ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশের যে কজন কবির কবিতা আমাকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছে তাঁরমধ্যে অগ্রভাগে ছিলেন আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমান, হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, সিকদার আমিনুল হক,আবুল হোসেন , আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ আলী আহসান, তসলিমা নাসরিন এবং আবুল হাসান অন্যতম। প্রিয় কবিদের মধ্যে এরপূর্বে রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ নিয়ে কিছু লেখার অবকাশ পেয়েছিলাম, আজ লিখছি আমার আরেকজন প্রিয় কবি আবুল হাসান ( ১৯৪৭-১৯৭৫) কে নিয়ে। সময়কাল বিবেচনায় কবি আবুল হাসান বেঁচেছিলেন মাত্র ২৮ বছর। শৈশবের সময়টা বাদ দিলে মাত্র ১০ বছর তাঁর লেখালেখির বয়স।এরমধ্যে আবার দীর্ঘ সময় কেটেছে দুরারোগ্য ব্যাধিতে। (শৈশবে রিউম্যাটিক জ্বর পরবর্তীতে ১৯৭০ সাল থেকে হৃদপিণ্ড সম্প্রসারণজনিত ব্যাধি) দীর্ঘ অসুস্থতাকে চিরসঙ্গী করে তাঁর লেখালেখির ব্যাপ্তি, তাইতো তিনি এমনটি লিখেতে পেরেছেন-
" অসুখ আমার অমৃতের একগুচ্ছ অহংকার"
কিম্বা " আমার অনলে আজ জাগো তবে হে জীবন,জয়শ্রী জীবন "
আবুল হাসান কবিতা ছাড়াও বেশকিছু প্রবন্ধ ,গল্প, নাটক লিখেছেন। করেছেন সাংবাদিকতাও। সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর পরিচয় হয়ে উঠে তিনি একজন কবি। নিঃসঙ্গতা, স্মৃতিকাতরতার পাশাপাশি মানুষের যাপিত জীবনের নানা দুঃখ-বেদনা, স্বপ্নচারিতা, মূল্যবোধহীনতা,সামাজিক-রাজনৈতিক
স্বেচ্চাচারিতা, তথা সংগ্রামী চেতনা তুলে ধরেছেন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিশীলতায়। জীবনযন্ত্রনা কিংবা পারিপার্শ্বিক নির্মমতার মাঝেও আবুল হাসান মানুষকে স্বপ্ন দেখাতেন, আশার গান শোনাতেন। বাংলা সাহিত্যের জগতে বিশেষত কাব্যসৃষ্টিতে তিনি সম্পন্ন স্বাতন্ত্রিক
ধারার প্রচলন ঘটিয়েছেন, তার ভাষাশৈলী ছিলো একান্ত নিজস্ব, প্রাতিস্বিক কাব্যরীতি কিংবা বলতে পারি তিনি নিরিক্ষাধর্মী এবং অলংকরণ সমৃদ্ধ। ছোটবেলায় অত্যন্ত ভালো কোরআন তেলাওয়াত করতে পারতেন, ফুফু ফাতিমার কাছ থেকেই এটি আয়ত্ব করেছিলেন, পরবর্তীতে কবিতায় তাঁর-ই প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পায়-
" ফাতিমা ফুফুর প্রভাতকালীন কোরানের/মর্মায়িত গানের স্মরণে তাই কেন যেনো আমি/চলে যায় আজো সেই বার্নির বাওড়ের বৈকালিক ভ্রমণের পথে"
মূলত স্কুল তাঁর জীবনে কবিতা লেখায় মনোনিবেশ। কলেজ জীবনে তিনি কবিতায় এতটায় মজেছিলেন যে তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে-ব্রজমোহন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা (জীববিজ্ঞান)
চলাকালীন উত্তর পত্র হাতে নিয়ে তিনি সুদীর্ঘ কবিতা লিখতে লাগলেন, প্রায় ১ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর হল তত্ত্বাবধায়ক লক্ষ্য করলেন আবুল হাসান একাগ্রচিত্তে কিছু একটা লিখছেন, তিনি কাছে গিয়ে দেখতে পান পরীক্ষায় খাতায় আবুল হাসান সুদীর্ঘ কবিতা লিখছেন-পরে তিনি কবিতা না লিখে প্রশ্নোত্তর লিখতে বললে তার সম্বিত ফিরে আসে, পরের ২ ঘণ্টা তিনি প্রশ্নোত্তর লিখে হল থেকে বেরিয়ে আসেন।
উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর কবি আবুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন যদিও অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নেয়া হয়ে উঠেনি কিন্তু সেইসময় থেকে কবি নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ও ঢাকায় বসবাসের সুবাদে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যিকদের অনেকের সাথেই তাঁর অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। একই সময়ে তিনি সাংবাদিকতায় জড়িত হয়ে পড়েন। প্রথমে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় বার্তা বিভাগে চাকুরী নেন পরবর্তীতে গণবাংলা, জনপদ, গণকণ্ঠ পত্রিকায় চাকুরী করেন।
প্রাতিস্বিক জীবনদৃষ্টি এবং বারবার অসুস্থতার প্রেক্ষিতে তিনি চাকুরিতে স্থায়ী হতে পারেননি।তাছাড়া তিনি ছিলেন উড়নচণ্ডী, বোহেমীয় স্বভাবের মানুষ। যেকথা আগেই বলছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং স্বনামধন্য লেখকদের সান্নিধ্যে তাঁর লেখালেখি ব্যাপকভাবে চলতে থাকে, সেইসময় ঢাকার সব উল্লেখযোগ্য দৈনিক প্রত্রিকা ও সাময়িকীতে তাঁর কবিতা, গল্প, ছোটগল্প প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি দুটি নাটকও লিখেন। স্বল্প আয়ুর বিরল প্রতিভাধর এই কবি ১৯৭৫ সালে হাসপাতালের বেডে শুয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন লিখেন-
" যতদূর থাকো ফের দেখা হবে
কেননা মানুষ যদিও বিরহকামী,
কিন্তু তার মিলনই মৌলিক "
তখন তিনি সমকালীন বাংলাসাহিত্যের এক ব্যাতিক্রমধর্মী কাব্যপথিকৃৎ! সাহিত্যঙ্গনে তাঁর অভিযাত্রার সময়কাল ষাট-সত্তুরের দশক বাংলাদেশের রাজনীতি তখন অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় ভরা,ছয়দফা,আটষট্টি-উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তুরের নির্বাচনের উত্তাল সময়ের মধ্যে থেকেও তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি আমাদের বিস্মিত করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল চেতনা তাঁর কাব্যে উপস্থিত ছিলো-
" যাই, এখন তাদের শরীরে শস্যের আভা ঝরে পড়ছে যাই/ নিশ্বাসে নিশ্বাসে তার তীব্রতায় তরুণ দুঃখের কাছে ফিরে যাই,যাই /মৃত্যু আর মৃত্যু আর মৃত্যুর আধারে যাই/ বিবর্ণ ঘাসের ঘরে ফিরে যাই,যাই/ সেখানে বোনের লাশ,আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজে নিতে হবে, আমি যাই"
পত্রিকা-চিত্রকল্প।
আমরা আরো জানতে পারি ১৯৭০ সালে সমগ্র এশিয়া ভিত্তিক এক প্রতিযোগিতায় তার " শিকারী লোকটা " কবিতা প্রথম স্থান অধিকার করে। পরে ঐ কবিতাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত সমগ্র পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের কবিতা সংকলনে স্থান পাই। এই থেকে অনুমান করা যায় আবুল হাসান কতটা সমৃদ্ধ কবি। আবুল হাসান ছিলেন সহজাত কবি, বন্ধুদের আড্ডা, পত্রিকার অফিসে, টুকরো কাগজ কিম্বা সিগ্রেটের প্যাকেটেও লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, পরবর্তীতে সেসব কবিতাগুলোর সাহিত্যমূল্য প্রকাশিত হলেও তার অনেকগুলোয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। আবুল হাসানের প্রথম কবিতার বই "রাজা যায় রাজা আসে" (খান ব্রাদার্স এণ্ড কোম্পানী) এরপর পৌনঃপুনিক অসুস্থতার ভেতরেও তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই " যে তুমি হরণ করো" (প্রগতি প্রকাশনী) তৃতীয় কবিতার বই "পৃথক পালঙ্ক" (সন্ধানী প্রকাশনী) প্রকাশিত হয়। কবির মৃত্যুর ১০ বছর পর নভেম্বর-১৯৮৫ নওরোজ সাহিত্য সংসদ প্রকাশ করে আবুল হাসানের " অগ্রন্থিত কবিতা" এবং ১৫ বছর পর প্রকাশিত হয় " আবুল হাসান গল্প সমগ্র " সেখানে তাঁর ৯টি গল্প ছিলো। তাছাড়াও মৃত্যুর পর ১২ ডিসেম্বর-১৯৭৫ খ্রীঃ আবুল হাসানের নাটক " ওরা কয়েকজন" সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশ হয়, যেটি ১৯৮৮ সালে গন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
কবি প্রায় অসুস্থ হয়ে যেতেন হৃদপিণ্ড সম্প্রসারণ জনিত অসুস্থতায় লেখক বন্ধুদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দীর্ঘ চারমাস জার্মানিতে চিকিৎসা করে ২৪ ফেব্রুয়ারি-১৯৭৫ দেশে ফিরলেও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেননি পুনরায় অসুস্থ হয়ে ৪নভেম্বর-১৯৭৫ ভর্তি হন ঢাকা পিজি হাসপাতালে, সেখানে ২৬ নভেম্বর-১৯৭৫ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আমার প্রিয় কবিদের একজন আবুল হাসান। তাঁর অকাল মৃত্যু বাংলাদেশের সাহিত্যঙ্গনে নিঃসন্দেহ অপূরণীয় ক্ষতি। সেদিন বাংলাদেশের প্রখ্যাত অনেক লেখক বিবৃতি দিয়েছিলেন। মহাদেব সাহা লিখেছিলেন " হাসান আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় কবি"
আহমদ ছফা লিখেছিলেন " গোলাপ ঝরে গেছে "।
আলোর প্রতি সমর্পিত আত্মা অন্তিমে কবির উচ্চারণ
" আর নেই কারো কোনো চিত্তবিকারের পরিনতি
/প্রকৃত আলোর কোনো ক্ষয় নেই/
আলো অনিঃশেষ, আলো শান্তিকামী...."।