প্রচলন করে যা সাধারণ মানুষকে মেনে নিতে হয়। না মানলে এর পরিনাম ভালো হয় না। তারা যে কোন সময়ে তাদের অবাধ্যগণকে শাস্তি দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
থাক রে হয়ে কুনোব্যাঙ: কুনোব্যাঙ বাইরের জগত চেনে না। ঘরের কোণেই তাদের বসবাস। বাঙালিদের প্রতিবাদী হয়ে ওঠার অনেক ইতিহাস আছে কিন্তু বর্তমান সমাজ ও রাষ্টীয় অন্যায়ে বাঙালি তাদের অতীতকে সামনে এনে সাহস দেখাতে পারছে না।“সমষ্টিগত শক্তির কাছে কোন দুর্নীতিবাজের একার শক্তি কখনই বড় হতে পারে না” এই চিরন্তন সত্যটা বাঙালি ভুলতে বসেছে। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য মাঠে নামছে না বরং কুনোব্যাঙ সেজে কপাট বন্ধ করে ঘরে বসে আছে।