জীবনের প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহ কবিতার উপাদান,
কবিতা কবিদের মনের জগতে আবর্তিত। কবিদের চিন্তা সমকাল এবং সমকালের বাইরে যতটুকু সম্ভব বিবর্তিত। কবি কবিতা লিখেন-প্রথমে নিজের মনকে আন্দোলিত করে দ্বিতীয়ত পাঠকের মনোজগতে সেটি জাগিয়ে দিতে। আমরা প্রত্যেকেই বিশ্বাস করি কবিতা জোর খাটিয়ে সৃষ্টি করা যায়না, কবিতার জন্য বিশেষ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, সৃষ্টির মগ্নতায় ডুবে যেতে হয়।
কবি মনজুর কাদের 'র তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ " অস্তগামী সূর্যের মায়া " প্রসঙ্গে উপরোক্ত কথাগুলোর অবতারণা করলাম। গ্রন্থটি কয়েকদিন আগে হাতে পেলেও সময়ের অভাবে পড়ার সুযোগ হয়নি আজ হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম এবং মুগ্ধতায় শেষ অব্ধি পাঠ করলাম।প্রসঙ্গত কবির কবিতাগুলো আধুনিক, প্রাঞ্জল এবং উপমা সমৃদ্ধ।
সাধারণত কবিতার জন্য যে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ববহন করে সেটি হলো উপমা, শব্দের প্রয়োগিক ক্ষমতা এবং বিষয় ভাবনা। স্বার্থক কবিতা তখনি হয়ে উঠে যখন পাঠক বুঝে নিতে সক্ষম হয়-কবিতার প্রতিটি চরণ পাঠকের হৃদয়ে অনুরণিত হয়েছে, সেটি হোক ছন্দের কবিতা কিংবা গদ্যধর্মী। প্রকৃতি, মানুষ, প্রেম, বিরহ, নৈঃশব্দ্য, প্রাচীনতা কিংবা মিথ কবিতার সত্তার অন্যতম নিয়ামক। দ্রশ্যমান এবং কল্পিত জগত কবির অনভূতি এবং উপলব্ধির শব্দময়তা।
কবির চিন্তার জগত নিয়মিত ভাঙতে থাকে কবি নিজেই, ভাঙছে, গড়ছে, রূপ পালটে নিচ্ছে। কবি মনজুর কাদেরের কবিতা পাঠে এমনি বোধদয় হয়েছে প্রতিনিয়ত। গ্রন্থের প্রথম যে কবিতা- পথ "ফেলে আসা পথে নিঃসঙ্গতার নিজস্ব ছায়াগুলো কেঁপে ওঠে" পরক্ষণেই... " নদীর বয়স খোলে অবমুক্ত হতে চায় অনিন্দ্র খেয়াল, যা কিছু নতুন "
কবির উপমায় ফুল, পাখি, বৃষ্টি, ঝর্ণা, প্রেম, প্রণয়, বিরহ, আলো, অন্ধকার, নৈঃশব্দ্যে, সময়, পুঁজি, মৃত্যু সমস্ত কিছুই ব্যাপ্ত হয়েছে। প্রতিটি কবিতায় উপমা ও প্রতীকি ব্যঞ্জনায়, শব্দের বুনিয়াদি নির্মাণে অন্যরকম এক ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি কবিতায় যেনো চিন্তাকে নাড়িয়ে দেয়।
প্রেম শাশ্বত, প্রেম নানাভাবেই প্রকাশিত, কবিও সেক্ষেত্রে পাঠককে আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছেন। " আগুনের কোলাহলে ভালোবাসো প্রকৃতির প্রেম/ মেঘ ডাকলে যখন বৃষ্টি আসে/ তুমি হয়ে ওঠো ঝরনার লাবণ্য" কবিতা শব্দহীন বিষাদ. কিংবা তোমার ঠোঁটের কাছে অনন্ত প্রেম ও প্রেমের উল্লাসে বেজে উঠা ভ্রমণের গল্প! কবিতা-লকডাউন।
কবি মনজুর কাদের কে যারা চিনেন তারা প্রত্যেকেই জানেন তিনি প্রকৃতি প্রেমিক, প্রকৃতি তার কবিতার প্রধান উপজীব্য। প্রকৃতিকে তিনি যেমনটি মননে ধারণ করেন তদ্রুপ প্রকাশেও অনবদ্য " নির্জনতার নিবিড় ছায়ায় শব্দের যে গোপন ইশারায় তুমি ছুঁয়েছিলে দৃষ্টি, সীমাহীন মুগ্ধতায়" কবিতা- শীতার্ত পৃষ্ঠা। " প্রত্যয়ের স্নিগ্ধ কথাগুলো মুখস্থ হলেই বনে যাই পুষ্প-অরণ্যের প্রভূ" কবিতা -তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবোনা কেন? (২)। উল্লেখিত কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতায় প্রকৃতি এমন ভাবে ধরা দিয়েছে সংক্ষিপ্ত পাঠ প্রতিক্রিয়ায় সেটি তুলে আনা নিতান্তই দূরহ কাজ!
কীর্তনখোলার কূলে কবির বেড়ে উঠা, কীর্তনখোলা তাঁর হৃদয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাইতো পূর্বোক্ত কাব্যগ্রন্থের ধারাবাহিকতায় এইবারের গ্রন্থটিতেও কীর্তনখোলার ছয়টি পর্ব তুলে এনেছেন -এইকটি কবিতাপাঠে ভীষণ তাড়িত হই, এই বুঝি ছুটে গিয়ে লুটে পড়ি -কীর্তনখোলার বুকে। " প্রণয় ও প্রলয়ে উত্তেজনা বয়ে আনে স্মৃতির শেকড় হতে কীর্তণখোলার ঢেউ অবধি, কবিতা কীর্তণখোলার ঢেউ" (১)" তোমার চোখের গভীরে আজও কীর্তণখোলার জল, টলমলে" কবিতা কীর্তনখোলার ঢেউ (৫)।
কবিরা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন কবিদের ছুঁয়ে দেয় -তাইতো লিখেছেন " স্বপ্নগুলো থাকে অহর্নিশ ঋতুর আড়ালে-আর আসন্ন রোদসী স্পর্শে কোনো এক শুভ ভোরে করতলে লেখাগুলোর বদল ঘটে " কবিতা -করতলে রেখাগুলো বদলে যাবে।
কবির মননে প্রেম যেমন আছে তেমনি স্বজন হারানো বেদনা ও বিরহেও কাতর হয়েছেন, "পাতার মর্মরে মা একা-আমার চোখে তন্দ্রাহত রাত্রির পথ, প্রলন্বিত। প্রত্নগন্ধের বেদনা" কবিতা-আমি অনেকদিন থেকেই ঘুমোই না"। " বাবা আজ নিষ্ঠুর ঘুমের প্রান্তে লুকায়িত বর্ণাড্য আকাশ-মৌল নীল " কবিতা-কেবলই শূন্যতা বয়ে বেড়াই। " তোমার চোখের দৃষ্টিক্লান্ত জল ছোঁয় বিগত রাত্রির ইতিহাস....কবিতা-আকাশ ক্রমশ নীল হয়।
কবি গভীর বোধ থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের অসঙ্গতিগুলোও কবির কলমে স্থান দিয়েছেন "জুয়ার আসরে ক্ষুধার্ত মানুষগুলো মৌসুমী নিশ্বাসে বেঁচে থাকে" কবিতা-পুঁজিবাদ। " এইসব কীটপতঙ্গরা বাচালতা বোঝে /প্রভূত্ব দেখায় পশুর স্বভাব.... কবিতা-বোধের আড়ালে বিব্রতবোধ। নিঃশব্দ তাণ্ডবে মানচিত্রের বদল/ নোনা জলের ভেতর ক্লান্ত জলের মিছিল।
প্রকৃতির পাশাপাশি মৃত্যুচিন্তাও কবির ভাবনাকে মাঝেমধ্যে ই নাড়িয়ে দেয় তাইতো কবির কন্ঠে উচ্চারিত " মাটির পুতুলে লেগে থাকে আগুন পোড়ার গন্ধ। মৃত্যু! কবিতা-নিরাপদ মৃত্যু।
পুরো কাব্যগ্রন্থে ৪৮টি কবিতা স্থান পেয়েছে, প্রতিটি কবিতায় পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে শেষ পাতা অব্দি। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে। অসাধারণ প্রতিটি কবিতা। উল্লেখিত কাব্যগ্রন্থে পঠিত কবিতার চরণে বলতে হয় " সভাতার পৃষ্ঠায় সমস্ত ক্লান্তি স্বপ্ন কুড়ায় রেখার মুগ্ধতায় "
কাব্যগ্রন্থ : অস্তগামী সূর্যের মায়া
প্রকাশক শ্রাবণ প্রকাশনী
প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২৩
মূল্য: ২৫০ টাকা।