বইমেলা, সীতাকুণ্ডের সাহিত্য আড্ডা, আমার ব্যক্তিগত পড়া ও লেখালেখি
--আতাউল হাকিম আরিফ
১৫ ফেব্রুয়ারি-২০২২ শুরু হয়েছে অমর একুশের বইমেলা। আমাদের প্রাণের মেলা। যদিও ১৫ দিন পরেই শুরু হয়েছে আশা করছি মধ্য মার্চ পর্যন্ত মেলা অব্যাহত থাকবে। মেলাকে কেন্দ্র করে বরাবরই লেখক, সাহিত্যিকদের মাঝে অনুভূতিপ্রবণ উচ্ছ্বাস জন্ম নেয়। খুবই স্বল্প সংখ্যাক পাঠকের মাঝেও কিছুটা উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু দুঃখজনক সত্য বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার স্পৃহা একেবারেই কমে গেছে, সোশ্যাল মিডিয়া তাঁদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছে। এটি কতটুকু ভালো হয়েছে কিংবা খারাপ হলো সেটি সময়ই বলে দেবে। আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি প্রকাশ করছি মাত্র। যাহোক মেলাকে কেন্দ্র করে যদি প্রজন্মকে বইয়ের প্রতি উৎসাহিত করা যায় সেটিও বা কম কী!
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বইমেলা অতটা জনপ্রিয় ছিলনা, অনেক পরেই বইমেলার পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে এর জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায়, বইমেলাকে কেন্দ্র করেই লেখক, প্রকাশকগণ সৃজনশীল, মননশীল বই প্রকাশ করে থাকে অন্যসময় খুব কম সংখ্যাক বই প্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সেইসময় বইয়ের প্রতি সার্বজনীন আসক্তি পরিলক্ষিত হতো, এমন কি আমার আম্মাকেও দেখেছি অবসর পেলেই বই পড়ত, মীর মোশারফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম, শরৎ চন্দ্রের চরিত্রহীন,দেবদাস,
রবীন্দ্রনাথের গল্পসমগ্র এইজাতীয় বইগুলো আম্মাকে পড়তে দেখতাম, সেইসময় বেগম পত্রিকাটিও আমাদের বাসায় নিয়মিত রাখা হতো, একইভাবে আব্বা, বড় ভাইয়া, আপুদেরকেও দেখতাম সুযোগ পেলে বই পড়তো, দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলার বাণী এবং সাপ্তাহিক একতা পত্রিকাও বাসায় নিয়মিত পেতাম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবাদ পত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও ক্রমাগত পাঠক হারাচ্ছে। সংবাদপত্রের যায়গায় ইলেকট্রনিকস মিডিয়া পাঠকের চাহিদা পূরণ করছে অনেকখানি। যেকথা বলছিলাম বইয়ের প্রতি আগ্রহটা এই প্রজন্মের মাঝে একেবারেই কমে গেছে।
কয়েকদিন আগে সীতাকুণ্ড গণ পাঠাগারে গিয়েছিলাম সেখানেও কোন পাঠক দেখতে পাইনি এটি আমাকে খুবই হতাশ করেছে শুরুর দিকে এই পাঠাগারটি খুবই জমজমাট ছিলো, বেশকজন লেখক, সাহিত্যিক ছাড়াও পাঠকদের বেশ কোলাহল ছিলো, গণপাঠাগার ও বিশ্ব সাহিত্যে কেন্দ্রের সমন্বয়ে জমজমাট সাহিত্য আড্ডাও হতো নিয়মিত। মনওয়ার সাগর ও প্রফেসর নুরুল গণি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ও গণ পাঠাগারের সমন্বয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা সহ কিছু সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
সীতাকুণ্ডের লেখকদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় নজীর আহমদ, স্যার, ড. মনওয়ার সাগর, দেবাশিষ ভট্টাচার্য, শাহনেওয়াজ বিপ্লব, মিল্টন রহমান, জামসেদ উদ্দিন, সুরাইয়া বাকের, প্রফেসর নুরুল গণি, নাছির উদ্দীন অনিক, লিটন চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান, ইকরাম রানা,সোয়ায়েব মুহামদ, বিশ্বজিৎ বনিক ( কমবেশি তারতম্য রয়েছে ) সহ অনেকেই এই আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন, তাঁদের দেখাদেখি পরবর্তী প্রজন্মের অনেকের মাঝেই লেখালেখির আগ্রহ জন্ম নেয় এবং অনেকের মাঝেই সৃজনশীল মনোবৃত্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়। নিয়মিত অনেক ছাত্রকে দেখতাম বিকাল বেলায় ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ত তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হল সরোয়ার চৌধুরী, ফাহিম, সঞ্জিত দাশ, মাসুম সামজাদ, শাকিল, আলী আদনান, মোঃ সেলিম, হালিমা, শিমু, ফয়সাল (অনেকের নাম এইমুহূর্তে মনে পড়ছে না) এইসময় মাতৃভূমি সামাজিক সংগঠন/ সাপ্তাহিক চলমান সীতাকুণ্ড, ভোরের কাগজ পাঠক ফোরামও কিছু কিছু আড্ডার আয়োজন করেছিল। ইঞ্জিনিয়ার এল কে সিদ্দিকী, ডা. এখলাস উদ্দিন, কবি ওমর কায়সার, গল্পকার হুমায়ুন মালিক, বিশ্বজিৎ চৌধুরী সহ অনেকই গণ পাঠাগারের অনুষ্ঠিত আড্ডায় অংশ নিয়েছিলেন।
আমার স্মরণ আছে আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা শেষ করলাম আব্বা আমাকে বাড়ির ব্যক্তিগত লাইব্রেরী দেখিয়ে বললো পরীক্ষা শেষ আপাতত ৩ মাস এই বইগুলো পড়, তিনি শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত বইটি হাতে ধরিয়ে দিলেন, মূলত সেই থেকে আব্বা, বড় ভাইয়া ড. মনওয়ার সাগর এর উৎসাহে এবং বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ও গণ পাঠাগারের আড্ডায় অনুপ্রানিত হয়ে অনেকগুলো বই পড়েছি, তারাশঙ্করের কবি, গণদেবতা,
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি, অদ্বৈত মল্লবর্মনের তিতাস একটি নদীর নাম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলোকোঠার সেপাই, খোয়াবনামা, আবুল বাশারের ফুলবউ, শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি, জননী, শরৎচন্দ্রের পথের দাবী, দেবদাস, সৈয়দ ওয়ালী উল্ল্যার লালসালু, চাঁদের অমাবশ্যা, নজরুলের মৃত্যু ক্ষুদা, জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা, চতুরঙ্গ, গল্প সমগ্র, ছোট গল্প সমগ্র, মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা, যাযাবরের দৃষ্টিপাত, আল মাহমুদের কাবিলের বোন , আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নাম্বার তৈলচিত্র,বিমল মিত্রের অপরাজিত, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের সাতকাহন, মৈত্রীয় দেবী ন হন্যদে, হাসান আজিজুল হকের আত্মজা ও একটি করবী গাছ( গল্প গ্রন্থ) কায়েস আহমেদের লাশকাটা ঘর (গল্প গ্রন্থ), কমল কুমার মজুমদারের গল্প সমগ্র, সমরেশের কালবেলা, সুনীলের পূর্ব পশ্চিম, প্রথম আলো, শীর্ষেন্দুর দূরবীন, পার্থিব, হুমায়ুন আজাদের দ্বিতীয় লিঙ্গ, নারী, হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে, তসলিমা নাসরিনের নির্বাচিত কলাম, নিমন্ত্রন, নীলিমা ইব্রাহীমের ওরা বীরাঙ্গনা, নাসরিন জাহানের উড়ুক্কু, মেজর ( অবঃ) রফিকুল ইসলামের বাংলাদেশ সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংকট, অধ্যাপক আবু সাঈদের বঙ্গবন্ধু মার্ডার ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস, আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজ, রকিব হাসানের কিশোর থ্রিলার তিন গোয়েন্দা সিরিজ , রোমেলা আফাজের দস্যু বনহুর সহ অসংখ্য বই পড়েছিলাম, সেসময় বিশ্ব সাহিত্যে কেন্দ্রের বদৌলতে আস্কার ওয়াইল্ড, এরিক মারিয়া রেমার্ক, বার্নার্ড শ, শেক্সপিয়ার, নেহেরু লাল গান্ধী, লিও টলস্টয়, ম্যাস্কিম গোর্কি, কাফকা, এডওয়ার্ড সাঈদ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সহ অনেক লেখকের অনুবাদ গ্রন্থ পড়েছি, এছাড়াও শংকর, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, আরজ আলী মাতব্বর, নবীন চন্দ্র সেন, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, দীন বন্ধু মিত্রের, হরিপ্রাসাদ শাস্ত্রীরও কিছু বই তখন পড়েছিলাম। ( আরো অসংখ্য বই পড়েছিলাম, সল্প পরিসরের লেখায় অনেকগুলো বইয়ের নাম এইমুহূর্তে মনে করতে পারছিনা) পত্রিকায় কলাম এবং সাহিত্যপাতা আমাদের নিয়মিত খোরাক ছিল ইনতিয়ার শামীম, শহিদুল জহির, জাকির তালুকদার, নাসরিন জাহান, হুমায়ুন মালিক প্রমুখের গল্প যেমন মিস করতাম না, নবীন-প্রবীণ কবিদের কবিতা পড়াও পারতে পক্ষে বাদ পড়তো না, মারুফ রায়হান, চঞ্চল আশরাফ, সরকার আমিন, ব্রাত্য রাইসু, টোকন ঠাকুর সহ তরুণদের কবিতাও অনেক পড়তাম। তদ্রুপ শামসুর রহমান, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সিকদার আমিনুল হক, সাজ্জাদ শরীফ, আবুল হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, মিনার মনসুর, জিয়া হায়দার, তমলিমা নাসরিন, ময়ুখ চৌধুরী, অরুণ চৌধুরী, এজাজ ইউসুফ, শিহাব সরকার, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, হেলাল হাফিজ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সমুদ্র গুপ্ত, নুরুল হুদা প্রমুখের কবিতাও নিয়মিত পড়তাম, বলতে পারেন কবিতা পড়া আমার নেশায় পরিনত হয়েছে। আমাদের সময় আব্দুল গাফফার চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, ফরহাদ মজাহার, আবুল মকসুদ, আহমদ ছফা, সরদার ফজলুল করিম, যতীন সরকার, নির্মল সেন, এবিএম মুসা, আবেদ খান, খন্দকার মোজাম্মেল হক, আবুল মোমেন, সিদ্দিক আহমেদ, মাহফুজ আনাম এবং ইন্ডিয়ার কুলদীপ নায়ার, অরুন্ধতী রায় ( অনুবাদ ছাপানো হতো) প্রমুখ নিয়মিত কলাম লিখতেন তাঁদের লেখাগুলোও প্রায় নিয়মিত পড়তাম। ( ৯০ 'র দশকের ব্যাপ্তিকাল)
আমরা ছাত্রাবস্থায় খেলাধুলা, আড্ডাবাজী, সাংস্কৃতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ড, ছাত্র রাজনীতি সবকিছুই নিয়েই কমবেশি ব্যস্ত ছিলাম। এরমধ্যে বইপড়া, পত্রিকা পড়াও নিয়মিত কাজ ছিল, বর্তমানে পারিপার্শ্বিক ব্যস্ততার কারণে খুব একটা পড়ার সুযোগ হয়না, তবে বর্তমানে অসাধারণ কর্ম পরিবেশে চাকরি করার সুবাদে মাঝেমধ্যে এটাসেটা পড়ি কিছকিছু লেখার চেস্টা করি। মূলত কবিতা লেখার প্রতি আমার ধ্যানমগ্নতা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক জনক সত্য আমাদের সীতাকুণ্ডে এখন সাহিত্য চর্চার যায়গা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে মনওয়ার সাগর, দেবাশিষ ভট্টাচার্য, মোঃ আরিফুর রহমান, জামসেদ উদ্দিন, ইকরাম রানা, শোয়ায়েব মুহামদ, আলী আদনান, মঈন ফারুক প্রমূখ মাঝেমধ্যে সৃজনশীল পত্রিকা/ ছোটকাগজ ইত্যাদি সম্পাদনা করে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো এখন তা নেই বললেই চলে। এই প্রজন্মের কেউ না কেউ এই দায়িত্ব গ্রহণ না করলে ভবিষ্যত প্রজন্ম পুরোপুরি সাহিত্যবিমুখ হয়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিঃ দ্রঃ সীতাকুণ্ড থেকে একে খান পর্যন্ত যাত্রাপথে এই লেখার ব্যাপ্তি, তাড়াহুড়ো এবং স্মৃতি বিভ্রাটে কিছু তথ্য ও নাম বাদ যেতে পারে।